আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ৬

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ৬ ------------------------------------------------ ডঃ রমিত আজাদ (পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে) প্রিয় পাঠকবৃন্দ গত পর্বে লিখেছিলাম যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু রহস্য বিশ্লেষণ করার পূর্বে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। ১। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী ২। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অতিদূর থেকে আমি যেমন দেখেছি ৩। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান।

৪। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন। ৫। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি। ৬।

মাওলানা ভাষাণী ও জিয়াউর রহমান ৭। জিয়াউর রহমানের সীমাবদ্ধতা। ৮। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। এর মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত আমি গত পর্বে আলোকপাত করেছিলাম।

এই পর্বে পরবর্তি কিছু বিষয় আলোকপাত করছি। তবে তার আগে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যেটি গত পর্বে পাঠকের দাবী ছিলো। সেটি হলো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সেনাপ্রধান নিয়োগ বিষয়টি। ১৯৭২ সালের মধ্য এপ্রিলে বাহিনী প্রধানগণের পদবী পরিবর্তন করে চীফ অফ আর্মি স্টাফ, চীফ অফ নেভাল স্টাফ, চীফ অফ এয়ার স্টাফ ধার্য করা হয়। প্রথম সেনাপ্রধান বা চীফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন ব্রিগেডিয়ার কে, এম, শফিউল্লাহ্।

ডেপুটি চীফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। এখানে একটি অসঙ্গতির সৃষ্টি হয় যার প্রভাব সেনাবাহিনীতে পরে। অসঙ্গতিটি হলো সিনিয়ারিটি অনুযায়ী জিয়াউর রহমান (হেলাল-ই-জুরাত ও বীর উত্তম) শফিউল্লাহ থেকে সিনিয়ার যদিও উভয়েই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীর ১২তম লং কোর্সের সহপাঠী বা কোর্স মেইট। কিন্তু একাডেমী সমাপান্তে দক্ষতার ভিত্তিতে সিনিয়ারিটির যে ক্রম দেয়া হয় তাতে জিয়াউর রহমান উর্ধ্বে ছিলেন। এই সেনাপ্রধানের নিয়োগটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে।

তবে নিঃসন্দেহে কারো না কারো সাথে আলোচনা করে। যারা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেনারেল এম, এ, জি, ওসমাণী। কি কি কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে এর পিছনে? ১। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের পর যখন সারা দেশের সকল সেনানিবাসের বাঙালী সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরে, তখন তারা ছিলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কোন সেনানিবাসে কেমন অবস্থা? সারা দেশে কি হচ্ছে? সামগ্রীকভাবে কি করণীয় হতে পারে? বিষয়গুলো স্পষ্ট ছিলোনা।

সেই সময়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে মেজর জিয়ার ঘোষণা সকলের বুকে সাহসের ও হৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার করে। সেই সাথে তারা পেয়ে যান দিক নির্দেশনা। সেই কারণে জিয়াউর রহমান জনমানসে ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন, ২। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার হিসাবে অভূতপূর্ব সাফল্য প্রদর্শন করেছিলেন। এই মর্মে তিনি সুপরিচিত ও জনপ্রিয়, ৩।

১৯৭১-এর জুলাই মাসে যুদ্ধ পরিচালনা প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান ও জেনারেল ওসমাণীর মধ্যে মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়েছিলো, অর্থাৎ জিয়াউর রহমান স্বাধীনচেতা, ৪। উপরের তিনটি সূত্রের প্রেক্ষাপটে যদি জিয়াউর রহমান-কে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে জিয়াউর রহমান-এর অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সব বিচার করে জিয়াউর রহমানকে নিয়োগ না দিয়ে প্রাধান্য-বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব নয়, নতজানু ও কম পরিচিত শফিউল্লাহ-কেই নিয়োগ দেয়া হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী (৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালের পর থেকে) বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর অত্যন্ত ঘটনাবহুল, তাৎপর্যপূর্ণ আবার একই সাথে রহস্যময় ও ঘোলাটে। আমি নিজের আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেট সোর্স থেকে পড়ালেখা করেছি।

