আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোধূলি

প্রকাশিত বই ৭টি : ১. অপরূপা নীল নির্জনতায় (কবিতা, ২০০১) ২. সন্ধ্যার ঘ্রাণ (উপন্যাস, ২০০৫ ) ৩. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা (অনুবাদ, ২০০৫) ৪. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা-২ (অনুবাদ, ২০০৯) ৫. বাংলা শেখা সহজ ( ছোটদের বই, ২০০৯ ) ৬. একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গ চোখ বুঁজলে এখনও ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানে আসে। বড় রাস্তার খড়খড়ে মাটিতে সেই প্রতিধ্বনি ওঠে। খুব ভোরে যখন চেনা পৃথিবী চলে যায় অন্য কোথাও, আবছায়া ঝুঁকে থাকে ফলের মতো, সেই সময় অতি ধীরে উৎকর্ণ হয়ে চলেন প্রদীপ সেন। পথের একেবারে কিনারে চলে আসেন। ঘাসের শিশির কী নিশ্চিন্তে সবুজ বিন্দু হয়ে বসে আছে।

সূর্য আসে নি। এখনও ঘুম ঘুম দু’পাশের গাছপালা, লতাপাতা। খানিকটা থেমে এদিক ওদিক তাকালেন প্রদীপ। হাঁটু গেঁড়ে নিচু হয়ে কান পাতলেন মাটিতে। আর্দ্র মাটির হিম-কথামালা গুণ গুণ করছে কানে।

বহুক্ষণ রাস্তায় এভাবে কাঁত হয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো। নিজের খেয়ালে অবাক হলেন। আশেপাশের কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে! তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। রাস্তা থেকে কয়েক পা হাঁটলে বাড়ি। সেদিকে তাকালেন।

জামগাছটার ডালের ওপারে দোতলা দালানের ছাদের কোণা ভেসে আছে। বেশ পুরনো। প্রায়-জীর্ণ। তবু কী যে ভালো লাগে বাড়িটার দিকে দূর থেকে তাকালে। ছেলেবেলার সাক্ষী হয়ে আছে ইটগুলো।

কাচা ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনে ঝোড়াভর্তি ইট নিয়ে গরুগাড়ি এসে থামতো। গাড়োয়ান ও তার সাথের ছেলেটা মাথায় বাঁধা গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে মাটিতে সাজিয়ে রাখতো। কী সুন্দর ইটগুলো! লাল লাল কাঠি লজেন্সের মতো রঙ। ঝন্ ঝন্ ঝংকারে একটার ওপর আরেকটা গেঁথে গিয়ে উঁচু হয়ে থাকতো। পাকাঘর কবে হবে সে-কথা আর ভাবতো না প্রদীপ।

চারদিকের কাদামাটির ভেতর ইটগুলোর অমন গায়ে গায়ে লেগে থেকে উঠোনটার মাঝখানে দাঁড়ানো দেখতেই ভাল লাগতো। কিন্তু একদিন যখন তরল সিমেন্টে আঁটকালো একে অপরের গা, তখনই সত্যিকারভাবে ওরা দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো ঘরের চারপাশে। রাস্তার মোড়ের চা’র দোকানে রেডিওর জোর আওয়াজে চলার তন্ময়তা ভাঙলো। একটু বেশি সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলেছে গফুর। গরমের সকাল হলেও এইসময়ে চা পেলে মন্দ হয় না।

ফালগুন যায় যায়। তবু সেইরকম চৈত্রের দেখা নেই। এখনও চারদিকে ফুলেল সময়। মৃদু ফুরফুরে বাতাস। মোড়ের বটগাছটায়, পাতার আড়ালে নতুন নতুন কোকিলের আনাগোনা, অবিরাম গান।

আকাশের দিকে একবার দেখে আর্দ্র ধুলোভরা পায়ের দিকে তাকালেন প্রদীপ। কারও ডাকে মুখ তুললেন। নতুন খবর শুইনেচেন, কাকা? রেডিওর ভল্যুম কমিয়ে চুলায় কাঠ এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো গফুর। না তো, নতুন কইরে আবার কী হইলো? এগিয়ে এসে চটার বেঞ্চে বসতে বসতে জানতে চাইলেন। মাত্র কয়দিনির মদ্দি আমাগের ছেইলেরা শক্ত জোট বাইনদেচে, টেনিং নেচ্চে, অস্তর-পাতিও শুনলাম আইসতেচে ওইপার তে’।

এইবার দেকা যাক, খানেরা যায় কোন্ দিকি? ব’লে দাঁতে দাঁত পিষে হাসলো গফুর। উগের যাওয়ার কোনো পথ থাকপে না যদি মুক্তিরা সত্যি সত্যি শক্ত হইয়ে থাকে। ঠিক বলিচেন। কিন্তু ‘সত্যি শক্ত হইয়ে থাকে’ কতাডা বুঝলাম না কাকা। বুইঝলে না? এক মা’র সব ছেইলে যেমন একরকম হয় না, সেরকম সবাই চায় না, এই বাংলা স্বাধীন হোক।

সে আবার কীরাম কতা কাকা। এতকিচু হইয়ে গেল। নির্বাচনে জিতলাম আমরা, ক্ষ্যামোতা দেলে না। এত বছর গোলামের মতোন ব্যবহার কইরতেচে, তারপরও বাংলার কোন্ সন্তান চাবে না স্বাধীনতা! সুমায় হলি বুজদি পারবা, গফুর। এখন এক কাপ চা দ্যাও দিনি।

