আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোনালী পোকা

স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান সোনালী পোকা - কিঙ্কর আহ্সান ক. সেদিন ঝুম বৃষ্টি। মেঘগুলো সব পড়ে আছে রুপোর মল। জল ঝড়িয়ে কাঁদছে।

একটা সোনালী পোকা আটকা পড়েছে ঘরে। সোনালী জরি যেন লেপে দেওয়া ওর শরীর জুড়ে। বালকের এসব দিকে খেয়াল নেই। সে দাড়িয়ে আছে উঠোনে। বৃষ্টির প্রবল ঝাপটা এসে কাঁপিয়ে দেয়।

ঝাপসা করে চোখ। দারুন গতিতে পড়ছে শিল। হাস মুরগিগুলো ঠাই নিয়েছে খোপে ( হাস মুরগীর থাকার ঘর)। ওদের খাবার ভাঙা শামুকের টুকরো আর বাসী গন্ধের নরম আশটে মাংস মাটির সাথে মিশে ভিজে ভিজে কাঁদা হয়। বালক শিল কুড়োয়।

ছোট ছোট আঙ্গুলের হাতের মুঠোয় যতটা এটে নেওয়া যায় ততটা। মাঝে মাঝে লুকিয়ে মুখে পোরা হয় দু-এক টুকরো বরফ। বোন বিন্তি দেখলে বলে দেবে মাকে। ওর অবশ্য শিল টিলের দিকে কোন আগ্রহ নেই। ওর চোখ খুজছে আম।

ঝড়ো হাওয়ায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়া লিলিপুট আকারের টক আম। ভেজা রঙিন ফ্রক নিয়ে ছুটে ছুটে আম কুড়োচ্ছে সে। বিন্তীর সবসময়ের সঙ্গী মুনি। পাশের বাড়ির মেয়ে। বড় ন্যাওটা ওর।

সারটিক্ষন থাকে সাথে সাথে। আজ ও নেই বলে আম কুড়ানোতে জুৎ পাওয়া যায়না। বিন্তীর মনটা তাই ভারী খারাপ। বালক মুনির কথা জিজ্ঞেস করতেই খেপে গিয়ে বলে,‘ মুখপুড়ীটার কথা বললে দেব বসিয়ে কিল পিঠে। ও না আসলে কি আম কুড়োনো হবেনা আমার? আমি একাই একশো বুঝলি? ’ বিন্তীর কন্ঠে দারুন অভিমান।

বোনের কষ্টটা বোঝে বালক। আহারে! বালকের সাথে আবার বনেনা মুনির। মুনিকে সে ডাকে ডাইনি বুড়ি। বুড়িটা সারাদিন খেপায় ওকে। ছোটবেলা থেকেই কোলে কোলে থাকার অভ্যেস বালকের।

এর কোল ওর কোল হয়ে কত জায়গায় ঘুরেছে সে। কোলছাড়া হয়নি কখনও। ভূমি থেকে কিছুটা ওপরে থাকাই নিরাপদ মনে হয় তার। এখনও তাই সুযোগ পেলে কোলে ওঠার সুযোগটা হারায় না। কেন জানিনা এসবের জন্যে ভেংচি কাটে মুনি।

ডাইনির মত চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ বুড়ো খোকা কদ্দিন আর থাকবি কোলে কোলে। তুইতো দেখি দুধের শিশুই রয়ে যাবি জীবনভর। ’ শুনে বালকের কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়। চোখের কোলে চিকচিক করে জল।

বুড়িটা খেপাবে বলে ওর সামনে কাঁদাও যায়না। তাই বাড়ির সামনে পানের বরজটার আড়ালে গিয়ে কেঁদে নেয় ও একটু। বালকের খেলা নিয়েও বুড়িটার হাজারো অভিযোগ। কুতকুত ( এক্কা দোক্কা),রান্নাবাটি,বউ ছি, ফুল টোক্কাটুক্কি এসব খেলতেই বেশি ভালো লাগে বালকের। কিন্তু বুড়ি মুনিটা বলে এসব নাকি মেয়েদের খেলা।

ছেলেদের খেলা হল চারা মারা,ছিপ দিয়ে পুটি মাছ তোলায় পাল্লা দেওয়া আর মার্বেল নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো। খেলার আবার মেয়েছেলে কিরে বাবা ! খেলাতো খেলাই। বালক খেলতে গেলেই মুখ ঝামটা দেয় বুড়িটা। খেপায়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় বালকের।

