আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"বন্ধনের জন্য ভালবাসা" দ্বিতীয় পর্ব

মকারম ভবনের গেটে ঢুকে দেখলাম বেশ কিছু ছেলে জটলা করে আছে একটা রুমের সামনে। পরিচিত দু-একটা মুখ দেখে বোঝা গেল, এই হচ্ছে ফার্মেসী প্রথম বর্ষের ক্লাস রুম। আর এই ছেলে গুলি আমার আগামী দিন গুলির সঙ্গী। উৎফুল্ল হবার মত কোন মেয়েকে দেখলাম না। এগিয়ে যেতেই এক ছেলে এসে বলল, “তুমি কি নতুন? কি নাম তোমার?” যখন জানতে পারল, আমি মেডিকেল থেকে এসেছি, দিগন্ত ব্রিস্তিত এক হাসি দিয়ে বলল, “মেডিকেল থেকে আসছ কেন?? ওখানে তো অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে!!” “কেন এখানে এখানে সুন্দর মেয়ে নেই? পাল্টা প্রশ্ন আমার।

“আছে, তবে সব আফ্রিকা, জাম্বিয়া থেকে আসছে!!” একমাত্র হুজুর ছাড়া প্রথম বর্ষের বিবাহিত কোন ছেলেরও মন বিমর্ষ করে দেবার জন্য কথাটা যথেষ্ট। তবে একটু ভরসা পেলাম, যখন দেখলাম, সেই ছেলেটাই, আফ্রিকান-জাম্বিয়ান মেয়েদের ব্যাপারে সব থেকে বেশি আগ্রহী!! তাহলে আমাকে এই কথা বলল কেন?? এই কথাটা কখনও আমার বন্ধু, ক্লাস এর অতি জনপ্রিয় বন্ধু আসুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় এর গণ্ডি পেরিয়ে আমরা একসাথে চাকরীও করেছি দুই বছর। তবুও জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে সে তার কথা রেখেছে।

আমরা সহপাঠীদের প্রেমে পরে হাবুডুবু খেলেও সে অন্য জায়গায় পানি ঘোলা করেছে। ক্লাস এ প্রেম করেনি। একটা মানুষ নিজেকে বদলাতে পারে। তবে কতটুকু পারে, সেটা দেখবার জন্য আমার এই বন্ধুটিকে আইকন স্বরূপ রাখা যেতে পারে নিঃসন্দেহে। ফর্সা করে সুন্দর মত একটা ছেলে দেখলাম একদিন খুব ছোটাছুটি করছে, সবাই মিলে কি জেনো করা হবে।

সবার কাছে গিয়ে “ইয়ে, ইয়ে” বলে সবাইকেই মোটামুটি একসাথে করে ফেলেছে। আবার সেই ছেলেটাই দেখলাম একদিন চুল কোঁকড়া বানিয়ে ক্লাস এ আসলো !! চশমা ও নেই। আবার দুই এক দিন পরে দেখি চুল স্ত্রেত !! চোখে চশমা। ঘটনা টা কিরে ভাই !! পরে বোঝা গেল, দুই জন আসলে দুই ছেলে। তারা দুই বন্ধু।

দুই জনই ফর্সা, সুদর্শন। প্রথম এই দুই জনকে গুলিয়ে ফেললেও, এখন নিশ্চিত জানি, আরিফ আর তানভীর এর ছায়া দেখে আমি বলে দিতে পারব কে কোনটা। রাতের পর রাত কাটিয়েছি আমরা একসাথে। আমাদের ব্যাচটা তে আমরা সবাই মিলে যত আনন্দ করেছি, তার ৫০ ভাগ কৃতিত্ব পুরো ক্লাস এর, যারা অংশ নিয়েছে, আর ৫০ ভাগ কৃতিত্ব আরিফের একার। একটা মানুষ শুধু মাত্র বন্ধুদের জন্য, তাদের কে ভালো কিছু একটা দেয়ার জন্য, সবকিছু করতে পারে।