গফুর ধীর-হাতে চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে থামলো একবার। দুধে চা মিশে খুব সুন্দর রঙ টলটল করছে কাচের কাপটায়। তরলের ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রদীপ। কাপের গায়ে বেয়ে পড়া পানিটা গামছা দিয়ে মুছে বাড়িয়ে ধরলো গফুর। বাড়ির ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন প্রদীপ।

ফিনফিনে রাঙা রোদ সারা উঠোন জুড়ে। গোলাঘরের ছায়াটা বেশ দীর্ঘ হয়ে আছে। গোয়ালের গরুগুলো জাবনা শেষ করে বাইরে বের হবার অপেক্ষা করছে। টিউবওয়েলের দিকে এগোতে যাবেন, এমন সময় ছেলে সুদীপের ডাক। বাবা, সামাদ এসেছে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়।

কোথায় ও? দহলিজে বসতে বলেছি। আচ্ছা। পাঁচিলের কোণায় দহলিজ ঘরটা পাহারার মতো দাঁড়ানো। শানের বারান্দায় বেঞ্চ পাতা। ভেতরে একটা খাট টেবিল আর বেশ কয়েকটা চেয়ার।

প্রাইমারি স্কুল থেকে রিটায়ার করবার পরে সকাল বিকেল কিছু ছেলেমেয়ে পড়ান প্রদীপ। সুদীপ বাবার স্কুলেই শিক্ষকতা করছে। জমিজমা যা আছে তাতে তাদের এই গ্রামের বেশ সচ্ছল গৃহস্থ বলা যায়। সবরকম মানুষের আনাগোনা, নানারকম গল্পগুজবে ভরে থাকে এই দহলিজ ঘরটা। বাড়ির দিকের দরোজা খুলে ভেতরে এলেন প্রদীপ।

একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে সামাদ। কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত সমান্তরালভাবে বিছানো টেবিলের ওপরে। মাঝে মাঝে হারমোনিয়ামের রীডে আঙুল বুলিয়ে যাবার মতো কাঠের ওপর সারি সারি শব্দ তুলছে, টুক্ টুক্ টুক্। প্রদীপের দরোজা খুলে ভেতরে ঢোকা টের পায় নি। ওর মতো ক’রে টেবিলে কয়েকবার টোকা দিলেন প্রদীপ।

ধীরে মাথা তুললো সামাদ। অন্যান্য দিন হলে উঠে দাঁড়াত। আজ এ অন্য কেউ। চোখ দুটো লাল। চুল ঝাঁকড়া হয়ে নেমে আসতে চাইছে দু’কান বেয়ে।

পঁচিশ বছরের যুবকের ভেতর হঠাৎ পঁয়ত্রিশ বছরের পূর্ণতার প্রতাপ। এই ক’মাস আগেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে দেখা করতে এসেছিল। কালো সুঠাম দেহে সেদিনও ছিল বালকত্বের ছাপ। আজ সেই শরীরে অন্যভাষা। সোজা-শক্ত দৃষ্টি।

উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ভাবনায় মোড়ানো। স্যার, বসেন। স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছে আজ মাসখানেক হলো। এলাকায় আর্মীর আনাগোনাও শুরু হয়েছে। মুক্তি বাহিনী আরও মজবুত করা দরকার।

পরামর্শ দেন। ’ আরও বেশি যুবক ছেলেদের সংগঠিত করো। তোমার আব্বার সাথে কথা হয়েছে? জ্বী, আব্বার সাথে প্রথমে কথা বলেই আমি যশোরে গিয়েছিলাম। উপর থেকে আমাদের এলাকার দায়িত্ব আমাকে নিতে বলেছে। হাতিয়ার দিয়েছে বেশ কয়েকটা।

তাহলে তো বেশ। তবে খুবই সাবধানে। বিভীষণ কিন্তু সবখানেই থাকে। যাবার আগে সুদীপের সাথে কথা বলে যেও। ওর সাথে কথা হয়েছে আগেই।

ও আছে আমাদের সাথে। প্রয়োজন হলেই ডাক দেবো। আজ উঠি স্যার। কিছু খেয়ে যাও। সকালে তো কিছু খাও নি এখনও মনে হয়।

বাড়ি যেয়ে খাবো, স্যার। আব্বা অপেক্ষা করছেন। উঠোনের চৌকিতে বসে আছেন ইরফান মুনসী। বাওড়ের দিকে দৃষ্টি। ঝাঁপা বাওড় রাজগঞ্জ হাই স্কুল ছুঁয়ে, একটু বেঁকে আছড়ে পড়েছে মানিকগঞ্জের এই অঞ্চলের পায়ে।

বড় রাস্তার পাশের জনপদের সারি সারি বাড়ির দক্ষিণ জানালা খুললে চোখে পড়ে স্বচ্ছ জলের ঢেউ। রোদে রোদে তারা খেলে যায় ঢেউয়ের বোঁটায়। সবুজ শেওলার পাতা ও ফুল পতাকার মতো দোলে। সামাদ বাড়ি ফিরে আস্তে আস্তে বাবার দিকে এগিয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে দূরের দৃষ্টিপথ জানতে চাইলো যেন।

