আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা (১৯৭৫-১৯৮১) একটি প্রামাণ্য দলিল

রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে
আনোয়ার কবিরকে চিনি ১০ বছর হলো। তার ব্যাপক আগ্রহ একটি বিষয়তেই। আর সেটি হল সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা। সন্দেহ নেই আগ্রহটি বিপজ্জনক। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে অনেক ধরণের ঘটনা ঘটেছে।

সেগুলো অনেকেই কম বেশি জানা। লেখালেখিও কিছু কিছু হয়। কিন্তু কেউ একজন যদি দিনের পর দিন লেগে থেকে একটি আস্ত প্রামান্য চিত্র তৈরি করে ফেলে তাহলে এর পরিণতি কি হতে পারে বোঝা মুসকিল। আনোয়ার সেই কাজটিই করেছে। সে অনেক খেটেখুটে একটা প্রামান্য চিত্র তৈরি করেছে।

নাম সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা, বাংলাদেশ ১৯৭৫-১৯৮১। মোট ১০ ঘন্টার প্রামান্য চিত্র। চারটি পর্ব। মূলত অনুসন্ধান ও সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি বিশাল মাপের কাজ। প্রথম পর্ব কর্নেল তাহেরের ফাঁসি নিয়ে।

ঘটনাটি সবারই জানা। এই পর্বটি প্রায় ৩ ঘন্টার। ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের পুরো কাহিনী সহ কর্ণেল তাহেরে ফাঁসি পর্যন্ত পুরো ঘটনা জানা যাবে এই পর্বে। বিচারের নামে যে প্রহসন হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনাও আছে এখানে। উপরি পাওনা হচ্ছে কর্ণের তাহের চিঠিগুলো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে কর্ণেল তাহেরকে যে আইনের আওতায় মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় সেই আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধানই ছিল না। ফাঁসি হওয়ার পর এই বিধানটি যোগ করা হয়। অনেক নতুন নতুন তথ্য রয়েছে এই পর্বে। বিশেষ করে একই সঙ্গে জেলে থাকা মেজর জিয়ার সাক্ষাৎকারটি অনেক অজানা তথ্য দেয়। দ্বিতীয় পর্ব সবচেয়ে নির্মম।

১৯৭৭ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। অনেকেরই হয়তো মনে আছে ৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাপান এয়ারলাইনস এর একটি বিমান হাইজ্যাক করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল রেড আর্মি নামের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। এই সময় বিমানবন্দরে ব্যস্ত ছিল সবাই এই ঘটনা নিয়ে। আর এর মধ্যেই ঘটে এক অভ্যুত্থানের ঘটনা। ১ অক্টোবর রাত থেকে শুরু হয়েছিল।

বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট আফসারকে এই অভ্যুত্থানের মূল লোক বলা জানা যায়। যদিও সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কেউ কেউ এর সাথে ছিলেন। প্রমান্য চিত্রে একজন বললেন যে মে.জে, মীর শওকত তাদের সাথে থাকবেন বলে তারা জানতেন। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ঠিক কতজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তার কোনো হিসেব নেই। বলা হয় সংখ্যাটি কমপে ১১শ থেকে ১৪শ পর্যন্ত হবে।

মাত্র দুই দিনের বিচারে এতো লোকের ফাঁসি হয়েছিল। বিচারের নামে হয়েছিল বড় ধরণের প্রহসন। পুরো বিষয়টি খুব ভালো ভাবে বোঝা যায় প্রমান্য চিত্রটিতে। শুরুতে একজনের দীর্ঘ বয়ান। তিনি জানান পুরো ঘটনাটি।

এতোটা নৃশংস আচরণ করেছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরা যা বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। জড়িত ছিল কিনা সে প্রমান কেউ নেইনি। যারা যারা কাছাকাছি ছিল সকলকেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। এমনকি পিটিয়ে মারার ঘটনাও আছে বলে একজন জানালেন। এদের দেওয়াও হয়েছে গণ কবর।

নানা ধরণের মানুষের বর্ননায় পুরো বিষয়টি চলে আসে। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর যিনি একটি ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি জানান যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া তাদের ডেকে বলে দিয়েছিল, শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সবাইকে জবাই করো। সেটাই করা হয়েছিল। তৃতীয় পর্ব জিয়া নিহত হওয়ার পরের ঘটনা নিয়ে। ১৩ মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হয়েছিল সে সময়।

আজ অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এরা সকলে জড়িত ছিল না। এরশাদ ষড়যন্ত্র করে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মেরে ফেলেছিল। এ ক্ষেত্রেও বিচারের নামে হয়েছিল প্রহসন। এই বিচার পর্বের নানা জানা-অজানা দিক নিয়ে এই পর্ব। বিশেষ করে কোর্ট মার্শালের সময় অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবি হিসেবে কাজ করা মেজর জেনারেল আইন উদ্দিন ও ইব্রাহিমের দুটি সাক্ষাৎকার এবং তদন্ত কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আজিজুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার অনেক অনেক তথ্য দেয়।

আজিজুর রহমান স্পষ্ট করেই বলেছেন যে জিয়া হত্যাকান্ড যাতে ঘটে সে জন্য সব ধরণের ব্যবস্থাই করে দেওয়া হয়েছিল। পুরো বিষয়টিই ছিল সাজানো। মে. জে. ইব্রাহিম বলেছেন একজন অফিসার যে আরেক অফিসারেকে এভাবে নির্মম ভাবে অত্যাচার করতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। চতুর্থ পর্ব জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকান্ডসহ আনুসাঙ্গিক বিষয় নিয়ে। সেনা হেফাজতে মঞ্জুরকে মেরে ফেলা হয়েছিল।

এটাও ছিল এরশাদের আরেক ষড়যন্ত্র। শুরুতেই মেজর রেজার একটি দীর্ঘ বক্তব্য রয়েছে। তিনি শেষ সময় পর্যন্ত জেনারেল মনজুরের সঙ্গে ছিলেন। তিনি অনেক কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। জিয়া হত্যার পর থেকে পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

এটাই নাকি তার দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার। পুরো ঘটনা জানা যায় তার জবানিতে। তিনি বলেছেনও অনেক বিস্তারিত ভাবে। যেমন মেজর মুজিব তাকে বলে দিয়েছিলো যে এরশাদের নির্দেশেই মনজুর কে মেরে ফেলা হয়েছিল। কি ভাবে এবং কে মেরেছিল মনজুরকে তারও বর্ণনা আছে।

মেজর রেজার বক্তব্য থেকে অনেক গোপন তথ্যই জানা যায়। পুরো প্রমান্য চিত্রকে বেশ কিছু দুর্লভ দলিল ও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে অসংখ্য সাক্ষাৎকার। যারা এসব নিয়ে আগ্রহী তাদের জন্য অত্যন্ত ভাল একটা কাজ করেছে আনোয়ার কবির। জেনেছি যে, প্রমান্য চিত্রটি তৈরির কাজ শেষ হয়েছে বছর খানের আগে।

কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রকাশ করা হয়নি। পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। এখনো আছে কিনা তাও নিশ্চিত না। সশস্ত্র বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার এই দলিলের প্রচার কারো কারো ভাল নাও লাগতে পারে। তবে ইতিহাস ইতিহাসই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অতীতের গোপনীয় দলিল এখন প্রকাশ করছে। বাংলাদেশেও এগুলো করা দরকার। এমন দাবিও উঠেছে যে, কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া ছিল যে ভুল সেটিও এখন রাষ্ট্রের স্বীকার করা উচিৎ। চার খন্ডের এই প্রমান্য চিত্র সবাইকে ভাবাবে।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.