আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারায়ণগঞ্জে গণমানুষের জয়

নারায়ণগঞ্জে গণমানুষের জয় ফকির ইলিয়াস ======================================= শেষ পর্যন্ত গণমানুষেরই জয় হয়। কোনো আরোপিত শক্তি দিয়ে তাদের থামিয়ে দেয়া যায় না। রুদ্ধ করা যায় না তাদের কণ্ঠ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেই এলাকার মানুষ তা আবারো দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা খুব কাছের অতীতের দিকে তাকালে দেখবো, নারায়ণগঞ্জে এমন নির্বাচন হবার কথা ছিল না।

গেলো দশ বছর থেকে এই এলাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কান্ডারি হয়ে হাল ধরে রেখেছিলেন আহ্বায়ক এস এম আকরাম। একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার পরিচিতি। কিন্তু এই মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এস এম আকরামকে থুড়াই কেয়ার করেনি। তার মতামত না নিয়েই দল শামীম ওসমানকে মনোনয়ন দেয়। মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে নাটকীয়তা দেখিয়েছে, তা ছিল সাম্প্রতিক কালের একটি অন্যতম প্রহসন।

পাঠক, আপনাদের মনে আছে, শামীম ওসমান নিজেকে দলের প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রচার শুরু করেন। এরপর দফায় দফায় আওয়ামী লীগের শীর্ষদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। শেষে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেন। একইভাবে অন্য প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শামীম ও আইভী দুজনেই প্রার্থী থেকে যান।

আমরা দেখলাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদক ঐ এলাকায় গিয়ে শামীম ওসমানকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলে ঘোষণা দিলেন। এরপরে সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের কাছে জানতে চাইলেন, শামীম ওসমানকে কি আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে? তিনি প্রথম কদিন ‘না’ সূচক জবাব দিলেন। এটাও বললেন, কোনো কেন্দ্রীয় নেতা সমর্থন দিয়ে থাকলে নিজ দায়িত্বে দিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে নয়। তারপর আবার কথা পাল্টালেন মাহবুব উল আলম হানিফ।

বললেন, শামীম ওসমানই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখানে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো দল সরাসরি কাউকে সমর্থন করবে না, এমন আচরণবিধি আমাদের রাজনীতিকরাই তৈরি করেছেন। তার পরও আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিয়েছে ভোট শুরু হবার মাত্র সাত ঘণ্টা আগে। এটা দলগুলোর কেমন আত্মপ্রতারণা? এটা কেমন আইওয়াশ? দলগুলো এমন দ্বিচারিতা বারবার করছে কেন? নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান সরকার যেসব অসঙ্গতিপূর্ণ কাজগুলো করেছে, তার অন্যতম হচ্ছে- নির্বাচন কমিশন চাওয়ার পরও সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করা।

রাষ্ট্রতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলেই সরকারের ঐ এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সরকার খুব নির্বিকারভাবে তা চেপে গিয়েছে। কমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। এর কারণ কী? সরকার হয়তো বলতে পারে, সেনাবাহিনী ছাড়াই একটি ‘মডেল’ নির্বাচন করে তারা দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক, সরকার নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করেছে।

পত্রপত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ২৮ অক্টোবর সকাল থেকে সেনাসদস্য নামবে এটা ঠিকঠাকই ছিল। সকালে সেনাবাহিনী না যাওয়ায় সরকারি মহলে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, বিকালেই যাবে। ঐদিন বিকাল ৫টায়ও না গেলে নির্বাচন কমিশন বুঝতে পারে, সেনাবাহিনী নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছে না। এরপরে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে কিছু জানায়নি। সেনা মোতায়েনে আমরা ওয়াদা করেছিলাম।

সে অনুযায়ী চেষ্টাও করেছি। এখন কেউ যদি তার কাজ না করে, আমি কী করতে পারি? সিইসি বলেন, ‘এটা সরকারের অমনোযোগিতা বা কী কারণে হয়েছে, আমি জানি না। না দিতে পারলেও তাদের উত্তর দেয়া প্রয়োজন ছিল। এর পূর্ণ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, যে তারা দিতে পারলো না। পরবর্তীকালে আমরা জানতে চাইবো, কেন দেয়া হয়নি।

’ সিইসি আরো বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে তারা দিতে বাধ্য। তবে আমি আইনের কথা বলবো না। এটা মিউচুয়াল ডিসকাশনের মাধ্যমে হয়। তাদের উচিত ছিল, আমাদের সঙ্গে কথা বলা। ’ তিনি বলেন, সব নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে ব্যক্তিগত অবস্থান আমার।