ওই জলের ঢেউয়ে, সকালের এই প্রায়-সোমত্ত রোদে, নড়েচড়ে ওঠা নারকেল পাতায় বাবা-ছেলের একই ভাবনার দুলুনি। চপ্পলের পট পট শব্দে ফিরে তাকাল সামাদ। মা আসছেন। হাতে গামলা আর প্লেট। চৌকির একপাশে রাখতে রাখতে বললেন, হাত পা ধুইয়ে আয়।

খাইয়ে নে তুরা। সালামের মাদ্রাসা বন্দ দেছে কয়দিন। ও আসপেনে আইজ। খবর পাটায়েচে। ভালই হলো।

কথা আছে ভাইর সাথে। সামাদ আনন্দিত স্বরে বলল। ওর সাথে কী কথা বলবি, ফল হবে না। কেন আব্বা? গত সপ্তায় বাড়ি আইছিল, ওর কথাবার্তার ভাব ভাল না। দেখ, সামাদ।

এই দেশ আর কত অবিচার অনাচার শোষণ বঞ্চনার শিকার হবে! ওই বাওড়ের পানির মতো স্বচ্ছ বাংলার মানুষের মন। আর তাই নিয়ে খেলা করেছে দু:শাসকেরা। এদেরকে এবার খেদানোই লাগবে। এই জিনিসটা সালাম কেন বুঝতে চাইছে না, ভেবে অবাক হই। আমি কতভাবে বললাম, তাও মানাতে পারলাম না।

কথায় না মানলে ভাষা বদলাতে হবে আব্বা। এইবার দেশ স্বাধীনের প্রশ্ন। ২ চৈত্রের দুপুর কেবল গড়িয়েছে। রোদে তখনও ঝাঁঝ। সেই রোদের সাথে মিশেছে রাস্তার ধুলোঝড়।

পাকিস্তান আর্মীর খোলা জীপে দুই সারিতে বসে আছে ছয়জন জওয়ান। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসা সালাম মওলানা। অন্য সময় হলে গাড়ির পেছনে ছেলেমেয়েদের হই হল্লা শোনা যেত। এখন শুধু ইঞ্জিনের হু হু শব্দ। কঠিনমুখে বসে আছে সৈন্যরা।

ওদের চেয়েও শক্ত সালামের মুখ। বাড়ির সামনে এসে জীপ থামলো। ঘ্যর আ গ্যায়ে, আপলোগ আইয়ে। বিগলিত হয়ে হাত বেঁকিয়ে ইশারা করলো সালাম। খই ফোটার মতো বুটের আওয়াজ উঠলো মাটিতে।

ধুলো ছিটকে উঠে পথের পাশের কচিঘাস আর কচাগাছের সবুজ পাতা মলিন করে দিলো। সাতজোড়া বুট মাটির বুক খাবলে খাবলে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে দহলিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন ইরফান। উঠোনে সোরগোল শুনে ঘুম ভাঙল। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এলেন।

পাজামার ওপরে হাতাওয়ালা গেঞ্জি গায়ে। বিকেলের রোদে চিক চিক করছে তাঁর মেহেদি মাখানো চুল আর দাড়ি। ইয়ে মেরি আব্বুজি হ্যায়। আচ্ছা। তো কীয়া কারতা হ্যায়, ইয়ে…, আপকি আব্বু? তাচ্ছিল্যের হাত হাওয়ায় মেলে জানাতে চাইল একজন।

প্যাহলে মাদরাসা কি প্রিন্সিপাল থে। আব রিটায়ার র্কা চুকে হে। মসজিদ মে নামাজ পাড়াহ তে হে। ঈমাম ছাব হে। বোহোত আচ্ছা।

বোহোত আচ্ছা। ছালাম ছাব। ইরফান মুনসী কোনোরকমে হাত তুলে সালামের জবাব দিলেন। ইশারায় সালামকে ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। কি ব্যাপার রে।

আর্মী আমার বাড়ি কেন? আব্বা, এরা আজ রাতে আমাদের এখানে খাবে। রাজগঞ্জে ক্যাম্প হচ্ছে, এলাকায় যাতে দেশদ্রোহীরা হুটোপাটা না করতে পারে। এরা খুব ভাল। দেখলেন না, আপনারে কত সম্মান করলো? তুই, একজন মাদরাসার শিক্ষক। তোর বোধবুদ্ধি এই পর্যায়ের তা তো ধারণা করতে পারি নি আগে! কি কচ্ছেন আব্বা।

কত সাধের পাকিস্তান আমাদের। এরা সেই মূল অংশের লোক। দ্যাখেন না গায় গতরে চেহারায় কেমন রাজা রাজা ভাব। মূর্খ, তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর রাজাদেরও বের র্ক আমার বাড়ি থেকে।

আব্বা। রাগ করে লাভ নেই। পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে। আপনি প্রয়োজনে চুপ থাকেন। ওদের সামনে এইসব কথা বলবেন না।

আর, সামাদ কোথায়? ওর সম্পর্কে বাজারে কিছু কথা শুনলাম। ওকে সাবধান করে দিতে হবে। উঠোনের শেষে, ডানে দহলিজ ঘর। টালির ছাউনি, ইটের দেয়াল। জানালা দক্ষিণে বাওয়ের দিকে খোলা।

বিকেলে ওদেরকে চা নাস্তা খাইয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে সালাম। রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। নিজে খাশি জবাই দিয়ে ছুলে-কুটে রান্না করতে বলেছে মাকে। মা আগুনচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরে গিয়ে বসে আছেন। বউ, সালামের দিকে তাকায় নি পর্যন্ত।