ঘটনার কাছাকাছি বা অনতিদূরে ছিলেন এমন ব্যক্তিদের সাথে কথাবার্তা বলেছি। যা পড়েছি, জেনেছি ও শুনেছি তার কিছু নীচে উল্লেখ করলাম। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইলো, তথ্যে গড়মিল পেলে রেফারেন্সসহ আমাকে জানাবেন। বিপ্লবের পর প্রতি-বিপ্লব আসে (অথবা প্রতি-বিপ্লবের পর বিপ্লব আসে) অভ্যুত্থানের পর পাল্টা অভ্যুত্থান আসে। ইতিহাসের ধারা তাই বলে।

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া-ক্রিয়া এটাই মোটামুটিভাবে প্রকৃতির নিয়ম। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পর পাল্টা একটা কিছু ঘটার সম্ভাবনাই ছিলো। শেষ পর্যন্ত সেটা ঘটলো ৩রা নভেম্বরে। ঘটালেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, তার প্রধান সহযোগী ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্ণেল শাফায়াত জামিল। কর্ণেল শাফায়াত জামিলের সহযোগীতা ছাড়া কোন কিছু ঘটানো ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ-এর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।

কারণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে সৈন্য লাগে, ভয় দেখাতে সৈন্য লাগে, শাস্তি দিতে সৈন্য লাগে, নিরাপত্তা দিতেও সৈন্য লাগে। অপরপক্ষে কর্ণেল শাফায়াত জামিলের পক্ষেও একা কোন কিছু করা সম্ভব ছিলনা যদিনা ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন সহযোগীতা করে। ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর ছিলেন মেজর হাফিজউদ্দিন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পূর্বে একদল রাজনীতিবিদের সাথে আলোচনা করেন, এদের বেশীরভাগই ছিলো বামপন্থী। ২৪শে অক্টোবর ১৯৭৫ তারিখে মেজর হাফিজউদ্দীনের বাসায় খালেদ মোশাররফ ও কর্ণেল তাহেরের মধ্যে আলোচনা হয়।

৪৬ ব্রিগেডের অধীনস্থ তিনটি ব্যাটালিয়ান ছিলো ১ম, ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তাদের অধিনায়করা ছিলেন লে, কর্নেল মতিউর রহমান, লে, কর্নেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম, লে, কর্নেল আমিনুল হক বীর উত্তম। কর্ণেল শাফায়াত জামিল যখন এই ব্যটালিয়ন কমান্ডারদের কাছে তার অভ্যুত্থানের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তখন লে, কর্নেল মতিউর রহমান পূর্ণ সমর্থন জানান, কিন্তু লে, কর্নেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম, লে, কর্নেল আমিনুল হক বীর উত্তম-এর কাছ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়না। অবশেষে ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫-এ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ-এর নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ঢাকা মহানগরে অনুগত সৈন্যের প্রাধান্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

রংপুর সেনানিবাস থেকে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মহা জরুরী ভিত্তিতে যুদ্ধসম প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকা মহানগরে আনা হয় এবং শেরে বাংলা নগরে স্থিত করা হয়। ৩ রা নভেম্বর ১৯৭৫ : রাত ১২ টার সময় বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১ম বেংগল রেজিমেন্টের মেজর ইকবাল তার অধীনস্থ কোম্পানীর ৩০০ সৈন্য নিয়ে বংগভবন থেকে সরে যান। রাত সাড়ে ১২ টায় ৪ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল আমিনুল হক কে নিষ্ক্রিয় করে ইউনিটটির নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। রাত ৩ টায় জিয়াকে বন্দী করা এবং ল্যান্সার ইউনিটকে নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য অপারেশন শুরু হয়। ক্যাপটেন হাফিজ উল্লাহকে পাঠানো হয় জিয়াকে প্রোটেকটিভ কাস্টোডীতে রাখার জন্য।

জিয়ার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ একটি ভুল করেন। তিনি ভুলে যান বেডরুমেও একটি টেলিফোন আছে। ভোর সাড়ে ৪ টায় খালেদা জিয়া মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন কে ফোন করে জানান জিয়াকে বন্দী করা হয়েছে। আনুমানিক এই সময়েই জেলহত্যাকান্ড ঘটে যতদূর জানা যায় খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলহত্যাকান্ড ঘটায়।

