আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শান্তির খোঁজে

মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।

“সুখ-শান্তি” শব্দ দু’টি আমরা প্রায়ই একসঙ্গে ব্যবহার করি বলে অনেকের ধারণা এ দু’টি শব্দের আলাদা কোনো অর্থ নেই। অথচ শুধু আলাদা অর্থ নয়, বিশাল পার্থক্যও আছে।

এমন কাছাকাছি বহু শব্দ নিয়েই আমাদের ধারণা সুস্পষ্ট নয়। যেমন ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’, ‘সমাজ’, ‘জাতি’ ও ‘সম্প্রদায়’, ‘দেশ’ এবং ‘রাষ্ট্র’ ইত্যাদি। দেশ ও রাষ্ট্রের পার্থক্য, সংজ্ঞা, শর্ত ও পরিধি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের দু’একটি লেখা দৈনিক কাগজে পড়েছিলাম। আর ‘মুক্তি ও স্বাধীনতা’ নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটা লেখা চোখে পড়েছিল; যদিও সেটি মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে বেশিদূর এগুতে পারেনি, কেবল সামান্য পার্থক্যটাই চিহ্নিত করেছে। অবশ্য সর্বজনীন মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি।

ড. আকবর আলী খানও প্রায়ই মিডিয়ায় দারুণ কিছু মন্তব্য করেন। যেমন ক’দিন আগে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দুই নেত্রীর সংলাপ ও ‘তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার’ প্রশ্নে বলেছিলেন, ‘আমরা এসব নিয়ে কেবল ছায়ার মধ্যে ঘুরোঘুরি করছি, বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ’ প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে বিএনপির আ স ম হান্নান শাহ’র একটি ব্যাখ্যা, যেটি তিনি দিয়েছিলেন একশ্রেণির রাজনৈতিক কুচক্রীর সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি নষ্টের পায়তারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রশ্নে। সুখ-শান্তির অর্থ খুঁজতে গিয়ে শুরুতেই আমাদের ক’জন বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-বক্তব্য স্মরণ করলাম, কারণ তারাও কখনো-সখনো সত্যের কাছাকছি পৌঁছেন, কিন্তু স্বার্থের (ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও দলীয়) দ্বন্দ্ব এবং প্রতিটি শব্দ ও বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ওই শব্দ বা বিষয়ের প্রয়োগক্ষেত্র ‘মানবিক অস্তিত্বকে’ কেন্দ্র করে হয় না বলে তারা ব্যর্থ হন। যেমন স্বাধীনতা।

স্বয়ং ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির ভেতরেই একটা অধীনতার সাক্ষ্য রয়েছে। তবে অন্যের নয়, নিজের অধীনতা। আজ এই স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ কেউ এ বিচারটি করছেন না যে, মানবিক অস্তিত্বে এই কথিত স্বাধীনতার ফলশ্র“তি কি? সবকিছু তো মানুষের জন্যই। অর্থাৎ মানুষের অস্তিত্বগত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কল্যাণের জন্য।

তাই মানবিক অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখি স্বত্ত্বা দিয়েই এসবের বিচার ও ফলশ্রুতি নির্ণয় করতে হবে। উপরে আমি বলেছি ‘এমন কাছাকাছি বহু শব্দ নিয়েই আমাদের ‘ধারণা’ সুস্পষ্ট নয়’। এই ধারণা শব্দটি নিয়েও কথা আছে। ধারণা যদি সুস্পষ্টই হবে তবে সে তো ধারণা থাকবে না, কোনো নিশ্চিত তথ্য বা জ্ঞান হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষা বা জ্ঞান দেয়া হয় শুধুমাত্র ‘সুস্পষ্ট ধারণা’ অর্জনের জন্য।