তারপরও, নারায়ণগঞ্জে আমরা সেনা মোতায়েন চেয়েছি, কারণ জনগণ বারবার দাবি জানাচ্ছিলেন। সবশেষে আমরা টিভিতে দেখেছি, সিইসি বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে কেন সেনা মোতায়েন করা হলো না তা জানতে চেয়ে তারা প্রধান বিচারপতির শরণাপন্ন হবেন। বিষয়গুলো সরকারের জন্য মোটেও সুখকর নয়। কারণ এমন দ্বৈত ভূমিকা কোনো দল, সরকাররের ইমেজ সমুন্নত রাখতে পারে না। এদিকে নাসিকের নির্বাচনের পরপরই নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরাম পদত্যাগ করেছেন।

৩১ অক্টোবর সোমবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম বলেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে তিনি আহ্বায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে সাবেক এ অতিরিক্ত সচিব বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন প্রক্রিয়ায়, কিভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ একজন প্রার্থীকে সমর্থন দিলেন, তা তার কাছে রহস্যাবৃত। এস এম আকরাম মনে করেন, জনপ্রিয়তা এবং জয়ের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে তিনি জেনেশুনেই আইভীকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

তার সিদ্ধান্ত যে ভুল হয়নি, তা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে এবং তার সমর্থিত প্রার্থীই জয় পেয়েছেন। তার মতে, নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াত আইভীর ভাবমূর্তি অনেক ভালো। কিন্তু নির্বাচনে সমর্থন করা হলো শামীম ওসমানের মতো একজন লোককে। তাকে সমর্থন জানাতে কেন্দ্র থেকে অনেক নেতা এসেছেন। কেউ তার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করারও চিন্তা করেননি।

তিনি এ জন্য অত্যন্ত মর্মাহত। শামীম ওসমানকে সমর্থনের বিরোধিতা করে এস এম আকরাম বলেন, ‘অনিয়মতান্ত্রিক ও শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে দলের যে সিদ্ধান্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করে আমি নৈতিকভাবে দলের সদস্য থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। তাই আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ’ এস এম আকরামের এই পদত্যাগ আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয়ের সাক্ষী বহন করে। এই সেই এস এম আকরাম যিনি চরম ক্রান্তিকালে দলের হাল ধরেছিলেন।

আর এভাবেই তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। এটাই কি আমাদের ডিজিটাল পরিবর্তনের নমুনা? এটাই কি আমাদের রাজনীতির প্রাপ্তি-অর্জন? এর মধ্যে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন নাসিকের নতুন মেয়র। প্রধানমন্ত্রী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত পরাজিত প্রার্থী শামীম ওসমান। সেলিনা হায়াত আইভী নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে দেশে প্রথমবারের মতো একজন নারী মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় তিনি বেশ খুশি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তার আনন্দের বিষয়টি প্রকাশ করেন বলে একাধিক সূত্র জানায়। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের দুই মেয়র প্রার্থীই তার কাছে এসেছিলেন। দুজনকেই তিনি সমর্থন করেছেন। তবে আইভী বিজয়ী হওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচন হয়েছে। একজন বিজয়ী হয়েছে। তা ছাড়া প্রার্থী সমর্থন নিয়ে তিনি বা দলীয় সাধারণ সম্পাদক কিছু বলেননি বলেও জানান। তবে মাহবুব উল আলম হানিফ যে সমর্থন করেছিলেন, তা তো দেশবাসী দেখেছে। সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, জনগণ বিজয়ী হয়েছে।

সরকারি নীতিনির্ধারকদের পরাজয় হয়েছে। এটা কাম্য ছিল না। সরকার এমন ডিগবাজি না খেলেও পারতো। কারণ কোনো অপশক্তিকে ভয় করে যদি সরকার তার পক্ষে মৌন সমর্থন দেয়, তাহলে তাতে কি প্রমাণ হয় না- সরকার সুদৃঢ় অবস্থান নিতে ভয় পাচ্ছে। হাঁ, সরকার টিকবে জনগণের আস্থা নিয়ে।

তা না হলে সরকার হেরে যাবে। এস এম আকরামের মতো ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করলে আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সকল রাহুশক্তিকে হটিয়ে এগিয়ে না যেতে পারলে দুর্ভোগ বাড়বে সাধারণ মানুষেরই। নিউইয়র্ক , ২ নভেম্বর ২০১১ ------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা। ০৫ নভেম্বর ২০১১ শনিবার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.