নিহত হন তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান। উনারা চারজনই বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির অপর তিন সদস্য ১৫ ই আগস্টেই নিহত হয়েছিলেন। সেসময় তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলামের পাশের সেলে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। স্কোয়াড্রন লীডার লিয়াকতের কমান্ডে ২ টি মিগ এবং একটি হেলিকপ্টার মিসাইল লোডেড হয়ে বংগভবনের উপর চক্কর দিতে থাকে।

কর্নেল শাফায়াত জামিল সাভারে রেডিও বাংলাদেশের একটি ট্রান্সমিটার অচল করে দেন। নভেম্বর ৩ , দুপুর ২ টায় জিয়া সেনা প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। জিয়ার কাছ থেকে পদত্যাগ পত্র নিয়ে আসেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক স্ফূর্ততার সাথে খবরটি প্রচার করা হয়েছিলো। সকাল থেকে আত্নসমর্পনের প্রস্তাব পাঠিয়ে সন্ধ্যার দিকে সমঝোতা হয় যে খালেদ শাফায়াতরা ফারুক-রশীদদেরকে দেশ ত্যাগ করতে দেবেন।

রাত ৮টা ৪৫ এ ফারুক-রশীদরা ঢাকা ছেড়ে যায় ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭৫: সকাল ১১টায় খালেদ মোশাররফ বংগভবনে যান খন্দকার মোশতাকের সাথে বোঝাপোড়া করার জন্য। সন্ধ্যা ৬ টায় শাফায়াত জামিল ৩ জন অফিসারকে সংগে নিয়ে বংগভবনে যান। একটি উত্তপ্ত পরিস্হিতি তৈরী হয় সেখানে। সেখানে তখন মোশতাক সরকারের কেবিনেট মিটিং চলছিলো।

এ সময় খালেদ দাবী করেন তাকে অবিলম্বে সেনা প্রধান করতে হবে। ডিফেন্স অ্যাডভাইসার জেনারেল ওসমানী বলেন নতুন সেনা প্রধান নিয়োগ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এতে খালেদ এবং তার সংগের অফিসাররা রেগে যান এবং হুমকী-ধামকী-বাদানুবাদ চলতে থাকে। মোশতাক মেজাজ দেখিয়ে বলেন : " আমি পাকিস্তান আর্মির অনেক জেনারেল , ব্রিগেডিয়ার দেখেছি....আমাকে ভয় দেখাতে আসবেনা...." এসময় মেজর ইকবাল মোশতাকের দিকে গান পয়েন্ট করলে ওসমানীর মধ্যস্ততায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। সেই ঘটনায় মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

সিদ্ধান্ত হয় পার্লামেন্টের স্পীকার কিংবা চীফ জাস্টিস হবেন প্রেসিডেন্ট। এসময় মুজিব কেবিনেটের মন্ত্রী ইউসুফ আলী এসব সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন। মনোরন্জ্ঞন ধর দাবী করেন প্রেসিডেন্ট হবেন স্পীকার মালেক উকিল যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর মন্তব্য করেছিলেন : 'ফেরাউনের পতন হয়েছে.....' উল্লেখ্য যে এই মালেক উকিল পরবর্তিতে আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। পদত্যাগের আগে খালেদ মোশাররফের মেজর জেনারেল র্যাং ক সহ চীফ অব স্টাফ প্রমোশন ফাইলে মোশতাক ইনিশিয়াল দিয়ে যান। বলা যায় বাধ্য করা হয়।

রাত ১১ টায় বাংলাদেশ রেডিও থেকে ঘোষনা করা হয় খালেদ মোশাররফ নতুন সেনা প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ৫ ই নভেম্বর ১৯৭৫ : সন্ধ্যায় খালেদ মোশাররফ , এম জে তাওয়াব , এম এইচ খান এবং শাফায়াত জামিল বিচারপতি সায়েমের সাথে দেখা করে তাকে প্রেসিডেন্ট হতে রাজি করান। রাত ১০টায় ৩ চীফ বংগভবনে গিয়ে মোশতাকের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেন , সাড়ে ১১ টায় মোশতাক বংগভবন থেকে ২ মাস ২০ দিনের শাসন শেষে আগামসিহ লেনের বাড়ীতে ফিরে যান। ৫ই নভেম্বর ১৯৭৫ রাতে ঢাকার গুলশানে ইন্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দিকের বাসায় গোপন মিটিং-এ বসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। (মিশ্র কথন, পৃঃ ১৭৩)।

