আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোনালী দিন

মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। তা হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন

সোনালী আলো এখনো দূর দিগন্তে। কোনো এক খুপড়ী পাড়ার ঘটনা। সদ্য শয্যা ত্যাগ করে এক মা ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার নয় বছরের শিশু সন্তানের দিকে। শিশুমুখ মাত্রই নিস্পাপ।

আর তার উপর যদি হয় ঘুমন্ত তাহলেতো কথাই নেই। নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি মা কোনো না কোনো দিন ভেবেছে,কি অদ্ভুত সুন্দর। আবার কোনো না কোনো দিন ভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠেছে,কারো নজর না আবার লেগে যায়। কখনো দৃষ্টিতে থাকে আনন্দের পরিতৃপ্তি, কখনোবা শুন্য দৃষ্টি। আলেয়ার দৃষ্টিতে শুধু অসহায়ত্ব।

ভোরের পাখীরাও এখনো খাদ্য সন্ধানে বের হয়নি। প্রতিদিন সে নিজে যখন কাজে বের হয় খুব ভোরে,এমন কতদিন হয়েছে চোখ খোলা রাখতে পারছেনা। প্রায় দিন চুলায় রান্না চাপিয়ে বসে বসে ঝিমিয়েছে। কেমন করে সে তার শিশু সন্তানের ঘুম ভাঙায়? যেই বাসায় কাজ করে সে, খুব বেশি দূরে নয়। অল্প কিছু সময় হাটতে হয় তার।

খালি পায়ে এইটুকু রাস্তা আসা যাওয়া করতেই তার পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। ভাবতে ভাবতেই ছেলের পায়ে হাত বুলায়। কোমল মতি শিশুর মনের মতই এখনো তুলতুলে দুটি পা। একটা দীর্ঘ শ্বাস নেমে আসে। হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার আঙিকে।

শীতল পানিতে থালা-বাটির দিনপাত আর এক জোড়া ছোট হাতে ধাতবের কড়াঘাতের অন্যরকম গল্পটা দুঁফোটা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল আলেয়ার চোখ হতে। “রতন,বাপ উঠ্। সক্কাল হইয়া গেছে। ” দুচোখ কচলাতে কচলাতে ছেলের বিস্ময় মাখা দৃষ্টি। “ওকি মা তুমি কান্দ কেন?” “কান্দি না বাজান, চোহে কি জানি পড়ছে।

” সরল বিশ্বাসে গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে যায় রতন। পেছন থেকে তার এগিয়ে যাওয়া দেখে, আর মুগ্ধ হয় আলেয়া। কি অদ্ভুত সুন্দর। “মা আইজকা আমার আইতে একটু দেরী হইব। আইজকা আমরা হগলে মিলা নদীর ধারে খেলতে যামু।

” “আইচ্ছা বাজান। কিন্তু বেশি দেরী করিস না। আর সাবধানে থাকিস। পানিতে নামবি না একদম। ” “আইচ্ছা মা।

আমি যাই। ” বলেই বেরিয়ে পড়ল রতন। এখন সে আগে যাবে মানিকের খোঁজে। তারা দুইজন একসাথে কাজ করে। বয়স আর শারীরিক ক্ষমতায় অন্যদের সাথে পাল্লা দিতেই এই জোট।

দুজন মিলে করলে পরিশ্রম কিছুটা কম হয়। যদিও টাকা ভাগ করে নিতে হয়। তাও এটাই ভালো তাদের জন্য। তাছাড়া ওরা আলাদা কাজ করলে কেউ তাদের কাজে নেয় না। কিছুদূর এগোতেই মানিককে দেখা গেল।

“মানিক,আইছ দোস্ত। চল আগাই। ” “আইজকা গাও,হাত-পা কেমুন জানি ম্যাজ ম্যাজ করতাছে। ” “লও একটা দৌড় দিয়া যাই। গতরের ম্যাজ ম্যাজানী কইমা যাইব।

” আধো আলো আধো অন্ধকারে রদ্ধশ্বাসে ছুটছে ছোট ছোট দুটি প্রাণ। গন্তব্য শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত নদীর উপর দিয়ে ইস্পাত দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্রীজ। “মানিক মনে লয় আইজকা আমরা দেরি কইরা ফালাইছি। দেখ সবাই আইসা পড়ছে। এহন আবার তো লাইনে হগলের পিছে খাড়ান লাগবো।

” “তাই মনে হইতাছে। ” হাঁপাতে হাঁপাতে দুজন এসে দাঁড়ায় লাইনে সবার শেষে। “এই পোলা লাইন ঠিক কইরা খাঁড়া। পাশাপাশি খাড়াইছস কে?আগে পিছে কইরা খাঁড়া। ” “আমরা দুইজন এক লগে।

” “একলগে হ আর আলাদা। সিরিয়াল ভাঙবি না কইলাম। নইলে খবর আছে। ” রতন মানিক চুপ চাপ রাস্তার পানে তাকিয়ে থাকে। এখনো অনেক ভোর।

আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে তাদের। ট্রেনের সময় প্রায় হয়ে আসলে বলে। এখনি ঝাকে ঝাকে রিক্সা আসতে শুরু করবে। “স্যার ঠেলা লাগবে স্যার? দিই স্যার?” “তুই পারবি না। তুই দিস না।

” “স্যার আমরা দুইজন আছি। দুইজন মিইলা দিমু স্যার। দিই স্যার? ও মানিক চাইয়া আছস ক্যা? হাত লাগা?” “আরো জোরে রতন। ” “আরো জোরে মানিক। ” রতন মানিকের হাত টনটনে ব্যাথা করছে।

উবু থুবু পাথরের কনায় পা আটকে আটকে যাচ্ছে। তাও তারা সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে যাচ্ছে। ব্রীজের মাঝপথ এসে গেল বলে। মাত্র দুটি টাকার আশায়। পূবের আকাশে স্মিত আলোর ছোঁয়া।

আরেকটা সুন্দর সকাল। হয়তোবা আলোকিত আমার দেশ!!! [ওই সমস্ত শিশুদের স্মরনে যারা সিলেটের কিন ব্রীজে এই অমানবিক কাজ করে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে। ছবিঃ শাহাবুদ্দিনের বিখ্যাত গতি সিরিজের একটি। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।