এটি দু’দিক থেকে ভুল। এক. ‘সুস্পষ্ট ধারণা’ শব্দবন্ধটি চলতে পারে না। দুই. এসব কথিত শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত বা প্রাপ্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন, সন্দেহযুক্ত এবং মানবিক অস্তিত্বের পক্ষে সাংঘর্ষিক, অকল্যাণমুখি ‘ধারণাকেই’ আমরা জ্ঞান বলছি যা খুবই মারাত্মক। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্র সেটাই যেখানে সব রকম ধারণা, সংশয় ও অস্পষ্টতা দূর করার সূত্রে মানবিক বুদ্ধি, চিন্তা, ইন্দ্রিয় ও বৈজ্ঞানিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অকার্যকর। এমন স্পর্শকাতর, অদৃশ্য, ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয়টি জ্ঞান অবশ্যই সুস্পষ্ট করে তুলবে।

প্রকাশ্য চোখ-কান দিয়ে দেখা-শুনার চেয়েও সুস্পষ্ট। তা না হলে জ্ঞান হবে কিভাবে? জ্ঞান অর্থ চোখ, জ্ঞান অর্থ আলো, জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান অদৃশ্য বিষয় দেখে, অন্ধকার দূর করে, মতভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে ঐক্যের ভিত রচনা করে। এ শক্তি অবশ্যই মানবিক সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম। সুখ বলতে আমরা কী বুঝি? প্রথমেই বুঝা দরকার ‘সুখ’ মানে আরাম, আয়েশ যা ‘শরীরের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আর ‘শান্তি’ মানুষের অন্তরের এবং অন্তরের গভীরতর বোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানবিক মস্তিষ্ক এবং আজকের বিজ্ঞান যেখানে ‘মন’ স্বীকারই করে না, সেখানে এ দু’টি শব্দ গুলিয়ে ফেলার অবকাশ নেই। ‘মন’ ও ‘ব্রেন’ নিয়েও একই কথা। এসব গুলিয়ে ফেলার এবং অস্পষ্ট রাখার অবকাশ নেই। তবে শারীরিক সুখ ও আরাম-আয়েশের একটা ক্ষণিক, হাল্কা স্পর্শ মনকেও আচ্ছন্ন করে।

এ জাতীয় শারীরিক আরাম-আয়েশ ও হাল্কা ক্ষণস্থায়ী মানসিক আনন্দানুভূতি যা ধনসম্পদ, কথিত সম্মান, যৌনসম্ভোগ, প্রেম, নেশা ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ের দ্বারাও অর্জিত হতে পারে। কিন্তু শান্তি হল দীর্ঘস্থায়ী, নিরবচ্ছিন্ন-অবিরাম ও গঠনমূলক এক শারীরিক-মানসিক প্রক্রিয়া এবং অপার মানসিক সুখানুভূতির নাম যা শুধুই বৈষয়িক বিষয়সম্পত্তির দ্বারা অর্জন সম্ভব নয়। আবার এগুলো বাদ দিয়েও নয়, এখানে কথা আছে, বৈরাগ্যবাদ ও বস্তুবাদের প্রতি ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আকর্ষণ-বিকর্ষণের একটা ব্যাপার আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেউ চূড়ান্ত দূরবস্থায় পতিত হলে যেমন শান্তির ব্যবস্থা আছে, ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পদের পাহাড় গড়লে, জমা করে রাখলে, এর প্রতি আকর্ষণ ও এর দ্বারা মন-মস্তিষ্কে অহমিকা বোধ করলে শান্তি বিঘিœতও হবে নিশ্চিত। মোটকথা কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ার অবকাশ নেই।

সমন্বয়, সামঞ্জস্যবিধান, প্রয়াস-প্রচেষ্টা, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা, ব্যক্তি থেকে বিশ্বজনীনÑ এসব মিলিয়েই শান্তি। পৃথিবীর অপরপ্রান্তের কোনো একজন মানুষ এমনকি একটা কুকুরও কষ্টে থাকলে সুখী মানুষটির সুস্থ অন্তরের শান্তি বিঘিœত না হয়ে পারে না। আবার মানুষের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব, পরীক্ষা ইত্যাদি স্মরণ করে সে নিজেও হাজারও কষ্টে নিমজ্জিত থেকেও শান্তি পেতে পারে। নিশ্চয় শান্তি কোনো এক মহান স্বত্ত্বা বা চিরঞ্জীব শক্তির নিকট সর্বান্তকরণে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে লাভ হয়। কারণ প্রকৃতিগতভাবে মানুষ একদিকে যেমন বিজয়ের চূড়ায় আরোহণ করে তৃপ্তি পায়, অন্যদিকে অসীম শক্তি ও অক্ষয় সৌন্দর্যের অধিকারী কারো নিকট নিজেকে সমর্পনের মাধ্যমেও পরম ‘শান্তবোধ’ অনুভব করে।

অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে সীমিত ভালোবাসার বিনিময় থাকলেও একমাত্র মানুষের ভালোবাসার বিনিময় অর্থাৎ দেয়া-নেয়ার চাহিদা অসীম। তাই সীমিত কোনো শক্তি বা জীবনের অধিকারী প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে এর যথাযথ বিনিময় চলতে পারে না। শান্তি বলতে শুধু যুদ্ধহীন বিশ্ব বুঝায় না। যদি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের ইতিবাচক অবস্থা ব্যক্তির মনে সেই অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে অথবা ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে জ্ঞানান্বেষণ, সত্যের সন্ধানলাভ এবং ন্যায়-নীতির অনুশীলনের মাধ্যমে মহান সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে তাহলেই শান্তির স্পর্শপ্রাপ্তি সম্ভব। একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে, “যে অনুভূতি বা ‘অনুভব শক্তি’ ক্রমোন্নতিমূলক বিবর্তনশীল উপকার প্রাপ্তির পথে স্থির ক্রিয়াশীল- তাকে সুখ বা শান্তি বলা যেতে পারে।

” বার্ট্রান্ড রাসেলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘শান্তি কিভাবে পাওয়া যাবে?’ তিনি বলেছিলেন ‘হৃদয়ে শান্তির ঘর বাঁধতে হবে। ’ হ্যাঁ, কথা সত্য, হৃদয়ে শান্তির ঘর বাঁধতে হবে। কিন্তু কিভাবে বাঁধতে হবে তা তিনি বলেননি বা বলতে পারেননি। শান্তির অভাবে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। পৃথিবীর খ্যাতিমান বহু শিল্পী, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখলেও এর দ্বারা জগৎবাসীকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির সন্ধান দিতে পারেননি।

এমনকি তারা নিজেরাও হৃদয়ে অপার শান্তি অনুভব করেননি। এর মধ্যে অনেকেই সাংসারিক সহযোগির সঙ্গে পর্যন্ত সহনশীল আচরণ, সহানুভূতি প্রদর্শন এবং সমন্বয়ধর্মী বুঝাপড়া গড়ে তুলতে পারেননি। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটে সাধারণত এখানেই। ফেরেশতা ও পশুর মধ্যে শান্তি-অশান্তির প্রবল অনুভূতি নেই। মানুষই অশান্তি ভোগে, সুতরাং শান্তির প্রশ্ন কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-ইহুদি-মুসলিম যেই হোক, মানুষ মাত্রই শান্তির প্রত্যাশী। শান্তিই সবার, সব কাজ-কর্মের চুড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই মানুষের মূল্যায়ন শরীরবৃত্তীয় কাজ, পদ, বংশ, শিক্ষা, ক্ষমতা বা অর্থের মানদণ্ডে নয়, মানুষের মূল্যায়ন হওয়া চাই শান্তির প্রত্যাশা, শর্তানুযায়ি প্রচেষ্টা ও প্রাপ্তির মাধ্যমে। আজ বিজ্ঞানের মুহুর্মুহু আবিষ্কার-উদ্ভাবনে আমরা চরম উৎফুল্ল। চারদিকে পৃথিবীর অগ্রগতি; আলো ঝলমল শহর, লালনীল বাতি।

শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, তথ্যের অবাধ প্রবাহÑ এক কথায় সর্বক্ষেত্রেই অত্যাশ্চর্য উন্নতির প্লাবন! তা সত্ত্বেও পৃথিবীর নব্বই ভাগ সাধারণ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। মুষ্টিমেয় যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ, তাদেরও কেউ কেউ চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও জীবনের প্রকৃত মান নিয়ে দারুণ হতাশ! বাকিরা মানসিক শান্তি, স্থিতি, বৈষম্যের মূল কারণ ও এর সর্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ বলেই মনে হয়। তাই দু’দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে এত ফারাক। শিক্ষালয়ে প্রায়ই এমন পরিস্থিতি ঘটে যে, আগের ক্লাশের শিক্ষক মহোদয় ফুরফুরে মেজাজে এসে বিজ্ঞানের অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করিয়ে সত্তরই পৃথিবীর স্বর্গে রূপান্তরিত হওয়ার বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন। পরের ক্লাশের শিক্ষক দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এসে অচিরেই পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে এমন তথ্য-উপাত্ত পেশ করেন।

আমরা আজকাল প্রায়ই প্রবীণদের মুখে শুনি পূর্বপুরুষদের সেই গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরুর বয়ান। অথচ নবীনরা বলে বেড়ান অতীতের দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মূর্খতা ও দারিদ্রের কথা। অর্থনীতিতে বলা হয়েছে মানুষের অভাব অসীম, কিন্তু সম্পদ সীমিত। অভাব বলতে এখানে বস্তুগত অভাবকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ অবস্তুগত অভাব বা অন্যকিছু (আল্লাহ, ঈশ্বর, গড) মানবমস্তিষ্ক ও বিজ্ঞান স্বীকার করে না।

প্রকৃতপক্ষে বস্তুগত অভাবের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষেরই অবস্তুগত অভাবও রয়েছে, যা আরও বেশি অসীম। এ সম্পর্কে আলোচনা বা সমাধান প্রচলিত অর্থনীতির বইয়ে নেই। তাছাড়া বস্তুগত অভাব মূলত অসীম নয়, এর একটা সীমা আছে। অসীম কেবল মানুষের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্খা যা সম্পূর্ণই মানসিক ব্যাপার। মানসিক অভাব (অভাবের অনুভূতি) বা চাহিদা শুধু অর্থ ও বস্তু দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়।

সুতরাং ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়, অর্থ ও বস্তুর পাশাপাশি এমন কিছুও মানুষকে খুঁজতে হবে যা অমাদের মানসিক অসীম চাহিদা পূরণ করবে; নৈরাশ্যবাদের কালো গহ্বর থেকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন সব বয়সের নারী-পুরুষের চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলার কথা। কিন্তু এগুলোও সাময়িক। আমরা লক্ষ্য করি না যে চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা ও নেশার মাধ্যমে যদিও মনে সাময়িক আনন্দ অনুভূত হয়, কিন্তু শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে তা অগঠনমূলক এবং মনের স্থায়ী শান্তির চাহিদা পূরণে অক্ষম। বরং পরবতীতে এগুলো অশান্তি আরও বৃদ্ধি করে, বিশেষ বিশেষ সময়ে হতাশা গ্রাস করে, আত্মহত্যার প্রবণতা জেগে ওঠে।

উগ্রতা, বদমেজাজ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে সেই মানুষটি মেতে ওঠে। মানুষের হৃদয় অতি স্পর্শকাতর একটি অঙ্গ। চোখে যেমন সামান্য একটি ধূলিকণা পড়লেও একে বৃহৎ পাথরখণ্ড বলে অনুভূত হয়, তেমনি কারও অন্তরে যদি বিশেষ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, স¤প্রদায় বা জাতির প্রতি সামান্যতম ঘৃণা, হিংসা, ক্ষোভ কাজ করে তাহলে সেই অন্তরটি অশান্তিতে ভরপুর থাকে। এমন অন্তর নিয়ে স্রষ্টার উপাসনা বা প্রার্থনা কোনোটাই চলতে পারে না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও সাহাবাগণের (রাঃ) ব্যক্তিগতভাবে কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল না।