সেখানে ছাপানো লিফলেট দেয়া হয়, সেখানে শেষে লেখা ছিলো ‘জে, এস, ডি, জিন্দাবাদ ও গণবাহিনী জিন্দাবাদ’। তারা এই লিফলেট সেনানিবাসে বিতরণ করলো। ৬ ই নভেম্বর : সকাল ৯ টায় জাস্টিস সায়েম দেশের ৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ১১ টার সময় ফরমেশন কমান্ডারদের নিয়ে খালেদ কনফারেন্স করেন। খালেদের অভ্যুত্থানে খুব তাল দিলেও কুমিল্লা ব্রিগেডের কর্নেল আমজাদ হোসেন দরকারের সময় নাচেননি।

খালেদের কনফারেন্সে আমজাদ উপস্থিত থাকলেও কুমিল্লা থেকে কোন ব্যাটালিয়ন আসেনি। ৬ ই নভেম্বর যশোর ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত বিমানযোগে ঢাকা আসেন ঢাকায় রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। খালেদের কনফারেন্সে মীর শওকত ও ছিলেন। মীর শওকতের বিমানে সহযাত্রী ছিলেন পরবর্তীতে সেনা প্রধান আতিকুল হক। ৬ ই নভেম্বর বিকাল ২টায় ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে কর্ণেল তাহেরের বড় ভাই সার্জেন্ট (বিমানবাহিনী) আবু ইউসুফ-এর বাসায় কর্ণেল তাহের, আবু ইউসুফ, আনোয়ার, বেলাল, বাহার, গণবাহিনী ও জে,এস,ডি-এর নেতৃবৃন্দ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা-র নেতৃবৃন্দ গোপন মিটিং করে।

সৈনিকদের কেউ কেউ প্রশ্ন করে, "আমাদের নেতা কে? আমরা কার নামে শ্লোগান দেব?" সে সময় জাসদ নেতৃবৃন্দ আশা করেছিলো, সৈনিকরা কর্ণেল তাহেরের নাম বলবে। কিন্তু তাদেরকে হতাশ করে দিয়ে, সৈনিকদের সকলেই একবাক্যে বললো, "জেনারেল জিয়া আমাদের চীফ অফ স্টাফ, তিনিই আমাদের নেতা, আমরা তাঁর নামেই শ্লোগান দেব। " তাহেরের নাম না বলায় তাহের নিজেও হতাশ হয়ে পড়লেও সৈনিকদের দাবীর মুখে উনার আর কিছু বলার ছিলো না। ৬ ই নভেম্বর শাফায়াত জামিল তাহেরের বিপ্লবী সেনা সংস্থার লিফলেট গুলো সম্পর্কে জানতে পারেন। এই লিফলেটগুলোর মাধ্যমে সেনাদেরকে খালেদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা হয়েছিলো।

প্রচার করা হয়েছিলো খালেদ ভারতের চর। সৈনিকদের মধ্যে আগে থেকেই ভারত বিরোধিতা ছিলো। তারা মনে করতো, ভারত শক্তিশালী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চায়না। তারা চায় বাংলাদেশের উপর চিরস্থায়ী কর্তৃত্ব করতে। শক্তিশালী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থাকলে এটা সম্ভব না।

৬ই নভেম্বর মাগরীবের নামাজের পর মেজর (পরবর্তিকালে মেজর জেনারেল) ইব্রাহীম বীর প্রতীক (বর্তমানে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান)-এর দেখা হয় মেজর হাফিজউদ্দীন ও ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের সঙ্গে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গেটে । তারা মেজর ইব্রাহীমকে জানান যে, সেনানিবাসে যে রাজনৈতিক প্রচারনা চলছে সেটা সত্য। একটি লিফলেটও হাতে পাওয়া গেলো। সেই লিফলেটের একটি কথা ছিলো, 'সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই'। এটা অফিসারদের মনে উদ্বেগের সঞ্চার করে।