শুধু ছোট দুটো সন্তানের দিকে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে চলে গেছে। কাজের মেয়ে রান্না করছে। সালাম পাশে বসা। থালাবাটি রেখে রেখে আসছে খাবার টেবিলে। টিমটিমে আলোয় দুটো হারিকেন জ্বলছে।

হাতিয়ার দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। একটু পর পর তাড়া দিচ্ছে। কীয়া হুয়া মওলানা ছাহাব। ইতনি দের্ কীঊ। পেট মে চুহা দৌঁড় রাহা হে।

হো গ্যায়া জ্বী। ছব খানা আভি আ’রাহা হে। কাজের মেয়েটাকে ধমক দিয়ে গোশতের পুরো পাতিল নিয়ে আসতে বললো সালাম। মাথায় ঘোমটা টেনে অতি সাবধানে টেবিলের এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল সে। খপ করে হাত থেকে পাতিল নিয়ে টেবিলে রাখলো সালাম।

ছয়জোড়া চোখ মেয়েটার দিকে। একজন বলে উঠলো, আহা, ইতনি শরমাতা কিউ হে। নাম কেয়া হে তেরা? রুটি বানানো হাতে লেগে থাকা শুকনো আঁটা খুটতে খুঁটতে মুখ আরও নামালো মেয়েটা। সালাম উত্তর দিলো, উসকা নাম, ঝরণা হে। ঝারণা ! ইয়া নে কি ব্যাহতা পানি।

ইয়ে তো জান্নাত কি প্যারী লাগরাহা হে। ইয়া মিঠা পানি মে ত্যায়ার তে হুয়ে মাছলি। নাজর আতেই খলবালি মাচতা হে দিলমে। হাঠাও, হাঠাও, পারদা হাঠা দো মুহ ছে। একজন উঠে গিয়ে ঘোমটা সরিয়ে দিলো ঝরণার।

ঝরণা এতটুকু হয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। পা ওঠাতে যাবে এমন সময় সৈন্যটা হাত ধরলো। বললো, ইয়ে চুলবুলি কইতর হ্যামে চাহিয়ে ছালাম ছাহাব। সালাম ওদের পাতে তরকারি আর রুটি তুলে দিতে দিতে আড়চোখে চেয়ে মুচকি হাসলো। ঝরণা মোচড় দিয়ে হাত ছিনিয়ে সমুদ্রে ঝাপ দেবার মতো উঠোনে নামলো।

জানালার পর্দা সরিয়ে একঝাঁক বাতাস ঘরে এলো। কাঠের পাল্লাদুটো সটান সরে গেলো দু’দিকে। সচকিত চোখে তাকাল সবাই। তারপর খাবার মুখে দেবার জন্য হাত উঠাল। সালাম দৃষ্টি সরালো না।

আস্তে আস্তে এগিয়ে আসা বন্দুকের নলে চোখদুটো বিস্ফারিত হতে লাগলো। কয়েক সেকেণ্ড। মুহূর্তেই গুলির আওয়াজ। একজন সৈন্যের মুখের কাছের মাংসখণ্ড ছিটকে সালামের চোয়ালে এসে লাগল। ঘরের এককোণায় গিয়ে কাঁপতে লাগলো সে।

অন্যান্যরা হেলান দেয়া অস্ত্র ওঠাতে যাবে, এমন সময় বারান্দা দিয়ে উঠে এলো দশবারো জন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁঝরা করে দিলো ওদের শরীর। চেয়ারের ওপরে, মাটিতে ময়লার ঢিবির মতো পড়ে রইল নি:সাড় দেহ। ইরফান মুনসীর হাতে গাছকাটা দা। আগে আগে ঘরে ঢুকে যে সৈন্যটা ঝরণার হাত ধরেছিল, তার নিস্তেজ হাতের ডানায় কোপ দিলেন।

হাতখানা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেলো। একটি হারিকেন টেবিলের কোণায় পড়ো পড়ো হয়ে জ্বলছে। আরেকটা নিচে পড়ে গিয়ে কেরোসিন ছড়িয়েছে। চিমনি ফেটে কাচের গুঁড়ো ভেজা কেরোসিনের ওপর। এক চাঙড়া আগুন হয়ে জ্বলছে হারিকেনটা।

সামাদ সৈন্যদের হাতিয়ার এক জায়গায় করলো। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো, এই তোরা এদেরকে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা কর। পয়লা অপারেশন, সাকসেস। দা উঁচিয়ে কোণার দিকে গেলেন ইরফান। উবু হয়ে বসে সালাম ভীত চোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।

ইরফান দা নামালেন না। কোপ দেবার ভঙ্গি করলেন। চোখ বুঁজলো সালাম। পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। কেঁদে লাভ হবে না।

তুই এইসব হারামীদের চাইতেও খারাপ। মাফ করে দাও আব্বা। আর এমন করবো না। একবার মাত্র মাফ করতে পারি, তাও এক শর্তে। সামাদের গ্রুপে কাজ করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। করবো আব্বা, করবো। আল্লাহর কসম, করবো। পয়লা সাজা হিসেবে তুই এখনই, এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হ। কোথায় থাকবি জানি না।

৩ মণিরামপুর থানা থেকে পুবদিকে ছিয়ানব্বই গ্রাম। এই গ্রামগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে তুলসীর ঘ্রাণ, শঙ্খনাদ আর সকাল-সন্ধ্যার উলুধ্বনি। থানায় এলাকার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প করেছে আর্মীরা। ধুলো উড়িয়ে টহল দিয়ে চলেছে। আজ আরও বেশি সাঁজোয়া যাত্রা ওইদিকে।

