আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শান্তির মিলনভুমি শান্তিনিকেতন

রবীন্দ্রনাথের লেখা বা স্থানিয়দের কথা থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের ভুবন সিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রন শেষে পালকি করে এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বোলপুরের এ জায়গাটায় এসে ছাতিম গাছের তলায় পালকি রেখে একটু জিরিয়ে নিলেন। তারপর থেকে তিনি মনে মনে ভাবলেন এখানে তিনি আরো গাছ লাগাবেন। এই প্রত্যাশায় রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে এই জমি তিনি দান গ্রহন করেছিলেন। প্রথমে তিনি অনেক গাছ রোপন করেন।

গাছের সবুজ আর নির্জনতাকে তিনি খুব পছন্দ করলেন। পরবর্তীতে ১৮৮৮ সালে একতলা একটি বাড়ি তৈরি করেন। মাঝে মাঝে সাধনার জন্য এখানে চলে আসতেন। তারও কিছুদিন পর এই একতলা বাড়িটির ওপর দ্বিতল নির্মান হয়। মহর্ষি এই বাড়িতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে এর নাম রাখেন শান্তিনিকেতন।

প্রথম দুবছর এ বাড়িটির দোতলায় উপাসনা অনুষ্ঠিত হতো। পরবর্তীতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ৯৫ হাজার টাকায় ব্রক্ষমন্দির নির্মান করেন। এই মন্দিরটি নির্মিত হয় এক অভিনব কৌশলে। জানা যায়, তৎকালের বিখ্যাত সিকদার কোম্পানীর প্রসন্নকুমার সিকদারের তত্ত্বাবধানে লোহার ফ্রেমে বাধা নানা রঙের কাঁচে নির্মিত হয়েছে এ মন্দিরটি। এখানে উপাসনার কোন নির্দিষ্ট দিক নেই।

পুরো ঘরটি ফাঁকা। এর কোথাও কোন আসবাব নেই। যে কেউ যে কোন দিকে বসে তার আরধনা বা উপাসনা সম্পন্ন করতে পারেন। ব্রক্ষ ধর্ম মুলত একেশ্বরবাদ। ঈশ্বরকে এক ও নিরাকার হিসাবে পরিগনিত হয়ে থাকে।

তাই এ ধর্মের অনুসারীদের মতে ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট দিকমুখি হওয়ার প্রয়োজন নাই। শান্তিনিকেতনের ট্রাস্টি সদস্য রমনীমোহন চট্রোপাধ্যায় তার কর্মভার ত্যাগ করেন। নিয়মানুসারে ১৮৮৯ সালের আগস্টে সেই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ট্রাস্টি হিসাবে নিযুক্ত হন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের এক নতুন অধ্যায় হিসাবে যুক্ত হয় শান্তিনিকেতন। আর বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষি হয়ে শান্তিনিকেতন এখন বিশ্বের সাহিত্যানুরাগীদের তীর্থধামে পরিনত হয়েছে।

এক টানা তিনবছর কোলকাতায় বসবাসের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাছাড়া কয়েকবার বিভিন্ন প্রয়োজনে কোলকাতা যেতেও হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই তীর্থধামে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছিলাম ‘সেখানে যাবোই’। আমার বন্ধু শান্তিনিকেতনের দুরদর্শনে চাকরি করে।

তাকে জানালাম আমার যাবার কথা। তিনি জানলেন কোলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাবার জন্য আলাদা একটা ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। তার নাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। এটি হাওড়া থেকে বোলপুর অর্থাৎ শান্তিনিকেতন পর্যন্ত যাওয়া আসা করে। সকাল ১০ টার ট্রেনে উঠলে বোলপুর স্টেশনে পৌছাবে দুপুর ১২ টায়।

সেখান থেকে অটো/ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা শান্তিনিকেতনে যাওয়া যায়। দুপুর বারোটার দিকে শন্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বোলপুর স্টেশনে এসে পৌছাল। প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি শান্তিনিকেতনের সরকারী গাড়ি দ্াঁড়িয়ে আছে আমাকে রিসিভ করার জন্য। কুশলাদি জিজ্ঞাসা শেষে গাড়িতে উঠে বসলাম। বোলপুর স্টেশন থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেল দুরদর্শন ভবনের দিকে।