মেজর হাফিজ উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন তাজুল নিরাপত্তার কারণে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় খালেদ শাফায়াতকে সংগে নিয়ে ট্যাংক রেজিমেন্টে যান সৈনিকদের শান্ত করতে। রাত ১০ টায় খালেদ শাফায়াতকে বংগভবনে যেতে বলেন। ঠিক তখুনী মেজর হাফিজ [ বর্তমানে ভোলার বিএনপি নেতা, সাবেক সংস্কারপন্থী ] শাফায়াতকে জানান রাত ১২ টায় সেনা বিদ্রোহ ঘটার আশংকা। রাত ১১: ৩০ নাগাদ ৩ বাহিনী প্রধান এবং শাফায়াত সিএমএলএ কে হবেন সেটা নিয়ে মুসাবিদা করছিলেন।

খালেদ সেদিন রাতে কর্ণেল হুদা [ ব্রিগেড কমান্ডার / রংপুর ৭২ ব্রিগেড ] এবং হায়দারকে [ সিও / ৮ম ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট ] সাথে নিয়ে বংগভবনে আসেন তাওয়াব এবং এম এইচ খান চাইছিলেন ৩ বাহিনী প্রধান হবেন ডেপুটি সিএমএলএ এবং প্রেসিডেন্ট হবেন সিএমএলএ..... আর খালেদ চাইছিলেন নিজে সিএমএলএ হতে। সেনানিবাসের ভিতরে অনেক অফিসারের মত মেজর (পরবর্তিতে মেজর জেনারেল) ইব্রাহীম জে,সি,ও, এবং অফিসারদের বুঝিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ ৩রা নভেম্বরের বিদ্রোহের পক্ষে আর বিশাল বাকী অংশটি জেনারেল জিয়ার পক্ষে ও তার মুক্তি চায়। রাত ১২ টা নাগাদ মিটিং চলা কালে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোন আসে সিপাহী বিপ্লব ইগনাইট হওয়ার। মধ্যরাত্রিতে সেনানিবাসে গোলাগুলি ও শ্লোগানের আওয়াজ শুরু হয়। সাথে সাথে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের লাইন ত্যাগ করে মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা পার হয়ে বেড়াইদ মুসলিম হাইস্কুলে আশ্রয় গ্রহন করে।

৭ ই নভেম্বর ১৯৭৫ঃ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিকরা ভাবতে শুরু করে, 'আমরা কেন এখানে পড়ে আছি?' তারপর সাধারণ সৈনিকরা দলগতভাবে সেনানিবাসে ফিরে আসে। রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে, কর্নেল মতিউর রহমান শীতলক্ষ্যা নদীর পারে মুরাপাড়া গ্রামে তার শ্বশুর বাড়ীতে আশ্রয় নেন। খ্যাতিমান সাংবাদিক নির্মল সেন তাঁর কলামে লিখেছিলেন - '৬ নভেম্বর প্রেসক্লাবে জাসদের এক সাংবাদিকের সাথে দেখা হলো। সে বলল আজ রাত বারোটার সময় আপনি গুলির শব্দ শুনতে পাবেন। তার পর কি হবে পরে বুঝতে পারবেন।

সত্যি সত্যি পরবর্তীকালে সব বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু কোনদিনই এ ব্যাপারে একমত হইনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে। এরা একটি পিপল মিলিশিয়া গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকল। তাদের বক্তব্য ছিল স্বাধীন দেশে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানী ধাঁচে সেনাবাহিনী কেন থাকবে।

আগের সব ধারা পাল্টাতে হবে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল তাহের (যার কথা লিখতে হলে অনেক কিছুই লিখতে হবে)। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বক্তব্য হচ্ছে-১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সেনাবাহিনীতে নেতৃত্বের লড়াই শুরু হয়েছে। এত রক্তপাত হবে। স্বাধীনতা – সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।

সুতরাং তারা বিদ্র্রোহীর ভূমিকা পালন করবে। দেশে একটি স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে। রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়তে হবে। এদের সেই বিদ্র্রোহ শুরু হবার কথা ছিল ৬ নভেম্বর রাত ১২টায়।