মৌচাকের মতো গেঁথে থাকা গ্রামগুলোর রাস্তায় শুধু ইঞ্জিনের শব্দ। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এলাকার কিছুলোক। তাদের মাঝখানে বসে আছে সালাম। চোখে আগুন। জীপটা আস্তে চললেও হালকা বাতাসে কালো আলখাল্লা পাজামার পায়ের দিক থেকে উড়ছে।

মাজা পর্যন্ত উড়ে গোল হয়ে আছে। মাজার গামছার কারণে পুরো শরীরে বাতাস ঢুকতে পারছে না। স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় মাঠে কিছু ছেলেরা ফুটবল খেলছে দেখতে পেলো। হুংকার দিয়ে গাড়ি থামাতে বললো। স্যার, ইনলোগোকে শিকসা দো।

ইয়ে লোগ দো’দিন বাদ মেরে ভাই কি তারাহ মুক্তি মে জায়েগা। ছব কাফের হে, পাকিস্তান কি খিলাফ হে। পাঁচটি জীপে জনা পঞ্চাশেক পাকিস্তানী আর্মী। দ্বিতীয় গাড়ি থেকে ওদের লিডার নেমে মাঠের দিকে গেল। ছেলেরা খেলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দুয়েকজন দৌঁড়ে পালাতে যাচ্ছিল। ফাঁকা গুলির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল। হাতের ইশারায় ওদেরকে ডেকে লিডার বলল, আগার পাকিস্তানমে র‌্যাহনা হে, তো পাকিস্তানি বানকে র‌্যাহনা পাড়ে গা। ওয়ারনা স্রিফ দো রাস্তে খোলা হে, এ্যক, মউতকি ছমুন্দর, দুছরা, হিন্দুস্তান। সালাম প্রতিটি বাক্যের বাংলা করে দিচ্ছে আরও উচ্চস্বরে।

যেন কথাগুলো ওরই। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটি ছেলে সাহস করে হাত তুললো। এগিয়ে এলো। বললো, হুজুর, আমি একটুখানি বলতে পারি? পেছন থেকে একজন বলল, এই বিশ্বজিৎ, চুপ করে থাক। মারা পড়বি।

বিশ্বজিৎ তার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আরেকটু সামনে এলো। সালাম বলল, বলো কি বলবা। হুজুর, এই দেশে আমার দাদা-বাবার জন্ম। আমারও। আমরা দেশবিরোধী কাজ করতে পারি এমনটা শুধু ধর্মের পার্থক্যের কারণে কেন ধারণা করা হবে।

এই দেশ-মাতার সেবা করবার সাধ তাঁর সব সন্তানের। রাগে গর গর করছে সালাম। উর্দুতে বুঝিয়ে দিলো ওদের বিশ্বজিতের কথাগুলো। লিডার সৈন্যটা, একটু মাথা চুলকালো, হুম লাগতাহে ইয়ে মুক্তি মে জায়েগা। ইছকো খতম র্কা দো।

পেছন থেকে একজন বন্দুক উঁচিয়ে জিপের সিটে বসেই গুলি চালাল। বিশ্বজিৎ লুটিয়ে পড়লো বিকেলের লালরোদ বিছানো ঘাসে। অন্যান্যরা দৌঁড়ে পালাল। সেদিন রাতে সমস্ত ছিয়ানব্বই গ্রাম পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। প্রায় প্রতিটা ঘরে আগুন।

অন্ধকারে ছেলে বুড়ো নারী শিশু আশ্রয় নিলো বাঁশবনে, ক্ষেতে কিংবার অন্য কোনো খানে। ভোর হবার আগেই গ্রামের প্রতিটি রাস্তায় পায়ের আওয়াজ। দুপদাপ দুপদুপ থপ থপ। প্রায়ভোরের অন্ধকার ধুলোয় ধুলোয় একাকার। পাক আর্মীর দ্বিতীয় হানার আগেই ওইপারে যেতে হবে।

সূর্য ওঠার কিছু পরে মণিরামপুর থেকে রাজগঞ্জ রোড হয়ে হানুয়ার পর্যন্ত জনস্রোত বিস্তৃত হলো। শান্ত নদীর ঢেউয়ের মতো অচঞ্চল অথচ ধাবমান। কারও কোলে শিশু। লম্বমান বাঁশের মাঝখানে ঝুলানো ঝুড়ির ভেতরে কারও বৃদ্ধা মা। একজন পোয়াতি বউ হাঁটতে পারছে না।

খুব ধীরে ধীরে পা ফেলছে। মানুষের ধাক্কায় পথের কিনারে এসে পড়ে যেতে যেতে স্বামীর হাত ধরে সামলালো। বসে হাঁপাতে লাগলো। জল জল, একটু জল দাও গো। আর পারতিছি নে।

চলো এই গিরামে থাইকে যাই। বাইচ্চাডাও আইসে পড়বে একুনি। ওগো, আমার সুনা-চানের কী হবে! স্বামীটা অঝোরে কাঁদছে। বউকে জড়িয়ে ধরে রাস্তা থেকে নামিয়ে একটি আমতলায় বসাল। মুখ তুলে দেখে, সারি সারি লোক দাঁড়ানো।