ও সব কিছুই আয়োজন করত। আমি চান্সে, স্টেজে উঠে উল্টা পাল্টা কথা বলে উপস্থাপক সাজার বার্থ চেষ্টা করতাম। কেউ ভদ্রতা করে প্রশংসা করলে আমি ৩২ দাত বের করে একটা হাসি দিতাম, আর সত্যি কথা বলে পচানি দিলে সুন্দর আরিফের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কেটে পরতাম। কোনদিন ই ও আমাকে কিছু বলত না। কখনই ওকে বলা হয়নি, কতখানি জায়গা বুকের ভেতরে রাখা আছে ওর জন্য, আমি জানি আমাদের ক্লাস এর সবাই আমার মত ভাবে।

হয়ত ওকে এখন কেউ বলে না। তানভীর নামের সুদর্শন ছেলেটা এখন সুদর্শন স্বামী হিসেবে অন্যদের স্ত্রী দের মাঝে হিংসার বীজ বপন করে চলেছে। ক্লাস এর সবচেয়ে প্রিয় পাত্র কে? “তানভীর”। । পরালেখায় ভালো কে?? “তানভীর” স্যার রা পছন্দ করে কাকে?? “তানভীর” স্টেজে গান গাবে কে?? “তানভীর” স্টেজ সাজাবে কে?? “তানভীর” নোট দিবে কে?? “তানভীর”... এবং সবার সামনে মল-মুত্র নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলবে কে?? সেটাও তানভীর!! শেষের কথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটা মানুষের মাঝে যদি মজার করবার মত কোন ব্যাপার না থাকে, তাহলে সে মানুষ না, গরুর মত পরোপকারী প্রানি।

তানভীর আসলে একটা পারফেক্ট ছেলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার এই প্রিয় বন্ধুদের সাথে আমার প্রথম বর্ষে খুব বেশি উথা-বসা ছিল না!! তার কারন হিসেবে যে মানুষটা, তার নাম হচ্ছে সোহাগ। কোন একটা বিচিত্র কারনে অপরিচিত মানুষের সাথে আমি একটু নাক উঁচা ভাব দেখানর চেষ্টা করতাম। সেইখানে আগুন দিয়ে দিল এই ছেলে। সে আমাদের নাক উঁচা বানাতে বানাতে গণ্ডারের নাক বানিয়ে ফেলল।

আমাদের বলার কারন, আরেকজন ও সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে গণ্ডার হয়ে গেল!! সে হচ্ছে নাইম। আমরা প্রতি ক্লাস এর শেষে বের হয়ে যেতাম। দূরে একটা দোকানে চা – সিগারেট খেতাম। আর ক্লাস এর ছেলেরা যে কত অর্বাচীন এইটা নিয়ে তুচ্ছ – তাচ্ছিল্য করতাম। সেই তুচ্ছ – তাচ্ছিল্য এর শিকার হল, ক্লাস এর ছেলে মেয়ে, শিক্ষক, এবং সর্বোপরি ক্লাস এর পড়ালেখা।

ভুল ভাঙল তখন, যখন দেখলাম, প্রথম বর্ষের রেজাল্ট এ আমি পিছন থেকে অনেক এগিয়ে আছি। আমার একটু পরে নাইম। আর সোহাগ মোটামুটি ১০ হয়ে বসে আছে। ওকে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর বলে গালাগালি করে কোন লাভ হল না। সে আগের মতই থাকল।

আমার আসল ভুল ভাঙতে অনেক সময় লেগেছিল। কোন ছেলে যে এত কম পরে এত ভালো করতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না। ও আসলেই পরালখা কম করত। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ত বলে হাতে গোনা দুই-তিন জন আছে আমাদের ক্লাস এ। তাদের মধ্যে নির্দ্বিধায় সে একজন।

এই ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ত অনেক অনেক বেশি নিবির। ওর বন্ধু সংখ্যা খুব বেশি না। আমরা অল্প কয়েকজন। ওর একটা কথা আমি সারাজীবন লালন করি, পালন করি। একদিন ও আমাকে বলেছিল, “দেখ, তুই যে আমার বন্ধু, এটাই সবকিছু।

এখন এটা আর কখনই ভাঙবে না। তুই যদি কোন দিন নিজেও ভাঙতে চাস, আমি ভাঙতে দিব না। “ তাই ওর সাথে দেখা না হলেও, কথা না হলেও আমি নিশ্চিন্তে থাকি। বিপদে পড়লে ওর কাছে যাই। আমাকে একবার ডাক্তার খুব ভয়ার্ত একটা অবস্থায় ক্যান্সার এর একটা টেস্ট করতে দিয়েছিল।

আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম সাথে। আমার বন্ধুকে। আমার নির্ভরতা কে। এবার একটু বলি, একটা রুপকথার গল্প। অনেক দূর থেকে আসা একটা ছেলে, যে থাকতো মেসে।

আমরা যখন নিজের বাসায় রাত জেগে আরাম করে পড়া লেখা করতাম, তখন সেই ছেলেটাকে রুমের বাতি নিভিয়ে রাখতে হত। মেসের নিয়ম। আমরা যখন ফাকিবাজ ছেলেরা মিলে আনন্দ করতাম, তখন সেও আমাদের সাথে থাকত। আমরা যখন, টি.এস.সি তে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিটি খেলতাম, তখন ও সে আমাদের সাথে বসে থাকত। কারো যখন কোন বিপদ হত, তখন সেও সেখানে ছুটে যেত।

তারপরও সেই ছেলেটা রেকর্ড মার্ক পেয়ে প্রথম হল। আমার আর নাইমের লাড্ডু হওয়ার কষ্ট অনেকখানি কমে গিয়েছিল, যখন শুনলাম যোবায়ের প্রথম হয়েছে। পড়ালেখার ব্যাপারে সবচাইতে বেশি জানে সে, রাজনীতির ব্যাপারে সব চাইতে বেশি জানে সে, ধর্মের ব্যাপারে সবচাইতে বেশি জানে সে। নিঃসন্দেহে ক্লাস এর সবচাইতে মেধাবী সে। নিঃসন্দেহে ক্লাস এর সব চাইতে ভালো ছেলেও সে।

ওকে যদি কেউ আতেল বলতে চায়, খুব বড় ভুল হবে। একুশের বই মেলায় তার বই আছে, “দ্রোহের নীল প্রহর” !! একটা ক্লাস এর প্রথম যে থাকে, প্রথমের মত হলেই তাকে মানায়। যে মুখস্ত করে বিদ্যা জাহির করবে না, যে অন্যকে বাঁশ দিয়ে প্রথম হবে না, যে পড়ালেখার ব্যাপারে কখনও স্বার্থপর হবে না। যে ক্লাস এর সব ব্যাপারে সামনের সাড়িতে থাকবে। যে অন্য সব দিক দিয়েও প্রথম হবে।

সর্বোপরি যে একজন ভালো মানুষ হবে। আমার এই বন্ধু একদম খাঁটি ফার্স্ট বয়। আমার অসম্ভব গর্ব হয় ওকে নিয়ে। গল্পটা শেষ করি একটা ঘটনা দিয়ে। আমি দেশ ছাড়ছি।

এয়ারপোর্টে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আমার হাত ধরে আছে। আমার মা কাদছে। হটাত ভিড় ঠেলে একটা ছেলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি অবাক হইনি। আমি জানতাম ও আসবে।

এই পৃথিবী যে শুধু আনন্দময় তা নয়। বহুবার ধূলি মাখা পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি পরে গিয়েছি, একা হতে হতে অসহায় হয়ে গিয়েছি। তবু আমি সহ্য করতাম, শুধু ও আসা পর্যন্ত। আমি জানতাম ও আসবে। ও আসতো।

লম্বা লম্বা পা ফেলে, ছটফট করতে করতে। ও আসতো যখন অভিমানে আমি ঘর ছেড়েছিলাম। ও আসতো যখন হাসপাতালে আমি ছটফট করছিলাম, ও আসতো যখন প্রায় পুরোটা ক্লাস আমাকে ভুল বুঝে বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো, ও আসতো যখন আমি মাতাল হয়ে রাস্তায় হেঁটেছিলাম, ও আসতো যখন আমি নৌকায় ভেসে আকাশ দেখেছিলাম, ও আসতো যখন আমি দূর পাহাড়ে নিঃস্ব হয়েছিলাম, ও আসতো যখন ইউরোপ যাব বলে পা বাড়িয়েছিলাম, ও আসতো যখন আমি ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম...নাইম আসতো, আসবে, যখন পুরো পৃথিবীতে কে আমি দেখে নিতে চাই, একবার, বারবার। । পুনশ্চঃ বহু বন্ধু বাদ পড়েছে এই লেখা থেকে।

তারা পরের লেখা। সেই লেখায় এদের সবাই বাদ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.