১২টায় সঙ্কেত দেয়ার পরেই বিদ্র্রোহ শুরু হবে। কিন্তু নির্ধারিত নেতা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় ঐ সঙ্কেত দানের সময় পিছিয়ে যায়। তখন ৬ নভেম্বর রাত ১২টার পর ৭ নভেম্বর শুরু হয়। আমরা ৭ নভেম্বর রাত তিনটায় এক ঘোষণা শুনলাম বেতারে। ঘোষণায় বলা হলো, আজ মধ্যরাত থেকে সারা দেশে সিপাহী – জনতার অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনী ও ছাত্র, যুবক.শ্রমিক সম্মিলিতভাবে দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে বিপ্লবী অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের সকল সেনানিবাসের সৈন্য, বিডিআর, পুলিশ, ছাত্র.জনতা এবং সকল স্তরের মেহনতি মানুষের প্রতি আমাদের আহ্বান – প্রত্যেকে স্ব স্ব এলাকায় শান্তি – শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। এবং নিকটস্থ গণবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুন। ' http://projonmoblog.com/riddha/15967.html জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দি হয়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীর যে সকল সিনিয়ার অফিসার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিলেন তারা মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তাদের প্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুক্তি কামনা করছিলেন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।

যেটা একটা দেশের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ। তাছাড়া ৩রা নভেম্বর থেকে ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ কার্য্যত সরকারবিহীন ছিলো। সৈনিক অসৈনিক প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকই বুঝতে পারছিলো যে, অবিলম্বে দেশকে এই অভিশাপ মুক্ত করে সেনাবাহিনীতে ঐক্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এর জন্য যেটা সবার আগে করা প্রয়োজন ছিলো তাহলো তাদের মধ্যে সব চাইতে বেশী প্রভাব বিস্তারকারী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা। একমাত্র তিনিই পারবেন দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।

তাই ৬ই নভেম্বর রাত বারোটার পর ৭ই নভেম্বর প্রথম প্রহরে বিপ্লব শুরু হয়। এতে স্বল্প সংখ্যক বিপ্লবী সৈনিক পরিষদের সদস্য ছাড়াও অজস্র নিরপেক্ষ সৈনিক যোগ দেয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা। অল্প সময়ের মধ্যেই একটি জনসমুদ্র জিয়াউর রহমানের বাসভবনের দিকে এগিয়ে যায়। মেজর জেনারেল ইব্রাহীম ৭ই নভেম্বর দিনে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন এরকম - সবদিকে মিছিল, প্রচুর সেনাবাহিনীর গাড়ী চলাচল করছে সৈনিক ও জনগণকে নিয়ে, অন্য বাস ও ট্রাকও জনগণকে নিয়ে চলাচল করছে মিছিলের মত, সবদিকে উচ্ছল পরিবেশ, জেনারেল জিয়ার অনুকূলে প্রচুর শ্লোগান ও মাঝে-মধ্যে ভারত বিরোধী শ্লোগান।

এবার ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবতে থাকে তারা একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা; অতএব তাদের কপালে কি আছে? ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কি ঘটেছিলো ঐ দিন? কারা ঘটিয়েছিলো সেই কাউন্টার ক্যু? সিপাহী বিপ্লব কি? বিপ্লবী সৈনিক পরিষদ কি? কি লেখা ছিলো বারো দফায়? কি ভূমিকা ছিলো কর্নেল তাহেরের? নিরিহ-নিরাপরাধ অফিসারদের কেন হত্যা করা হয়েছিলো? ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই চৌকষ অফিসারদের বিরুদ্ধে এতো আক্রোশ কার থাকতে পারে? কারা মুক্ত করেছিলো জিয়াউর রহমানকে? বরাবরের অনুগত সৈনিকদের একটা অংশ হঠাৎ এত উশৃংখল হয়ে উঠলো কেন? সহজ-সরল সৈনিকদের কেউ কি উশকে দিয়েছিলো? উশৃংখল সৈনিকদের কে শান্ত করেছিলো? কি ঘটেছিলো তার পরে? কি কি রাজনৈতিক আদর্শ-মতাদর্শ কাজ করেছিলো সেখানে? আন্তর্জাতিক প্রভাব সেখানে কাজ করেছিলো কি? এমন হাজারটা প্রশ্ন রয়েছে ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫-কে ঘিরে। (চলবে) তথ্যসূত্রঃ ১। মিশ্র কথন - মেজর জেনারেল ইব্রাহীম বীর প্রতীক ২। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্ণেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি" ৩।

সামুতে দাসত্ব-এর ব্লগ ৪। বিভিন্ন বই ৫। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ৬। বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ৫ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.