ওদেরকে দেখছে। হানুয়ারের পুবপাড়ার বউ-ঝিঁ, ছেলেমেয়েরা রাস্তায় মানুষের ঢল দেখছে। আর চোখের পানি মুছছে। কেউ কেউ জগে পানি ভরে গেলাস হাতে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে আবার এগিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো মুখগুলো।

কেউ কেউ না পেরে পানি খেয়ে গেলাস ফেরত দিয়ে মিশে যাচ্ছে ভীড়ের ভেতর। পোয়াতি বউটাকে ঘিরে বেশ লোকজন জড়ো হলো। একজন মহিলা দুয়েকজনকে থাকতে বলে, অন্য সবাইকে সরে যেতে বলল। চলার ক্লান্তিতে বউয়ের সারা গা ঘামে জবজবে। চুলভেজা।

সিঁদুর রক্তনদীর মতো বেঁকে কপাল বেয়ে দুচোখের গভীরে নামার উপক্রম। কাছের কোনো বাড়ি থেকে বালিশ আর কাঁথা আনা হলো। মহিলারা আঁচল কিছুটা খুলে খুলে আড়াল করে দাঁড়াল। ভেতরে রইলো একজন। কিছুক্ষণ পরে কান্নার আওয়াজ।

বাচ্চার গা মুছতে হবে। একজন তার শাড়ি ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরো করে বাচ্চার গা মুছে দিলো। কাঁথা কেটে অর্ধেক করে তাতে পেঁচিয়ে তুলে দেয়া হলো স্বামীর কোলে। ধাত্রী মহিলা বলল, তুমরা বাবা যাইয়ে না। আমাগের বাড়ি থাকো।

বাইচ্চা বড়ো হলি যাবা। না গো খালা। বলিচেন, এতেই আমরা খুশি। আমাদের গিরাম জ্বালাই দেছে। শুধু হিন্দু বইলে।

ইকেনেও নিস্তার দেবে না-নে। ভীড় ঠেলে একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, কিডা বইলেচে নিস্তার দেবে না। এই হানুয়ার গ্রাম এইরাম (এরকম) শক্ত ঘাঁটি, পাকিগের সুঁই পইন্ত (পর্যন্ত) ঢুকতি পারবে না। কামার পাড়ার হিন্দুগের আমরা পাহারা দিচ্ছি। আমাগের কারও বাড়ি আপনাদের থাকতি আপত্তি হলি, আমার বন্ধু নকুলরে খবর দিচ্ছি।

না না ভাই। আপনারা আর আমরা আলাদা কনে। দেশ-মাটি-মানুষ সব সুমান। আলাদা চোখি দ্যাখে শুধু ক্ষমতাবানরা। আমাদের বিদায় দাও ভাই।

ভগবান তুমাদের সুখি রাখুক। কষ্টের হাসি হেসে ছেলে কোলে, বউয়ের হাত ধরে আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠলো লোকটা। হানুয়ারের প্রান্ত আর মানিকগঞ্জের শুরুর স্থানে বড় একটা পুল। পুলের আগে রাস্তায় লম্বা বাঁশ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে আনিস। জনস্রোতে সেই অনিভিপ্রেত বাধায় থেমে আছে কিছুটা।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মাজা বরাবর বাঁশটা আড় করে রাখা। আনিস বলছে, টাকা দ্যাও, না হলি যাতি দেবো না। কেউ কেউ নির্লিপ্ত মুখে পকেটে হাত দিয়ে যা উঠছে ছুঁড়ে দিচ্ছে ওর দিকে। কারও কাছে কিছু না থাকলে গায়ের চাদর কিংবা শখের কাঁথাটা ফেলে দিচ্ছে। যাদের দেবার মতো কিছুই নেই, তারা করুণ দৃষ্টি দিয়ে হাতজোড় করছে।

গুড়ি মেরে পার হয়ে আবার হেঁটে যাচ্ছে। বাজার করা থলি এনেছিল আনিস। সেখানে এখন পয়সার কিচিরমিচির। দুপুর নরোম হতে চলেছে। আরেকজনকে দাঁড় করিয়ে থলি ওঠাতে যাবে এমন সময় মুখ থুবড়ে ক্ষেতের ঢেলার ওপর পড়ে গেল আনিস।

নাক ফেটে রক্ত ঝরছে। হুংকার দিয়ে উঠে ঘুসি উড়িয়ে থমকে দাঁড়াল। অস্ত্র তাক করে, একপায়ে দ্বিতীয় লাথি উঁচিয়ে চেয়ে আছে সামাদ। শোন্ আনিস। নাকের রক্তে ভুঁই ভিজিইচিস।

তোর মতো বেইমান বে-রহমের রক্তে এইবার বাংলার মাটিতে সার দেবো। আমারে মাফ কইরে দ্যাও, সামাদ ভাই। আর এইরকম হবে না। তুমি যা কবা তাই করবো। মুক্তিসেনায় আয়।

এই অঞ্চলে পাকিস্তানীদের একটা জুতোও ঢোকবে না। সাথে সাথে কেটে ফেলা হবে সেই পা। আনিস, পাশের বাড়ি থেকে পানি আর মুড়ি-পাটালি নিয়ে আয়। যারা খেতে চায়, দে। আমি আসছি।

বড়পুলের উপরে উঠে হাত তুলে দাঁড়াল সামাদ। দাদারা, আপনারা যাবেন না। থামেন। এই মাটি, এই দেশ আপনাদের। যাবে পাকিস্তানীরা।