সে রাস্তাটি খুব ভাল না। এখানকার রাস্তাঘাট দেখে শহর মনে হয়না। মনে হয় গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে রাস্তা অনুসরন করে এগিয়ে গেলাম সামনে। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট খুপড়ি দোকান।

একটা বাজারর আছে। এটি দেখে আমার গ্রামের হাটের কথা মনে পড়ে গেল। যা হোক অবশেষে আমরা পৌছলাম শান্তিনিকেতন দুরদর্শন ভবনে। এখানে দুরদর্শন (টেলিভিশন) ছাড়াও রয়েছে শান্তিনিকেত বেতার কেন্দ্র। প্রায় ৫/৬ একর জমির মধ্যে রয়েছে দুরদর্শন, বেতার ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আবাসন।

সবচেয়ে আকর্ষনীয় এখানের সবুজের সমারোহ। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। দুরদর্শন ভবনের সামনে একচিলতে বাগানে সবুজ ঘাসের বুক চিরে জেগে উঠেছে বাহারী ফুলের গাছ। কোলাহলবর্জিত দুপুরের বুক চিরে কানে ভেসে আসছে কিচির মিচির পাখির ডাক। একতলা বিল্ডিংয়ে রয়েছে স্টুডিও রুম।

এখান থেকে ডিডি-২ এ শান্তিনিকেতনের সকল অনুষ্ঠান স¤প্রচার করা হয়। এছাড়াও রয়েছে শিল্পী কক্ষ, কলাকুশলীদের কক্ষ, মহাপরিচালকের কক্ষ ও সম্পাদনা রুমহস বেশ কয়েকটি রুম। এখানকার স্টুডিওতে রবীন্দ্রগীতিনাট্যর মঞ্চ তখনো তৈরি করা রয়েছে। আমার যাবার ঠিক একটু আগে এ অনুষ্ঠানটি ধারন করা হয়েছে। আমাকে নিয়ে গেস্টহাউসে যাওয়া হলো।

এখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে গাড়িতে করে রওনা হলাম আশ্রমের দিকে। এখান থেকে যে রাস্তাটি চলে গেছে আশ্রমের দিকে সেটি খুব চওড়া রাস্তা না হলেও বেশ ভালো রাস্তা। দুপাশে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ঠিক দুপাশে মুখোমুকি দাঁড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের দুটি অধ্যায়। এক পাশে বসবাসের স্থান।

অন্যপাশে শিক্ষাগ্রহনের স্থান। হাতের ডান দিকের গেটে লোক বসে আছে। মোবাইল অফ করে ক্যামেরা বা অন্যান্য জিনিস সেখানে রেখে ভেতরে প্রবশে করতে হবে। প্রবেশ মূল্য ৫ রুপি। বাড়িটির ভেতরে কেন যে ছোট ছোট খোয়া বিছানো আছে ঠিক জানি না।

তবে এর উপর দিয়ে হাটতে বেশ মজাই লাগছিল। ঢুকতেই হাতের ডান দিকে কয়েকটি মুর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হাতের বাম দিকে উত্তরায়ন ঘর। এটি মুলত রবীন্দ্র মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে সাজানো আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র।

তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার একটি র‌্যাপ্লিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রভক্তদের মনরঞ্জন করার জন্য। কারন আসল নোবেলটি চুরি হয়েছে বেশ কয়েকবছর আগে। এখান থেকে একটু সামনে হেটে এলে আরো একটি ঘর। এ ঘরটিতে কবি লিখতেন, অতিথিদের সাথে বসে কথা বলতেন।

তাছাড়া বিভিন্ন নামী-দামী কবিদের সাথে বসে সাহিত্যালোচনা করতেন। কবি যে আসনে উপবিষ্ট হতেন, সেটি এখনো তেমনি ভাবে সুরক্ষিত আছে। সামনের দিকে হেটে যেতেই চোখে পড়বে মাটির একটি ঘর। এটির নাম শ্যামলী। শান্তিনিকেতনে প্রথম যেদিন গান্ধীজী আসেন।