তাই আমাদের অন্তরকে সবসময় পরিষ্কার ও পবিত্র রাখতে হবে। সর্বপ্রকার ঘৃণা-ক্ষোভ, হিংসা-দ্বেষ থেকে বিরত থাকতে হবে। জগতের সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের জন্য নিজেকেও আংশিক দায়ী করে এসব থেকে মুক্তির যৌক্তিক পথ ও পন্থা তালাশ করতে হবে। দৈনন্দিন আত্মসমালোচনায় অংশ নিয়ে দৃষ্টিকে বারবার নিজের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কষ্ট ও অশান্তি এককথা নয়।

কষ্ট সাধারণত শারীরিক হয়। কষ্টের বিপরীত আরাম। শান্তির বিপরীত অশান্তি। আরাম ও কষ্ট ভোগ করে শরীর। শান্তি ও অশান্তি ভোগ করে হৃদয় বা মন।

আমরা মনে যে কষ্ট পাই তা মূলত অশান্তিরই একটা অংশ বা স্তর। মনের কষ্টগুলো ধীরে ধীরে অশান্তিতে রূপ নেয়। একজন মানুষের নারী-বাড়ি-গাড়ী ও ভোগ-বিলাসের সীমাতিরিক্ত উপকরণ কখনো তাকে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আবার এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, নিগৃহীত ও বিপদগ্রস্থ মানুষটিরও পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অবস্থায়ই হৃদয়ে অসীম শান্তির ব্যবস্থা ইসলাম ধর্মে আছে। প্রশ্ন হল সেটা কিভাবে? আজ উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা ও ভোগ-বিলাসের উপায়-উপকরণ অনেক বেশি।

তা সত্ত্বেও সেখানে আমাদের দেশের তুলনায় আত্মহত্যার পরিমাণ, পাগলা গারদ, খুন-ধর্ষণ, ছিনতাই, ছাড়াছাড়ি-মারামারি অনেক বেশি। বৃহত্তম মানবসমাজের একক ইউনিট পরিবারব্যবস্থা সেখানে ভেঙ্গে পড়েছে। সেখানকার নাগরিকরা নিজেদের শারীরবৃত্তীয় চাহিদা পূরণে এতই ব্যস্ত যে, অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে দূরের কথা, নিজের মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে একান্তে ভাববার বা আলোচনা করার সময় নেই। ওরা পুরোপুরি যান্ত্রিক। যান্ত্রিক হলেও ভালোই ছিল, হৃদয়ে অশান্তি স্পর্শ করত না।

কারণ যন্ত্রের কোনো হৃদয় নেই। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ যান্ত্রিকও বলা যায় না, সমস্যাটা এখানেই। অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস, আনন্দ-স্ফূর্তি মানসিক সমস্যা ও অশান্তি চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিতে যখন তা বিস্ফোরিত হয় তখন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আমাদের বাংলাদেশে এ সমস্যাটা দিন দিন বাড়ছে।

এজন্য যুবসমাজ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক সমস্যা ও অশান্তির ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস, নাচ-গান ও তথাকথিত প্রেম-প্রীতি থেকে তাদের নিপারদ দূরত্বে রেখে সমাজ ও জীবন-বাস্তবতার কঠিন সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা শেখাতে হবে। স¤প্রতি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং তারকা ও মডেলদের আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়ায় ঘন ঘন আসছে। আত্মহত্যা মানে নিজেকে খুন করা। অন্যকে খুন করা তো অহরহ ঘটছেই।

মানুষের জীবন আজ মূল্যহীন, অর্থহীন। যেখানে সেখানে লাশ পাওয়া যায়। মাত্র দশ হাজার/বিশ হাজার টাকার জন্য অথবা সামান্য কারণে কাউকে মেরে ফেলা এখন মামুলি ব্যাপার। জীবনের নিরাপত্তা নেই, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই, গঠনমুখি বাকস্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা নেই। এসব কি প্রমাণ করে আমাদের জীবন খুব সুখী, শান্তিময়! আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি নাগরিকেরর অন্তরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