আমাদের এই এলাকা মুক্তিসেনার দুর্জয় ঘাঁটি। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকেও সবরকম সাহায্য আসছে। এই দেশ মুক্ত আমরা করবোই। আমার গ্রাম মানিকগঞ্জ। দেখেন আমার সাথে কারা কারা আছে।

হানুয়ার, কোমলপুর, চণ্ডীপুর, মনোহরপুর এইসব গ্রামের সবাই আছে। এই এলাকার যে মাঠ, যে জায়গা ভাল লাগে তা আপনাদের। ঘর বানাতে সাহায্য করবো আমরা। তবু অনুরোধ করছি, এই দেশ ছেড়ে যাবেন না কোথাও। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

কোথায় থাকবেন, মা-বোন-বাচ্চাদের নিয়ে? কণ্ঠ ধরে এলো সামাদের। কুয়াশা-চোখে শুধু কালো কালো মাথা ভাসছে। ছোটবড় উঁচুনীচু। কমলা সূর্য কোমল স্রোতের মতো সরে সরে যাচ্ছে সেইসব এলোমেলো চুলে । ৪ রাজগঞ্জ মিলিটারি ক্যাম্পে আর্মী বাড়ানো হয়েছে।

এই এলাকা মুক্তিবাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, এইকথা মিথ্যে করবার জন্য অভিযানে নামবে তারা। হানুয়ার প্রথম টার্গেট। সেখানে কাদের বাস তা আসল কথা নয়। ওখানে কয়েকঘর হিন্দু বাস করলেও সব মুসলমানরা নাকি দেশটাকে আবার হিন্দুস্তান বানাবার চক্রান্তে লিপ্ত। ক্যাম্প থেকে চারটে আর্মী ট্রাক রওয়ানা দিলো মানিকগঞ্জের দিকে।

বড়পুলের কাছে এসে হাত-মাইক নিলো সালাম মওলানা। ‘এলাকাবাসী, হানুয়ারবাসী, কান খুলে শোনো। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রে তোমরা হিন্দুদের সাথে মিলিত হয়েছ, হিন্দুদের মতোই পরিণতি ভোগ করতে হবে। হানুয়ার গ্রামে সর্ষে ফলিয়ে ছাড়বো আমি। আজই মুক্তিরা আত্মসমর্পণ না করলে কাল অপারেশন শুরু।

’ বলতে বলতে হাত ইশারায় ড্রাইভারকে হানুয়ারের দিকে যেতে বলল। আর্মীর গাড়ির আনাগোনায় ও সালামের ধমকে এলাকা থমথমে। গাছের পাতা নড়ছে না। অন্যান্য দিন বড় রাস্তায় বিক্ষিপ্ত লোকজন গল্প করতে করতে বাজারে যায়। রাতে আবার সেভাবে বাড়ি ফিরে আসে।

আজ সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। যেন কেয়ামত কাল। ছিয়ানব্বই গ্রামের কথা শুনেছে সবাই। অসহায় মানুষের স্রোতে দেখেছে। দেখেছে নবজাতকের মৃত্যু।

বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবা দৌঁড়োছে। একটু গেলেই যেন বেঁচে উঠবে তার সন্তান। ঝুঁড়ির ভেতর মৃত মাকে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে চলছে দু’সন্তান। এই ভূমি মরার পরেও কি তাদের আশ্রয় হতে পারতো না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুর ধারায় দেখেছে এই জনপদের নরনারী, কীভাবে প্রসূতি তার সন্তান প্রসব করে মৃত ভেবে প্রাণের ভয়ে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে।

তিন বছরের মেয়ে কোলে কখন মরে আছে টের পায় নি পিতা। পাশে হেঁটেচলা মা’কে বলেনি। শেষে কান্নায় চলা থেমে যায়। উফ, অবিশ্বাস্য। এই চোখ দেখেছে কি এমন! কাল কি তাদেরও পরিণতি তেমন হতে চলেছে! * সন্ধ্যা পেরিয়েছে।

চারদিকে আলো কমেনি তবু। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ দুষ্টু শিশুর মতো পৃথিবীর দিকে হেসে আছে দিগন্তে। জ্যৈষ্ঠ’র মাঝামাঝি এই সময়ে বাতাসের মেজাজও ফুরফুরে, ঘ্রাণময়। প্রদীপ সেনের বাড়ির পেছনের কাঁঠালবনের বাতাস ম ম করছে।

তার কিছু ঘ্রাণ এই দহলিজের প্রায়ঘন অন্ধকারে বসে থাকা মানুষের মুখচোখ ছুঁয়ে আছে। খাটের ওপরে সারি সারি বসে থাকা ছায়ামূর্তিগুলোর হাত শক্ত হয়ে আছে। চোখে জীবন-মরণের পণ। সামাদ ও প্রদীপ মুখোমুখি। সুদীপ দাঁড়ানো।

প্রথম শুরু কোথা থেকে করবা, সামাদ। বাড়ি থেকে। আমাদের বাড়ি থেকে স্যার। তারপর ক্যাম্প। মানে? সালামরে আর রাখা যাবে না।

কী বলছো, সামাদ। ও তোমার মায়ের পেটের ভাই। ছিল । এখন নেই। ও আমাদের সব ঘাঁটি জেনে গেছে।

দিনে দিনে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ওকে পাবা কীভাবে। ওর সাথে তো আর্মী থাকে। আজ বিকেলে ধমক দিয়ে মনে করেছে এলাকা ওদের আয়ত্বে। বিকেলে বাড়ি এসেছে।