এখানে গাছের ছায়ায় গান্ধীজীর সাথে বসেছিলেন রবী›ন্দ্রনাথ। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে এ ঘরটি ইট সিমেন্ট দিয়ে মাটির ঘরের আদলে নির্মান করা হয়েছে। এমন কি সিমেন্টের গায়ে মাটির আবরণ দেয়া হয়েছে। দেখলে মনে হবে যেন মাটির ঘর। প্রতিদিন এ ঘরে মাটিজল দিয়ে লেপন করা হয়।

এর ঠিক সামনে একটি দোতলা বাড়ি। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলে দেখা যাবে কবির শোবার ঘর। সামনে খোলা চওড়া বেলকনি। সামনে রেলিং দেয়া আছে। এখানে আরাম কেদারা বিছায়ে তিনি প্রাতে উপাসনা করতেন, গান লিখতেন, সুর ভাঁজতেন।

এমন কি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বই পড়তেন ও লেখালেখি করতেন। গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা ডিঙিয়ে ও পাশে ঢুকতেই গাছের সমারোহ। প্রতিবছর বর্ষাকালে এখানে বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়। বিনামূল্যে কয়েকশত গাছ বিলিকরা হয়। এখানে উপস্থিত অতিথিদের প্রত্যেতেই গাছের চারা কিনে নিয়ে যান।

তাছাড়া শান্তিনিকেতনে একটি গাছ কাটা হলে দুটি গাছ লাগানো হয়। বড় বড় আম গাছের ছায়ায় শান্তিনিকেতনের ক্লাশ করানো হয়। এটি আম্রকুঞ্জ নামেও পরিচিত। বড় বড় গাছের নীচে ইটের তৈরি বেষ্টনীতে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা গ্রহন করেন। কখনো কখনো রুমের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহন করে থাকে।

শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা আছে। প্রতিবছর পৌষ মাসের ৭ তারিখে এখানে মেলা হয়। এটি অবশ্য চালু করেছিলেন কবি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৪৩ সালে ৭ ই পৌষ বৃহস্পতিবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কুড়িজন অনুরাগীসহ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীসের কাছে ব্রক্ষধর্মে দীক্ষাগ্রহন করেন। এই ব্রক্ষধর্মের সাফল্য, প্রসার ও প্রচার অনুপ্রেরনা জোগায় মহর্ষিকে।

তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই তিনি বাসনা করেন দীক্ষিত ব্রক্ষদের নিয়ে তিনি একটি মেলা করবেন। ১৭৬৭ সালের ৭ ই পৌষ থেকে এ মেলার প্রচলন হয়। মহর্ষি এ মেলার স্রষ্টা হলেও এর প্রকৃত রূপকার কবি নিজে। ব্রক্ষধর্মের মতে বুধবার পবিত্র দিন।

এ দিনে উপাসনা করলে সিদ্ধিলাভ হয়। এ কারনে শান্তিনিকেতনের আওতাধীন সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতিত সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। শনিবার ও রবিবার এখানে যথারীতি কর্মক্ষেত্র চালু থাকে। শান্তিুনিকেতনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। এর নাম খোয়াই নদী।

পুরানো গল্প বা সিনেমা দেখলে এ নামটি খুব পরিচিত মনে হবে। তখনকার দিনে এটি ছিল একমাত্র স্যুটিং প্লেস। স্থানীয়দের মতে জানা যায় খোয়াই নদীর উৎপত্তি মুলত একটি মালভুমি থেকে। এটি মিশে গেছে ব্রক্ষপুত্রের সাথে। সপ্তাহের প্রত্যেক শনিবারে খোয়াই নদীর পাড়ে একটি হাট বসে।

এর নাম ‘আমাদের হাট’। এ হাটে আসে শান্তিনিকেতনের আশে পাশের নারী-পুরুষ সকলে। এর মূল উপাদান ঘরে তৈরি বা উৎপাদিত বস্তু। যেমন কেউ পিঠা তৈরি করে প্লেটে করে নিয়ে আসে। কারো ঘরের চালে লাউ হয়েছে, সেটাই সে নিয়ে আসে।

এ হাট বসে দুপুরের পর অর্থাৎ ভাটিবেলা থেকে আরম্ভ হয়ে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত। এ হাটে কখনো কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয় না। বোলপুরের শান্তিনিকেতন এখন বিশ্বশান্তির বারতাবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে গেলে সত্যি মনে শান্তি আসে। এখানে না আসলে বাঙালী হিসাবে পুর্নতা পেতাম না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।