তথাকথিত সভ্যতা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান আর যাই পারুক, মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। অথচ শান্তিই সমস্ত মানুষের কাজ-কর্ম, চিন্তা-প্রচেষ্টা ও সবরকম তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য। শতকরা ৮০ ভাগ ধর্মানুভূতি সম্পন্ন মানুষের এই বাংলাদেশেও ধনী-গরীব, ধার্মিক-অধার্মিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত জীবনে কখনও আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগেনি এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এবং কখন একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে চায়? প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরিতে ব্যর্থতা, শিক্ষা, ভোগ-বিলাস ইত্যাদিতে ব্যর্থতা এবং পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অশান্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে একজন মানুষ তার নিজের জীবনটিকে আর মূল্যবান মনে করেন না। সুতরাং তিনি তার জীবন এ মুহূর্তেই শেষ করে দিতে চান।

অনেক সময় সাথে আরও দশ বা একশ'জনসহ। এই যে অশান্তি, এটা কিভাবে মনের মধ্যে উৎপন্ন হয়? শুধু কি জাগতিক অভাবই এর জন্য দায়ী? না, বরং প্রত্যেক মানুষের মনে একটা আধ্যাত্মিক ও স্বর্গীয় চাহিদা বর্তমান। যে কারণে জগতের সবকিছু পেয়েও একজন মানুষের মন শান্তি লাভ করতে পারে না। প্রাণী-পদার্থ-উদ্ভিদ নিয়ে আজ প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। গবেষণা নেই কেবল মানুষ নিয়ে।

অর্থাৎ ‘প্রকৃত মানুষ’ নিয়ে বা মানুষের অসীম চাহিদাসম্পন্ন ‘মন’ নিয়ে। মানুষের অভাব বা চাহিদা দু’প্রকার। জাগতিক ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক। জাগতিক চাহিদা আবার দু’প্রকার। শারীরিক ও মানসিক।

শারীরিক চাহিদা (খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-যৌনতা-চিকিৎসা) সীমিত। কিন্তু মানসিক বস্তুগত চাহিদাগুলো অসীম যা কখনো পূরণ হবার নয়। আর অবস্তুগত বা আধ্যাত্মিক চাহিদা সর্বাবস্থায়ই আরো বেশি অসীম। শান্তি কোনো লৌকিক বিষয় নয়, অলৌকিক। মানুষের আত্মা বা আত্মিক বিষয়টাও অলৌকিক।

ধর্ম যেসব অলৌকিকতার কথা বলে সেসব অলৌকিকে বিশ্বাস ছাড়া মানুষের আত্মার শান্তি পাওয়ার পথ নেই। ধর্মে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছেÑ রূহ মহান আল্লাহর হুকুম। এটা দুনিয়ার কোনো বস্তু নয়। শরীর মাটি-পানি-আলো-বাতাসের দ্বারা সৃষ্টি। এর খাদ্যও মাটি-পানি-আলো-বাতাস থেকেই উৎপন্ন হয়।

কিন্তু আত্মা বা রূহ যেহেতু স্বয়ং আল্লাহর হুকুম, এর খাদ্য বা চাহিদাও পূরণ হয় মহান আল্লাহর হুকুম-আহকাম মানার মাধ্যমেই। সুতরাং কোনো নাস্তিকের পক্ষে, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অমান্যকারী আস্তিকের পক্ষে এমনকি ইলম ও এখলাসবিহীন ধার্মিকের পক্ষেও নিরবচ্ছিন্ন শান্তির স্পর্শপ্রাপ্তি সম্ভব নয়, একমাত্র খাঁটি আল্লাহওয়ালাগণ ছাড়া। বস্তুবাদীরা অবশ্য এ কথার সঙ্গে একমত হবেন না। আবার তারা যথার্থ শান্তির সংজ্ঞাও দিতে পারবেন না। শান্তির মডেল তো দিতে পারবেনই না।

তাই মানব মনের অসীম চাহিদা, এ চাহিদা পূরণের পথ ও পন্থা এবং শান্তি নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতেও সব পক্ষেরই যথেষ্ট সময় দেয়া ও মতবিনিময় করা উচিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।