ভাবে দেবে আড়ি। চিরদিনের জন্য। হবেনা কথা কখনও আর। কিন্তু মুনির সাথে যে ওর ভাব জমানোর শখ। একদিন বুড়িটার রাগী মুখ না দেখলে কেমন কেমন জানি লাগে।

সারাটা দিন বড্ড না ভালো লাগার মাঝ দিয়ে কেটে যায় সেদিন। তবে রাগ করুক মুনিটা। ওর জন্যে এইটুকু রাগ না হয় সহ্যই করল বালক। সে ম্যাচের খোসা জমায়। লাল,নীল হরেক রকমের ম্যাচ।

কখনও বাজার থেকে নিয়ে আসা হয় ভুনভুনি ( সুইট বল)। টিপু সুলতান আর ম্যাকগাইভারের ছবি সাটা এসবের প্যাকেটে। সব জমা মুনির জন্যে। দিতে সাহস হয়না বালকের। যদি বকে এই ভয়ে।

আকাশে মেঘেরও অনেক ওপর দিয়ে যখন ধোয়ার লেজ নিয়ে রকেট যায় তখন বুড়িটাকে দেখাতে ইচ্ছে করে। দেখাতে ইচ্ছে করে এক ঠ্যাং এর গো বক কিংবা পুকুরে পোতা বাশের ওপর ঠায় দাড়িয়ে থাকা কোন মাছরাঙাকে। হয়না কিছুই দেখা। মুনির এত সময় কই। অল্প বয়সেই পুরো পৃথিবীর ভার তুলে নিয়েছে সে মাথায়।

সংসারে কতই না কাজ তার। যত্তসব। মেজাজটাই খারাপ হয়। এত এত কাজ করার কি দরকার আছে বোঝেনা বালক। মুনিকে খুশি করার কতই না চেষ্টা তার।

কিন্তু মুনি যেন পন করেছে বালকের কোন কিছুকেই ভালো বলবেনা সে। এইতো সেদিন একটা বুড়ো শালিক আটকা পড়েছিল বাড়িতে। ফুফুজান শালিকটার পা দড়ি দিয়ে বেধে ছেড়ে দিয়েছিল বালকের ঘরে। সারাদিন সেই শালিকটার সাথে কথা হলো অনেক। শালিককে বালক বলল বুড়িটার কথা।

ভাবল এসবে খুশি হবে মুনি। কিন্তু হলো উল্টোটা। শালিকটা দড়ি দিয়ে বাধা দেখে বুড়িটার সেকি রাগ। রাগে ফুসতে ফুসতে বলল,‘ গাধা তুলে দেব একটা আছাড় তোকে। পাখি এইভাবে বেধে রাখতে হয়।

নিষ্ঠুর কোথাকার। ’ বকা শুনে চুপটি মেরে গিয়েছিল বালক। অভিমানে কিছুই খাওয়া হয়নি সারাদিন। মুনিটা এমন কেন! সবসময় টুনটুনি পাখির মত ছটফট করে,পুকুরে বুড়ো কচ্ছপ ছেড়ে দেয়,কাউকে না জানিয়ে কাশবনে লুকিয়ে থাকে,দুষ্ট ছেলেদের সাথে মারামারি করে ঠোট কাটে। ওর সাহস দেখে অবাক হতে হয়।

বালকের এসবের পরেও মুনি বুড়িটাকে বড্ড ভালো লাগে। নুন দিয়ে যখন বুড়িটা জলপাই খায়, নরম তুলতুলে মুরগির ছানায় মুখ লুকায়,প্রচন্ড রোদে সূর্যের আলোর ছটার তলে দাড়িয়ে গুনগুন করে ছড়া আউড়ায় তখন মুগ্ধ হয় বালক। বালকের বুকের ভেতরটা ভালোলাগার ফড়িং হয়। লাফায় তিড়িং বিড়িং করে। একটু লজ্জা আর একটু ভালো লাগা ঘিরে ধরে তাকে।

.চোখ বুজে আসে বালকের। বুজে আসে অকালপক্ক চোখ...। খ. বৃষ্টির বেগ কমেছে অনেকখানি। সোনালী পোকাটির ডানাদুটো ভিজে একাকার। বালক ঘরে এসে পোকাটিকে হাতে তুলে নেয়।

জোরে জোরে ফু দিয়ে শুকোয় ডানা। তারপর বলে,‘ উড়াল দিয়ে খবর নিয়ে আয়তো ডাইনি বুড়িটার। শুনেছি জ্বর অনেক। আমার হয়ে দেখে আয়না ওকে। ’ পোকা কথা শোনেনা।

মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। বালকের ছোট্ট হাতের নরম মুঠোয়...। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।