একা একা। হাসছে ঘন ঘন। সুদীপ, তুমি ক্যম্প অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে। গফুর তোমার এসিসট্যান্ট। স্যার, আপনি থাকবেন আমার সাথে।

সামাদ, তুমি নিজ হাতে… । না, স্যার, নিজ হাতে না। লোক আছে। তবে আমি নিজ চোখে দেখবো। আমি না গেলে হয় না? একজন বাবা হয়ে আমি এই দৃশ্য কীভাবে দেখবো বলো।

বন্ধুর সন্তানের মরণ! তা’ছাড়া ও আমার ছাত্র। স্যার! আপনি…। আপনি বলছেন এমন কথা? শক্ত করেন মন। এখন আমাদের সামনে শুধুই দেশ। দেখেন, এই সন্ধ্যার চাঁদ কেমন চুপি চুপি আলো জ্বেলে আছে আমাদের আকাশে।

আমাদের রসময় ঋতু পাকাফলের ঘ্রাণে কেমন ভরিয়ে তুলেছে বাতাস। এই বাতাসে আর কদাকার নিশ্বাস যেন না পড়ে। আগে বাড়ি এসে মাঝে মাঝে দহলিজ ঘরে ঘুমাতো সালাম। সেদিনের ঘটনার পর ভয়ে আর ওখানে যায় না। মাঝের ঘরে একা শুয়ে আছে।

দু’দিন আগে ওর বউ, বাচ্চাদুটোকে নিয়ে কোমলপুর বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। চাঁদ এখন মাথার উপরে। এত তীব্র জোছনা আগে দেখে নি সামাদ। নাকি এমন করে দেখা হয় নি। কাঁধে হাতিয়ার ঝুলিয়ে গায়ে গামছা জড়িয়ে প্রদীপের দহলিজ থেকে রাস্তায় নামলো কয়েকটা ছায়ামূর্তি।

বাতাস আরও গন্ধভারাতুর। গন্ধরাজ কি? নাকি পথের পাশের অজানা এমন কোনো ফুল যার নাম জানা নেই। ঘ্রাণও চেনা চেনা অচেনা। এই ক’মাসে কতবার কত জায়গায় অপারেশনে গিয়েছে সামাদ। প্রতিবার বের হবার সময় জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ভেবেছে।

জীবনের যবনিকা যদি আজ হয় তবে আজকের মতো সুদিন আর নেই। শহীদের রক্ত থেকে জন্ম নেবে অজস্র মুক্তিসেনা। বিজয়ের দেরি নেই। হয়ত কালই। বিকেলের জনস্রোতে বার বার চোখের তারায় ফিরে ফিরে আসে।

বড়পুলের পরে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পায় ওই বেনাপোল বর্ডার। ম্লান গোধুলির আলোয় এই দেশের চিরহাস্যময় প্রাণস্রোত মিলিয়ে যাচ্ছে অজানা দেশের রেখায়। একটা ঢেলায় হোঁচট খেলো সামাদ। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। একটু সময়ের জন্য ঝুঁকে ব্যথাস্থানটা ডলে দিয়ে হাঁটছে আবার।

বাড়ির পাশে এসে থামলো। লোক পাঠিয়ে জেনে নিয়েছে কোন্ ঘরে ঘুমিয়েছে সালাম। মা-বাবা দু’জনই বলেছে মাঝের ঘরে শোবে ও। কাছে অস্ত্র নেই। মুখের গামছা টেনে কয়েকজন গুটিপায়ে এগোল।

নীরব চারপাশ। বাড়ির পেছনে, কলার পাতায় দু’ফোঁটা শিশির শব্দ তুললো শুধু। মাঝের ঘরের পেছনের জানালা খোলা। একজন আলতো করে চোখ রাখলো। কলাপাতা পিছলে একটুকরো আলো পড়েছে সালামের গায়ের ওপর।

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। একটা বন্দুকের নল উঁচু হলো। সামাদ ইশারায় মানা ক’রে, আঙুল দিয়ে বাতাসে অর্ধবৃত্ত এঁকে দরজা দেখিয়ে দিলো। প্রথমজনের লাথিতে দড়াম করে শব্দ হলো। দ্বিতীয়জন একটু দূর থেকে দৌঁড়ে এসে ঘাড় কাত করে ধাক্কা দিতেই হা হয়ে গেলো দরোজা।

সালাম তড়াক করে উঠে ঘুমচোখে ঘুরতে লাগলো। প্রচণ্ড ঘুসিতে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। ধরে ফেলে বাইরে টেনে আনলো ওরা। ভয়ে স্বর বের হচ্ছে না সালামের। আর্ত ক্ষীণস্বরে বলছে, তুমরা কারা।

ভাই, ভাই তুমরা কারা। আমারে মাইরে না। সামাদ কনে ? সামাদ কনে? শেষ শব্দ উচ্চারণের পরই ব্যথায় ককিয়ে উঠলো সালাম। একজন বুকে নল ঠেকিয়ে গুলি করলো। অন্যজন ধরে শুইয়ে দিলো মাটিতে।

নিথর হয়ে গেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সামাদ। চাঁদটা একেবারে টর্চের মতো আলো ফেলে আছে মৃতদেহের ওপর। উঠোনে লাল আলোর নদী, বয়ে চলেছে বাওড়ের দিকে। *** প্রকাশিত : শব্দতরী, ২০১৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।