আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেধা লালন না মেধা দমন?

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মেধা লালন করার। সেই দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করতে না পারলেও সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা মেধা দমনের অভিযানে অনেকটা সফল হয়েছেন বলা যায়।
সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ’ কোনো সরকারই সংবিধান অগ্রাহ্য করতে পারে না। তবে বাংলাদেশে পূর্বাপর সব সরকারই এই সমতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলেছে সরকারি কর্মকমিশনে অন্যায্য কোটাপদ্ধতি বহাল রেখে।

পৃথিবীর সব দেশই সমাজে যারা পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর, তাদের সামনে নিয়ে আসতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা অন্যায় নয়।
বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন যখন প্রশংসিত, তখন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা আহমদ শফী এই বলে সারমন জারি করেন যে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া বা উচ্চতর শিক্ষা নেওয়া চলবে না। তারা বড়জোর চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করবে সংসারের হিসাব-নিকাশ করার জন্য। এ রকম মানবতাবিরোধী ফতোয়ার বিরুদ্ধে যখন কোনো মহল থেকেই জোরালো প্রতিবাদ দেখি না, তখন মনে হয় কেবল সরকারি কর্মকমিশনে নয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করা দরকার।

নারীরা অধিক সংখ্যায় ঘর থেকে বাইরে এলে এই ফতোয়াবাজেরাই ঘরে ঢুকতে বাধ্য হবেন।
একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের বিষয়টিও দেখতে হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু সেই দেখা সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ করে হবে না, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে। যে দেশে মুক্তিযোদ্ধারা এখনো ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন এবং চিকিৎসা করাতে পারছন না অর্থের অভাবে, সে দেশে চাকরিতে কোটা নির্ধারণ করে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আর এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, মুক্তিযোদ্ধা স্বজনের নামে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছেন।

অতএব, বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সাম্প্রতিক অঘটনের কারণ কোটা নয়, পিএসসির তুঘলকি সিদ্ধান্ত।
পিএসসি যে যুক্তিতে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোটাপদ্ধতি চালু করেছে, সেই যুক্তিতেই কোটাপদ্ধতি বাতিল বা হ্রাস করা উচিত। যদি বিশেষ কোটায় যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া না যায়, তাহলে সেই কোটা রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে? পিএসসিকে বুঝতে হবে, বৈষম্যমূলক সমাজে কোটাব্যবস্থা থাকে বৈষম্য কমাতে, বাড়াতে নয়। কিংবা অমেধাবীদের পুনর্বাসন করতেও নয়।

মেধাপদ্ধতি পুরো বাতিল করা না গেলেও এর সংস্কার প্রয়োজন। অপব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।
সবার আগে বোধ করি সংস্কার প্রয়োজন পিএসসি নামের প্রতিষ্ঠানটির। অতীতে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল। আবার পিএসসির ওপর ক্ষমতাসীন দলের নানা রকম চাপের কথাও অজানা নয়।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পিএসসির সদস্য ছিলেন, যিনি নানা কারণে মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি, ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এদের নিয়োগ দিতে হবে। ’ পিএসসিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মৌখিক পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ সব সময়ই ছিল। লিখিত পরীক্ষায় প্রার্থী বেশি নম্বর পেয়েও মৌখিক পরীক্ষায় বাতিল হওয়া কিংবা লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েও মৌখিক পরীক্ষায় টিকে যাওয়ার মন্দ নজির ভুরি ভুরি আছে।
পিএসসির দায়িত্ব মেধা লালন। মেধাবী তরুণেরা যাতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেতে পারেন, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া।

অযোগ্যদের দিয়ে যোগ্য জনপ্রশাসন গড়ে তোলা যায় না।
৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যখন কোটার ভিত্তিতে ফল প্রকাশ করা হলো, তখন দেখা গেল যে সাধারণ পরীক্ষার্থী ৮০ পেয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি, কিন্তু কোটাধারীরা ৫০ পেয়েই উত্তীর্ণ হয়েছেন। এটি চরম বৈষম্য ও অন্যায়। সাধারণ পরীক্ষার্থীরা বিষয়টি মানতে পারেননি বলেই রাস্তায় নেমে এসেছেন। গত বুধবার তাঁরা দিনভর শাহবাগে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেছেন।

সেই বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বৃহস্পতিবার তাঁদের বিক্ষোভের সময় সহিংস ঘটনা ঘটে, পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ বিনা উসকানিতেই তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবারের এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, সিলেটের শাহজালাল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকে এটিকে গত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একমাত্র আন্দোলন বলেও অভিহিত করছেন।

তবে সেই আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়া কিংবা উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়ে হামলার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। অন্যদিকে সেই হামলা ঠেকাতে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা যেভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা মাস্তানি ছাড়া কিছু নয়। মেধাবী ছাত্রদের একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনকে জামায়াত-শিবিরের অপতৎপরতা বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যদি কোটাপদ্ধতি রাখাকে ন্যায়সংগত মনে করেন, তাহলে তাঁরাও এর পক্ষে মিছিল-সমাবেশ করতে পারতেন। ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, তাঁদের কর্মীরা এ ঘটনা ঘটাননি।

তাহলে কারা ঘটিয়েছে, তা খুঁজে বের করা হোক।
পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের ভুলত্রুটি শুধরে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বলেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ভুলত্রুটি সংশোধনের যে নমুনা দেখাল, তাতে মনে হয় না যে প্রধানমন্ত্রীর কথা তারা আমলে নিয়েছে। আগেও প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের এ ধরনের সদুপদেশ খয়রাত করেছেন, কাজে লাগেনি। এবারও যে লাগবে, সেই ভরসাও কম।


দুর্ভাগ্যজনক হলো, কোটা নিয়ে কোনো সরকারই সাহসী ও সৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তারা আবেগকে কাজে লাগিয়েছে আর দুর্নীতির পথ করেছে প্রশস্ত। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখন দেখা গেল যে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স নেই, তখন সরকার বিকল্প কিছু করতে পারত। কিন্তু সেটি না করে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের জন্য সেই কোটা নির্দিষ্ট রাখে। ফলে কোটা নিয়ে নানা জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।

আমরা দেখেছি, সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দিল, তখন অনেকেই সার্টিফিকেট জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে, আর সার্টিফিকেট জোগাড় করা হয়েছে ২০১০ সালে। এই মুহূর্তে আমরা কোটাপদ্ধতি একেবারে বাদ দিতে বলছি না। তবে কোটার পরিমাণ কোনোভাবেই সাধারণের চেয়ে বেশি হতে পারে না। এখানেই বঞ্চিত মেধাবীদের আপত্তি ও ক্ষোভ।

সরকারি কর্মকমিশনে এখন যে ৫৫ শতাংশ কোটার মাধ্যমে বাছাই করা হয়, সেটি যুক্তিসংগত নয়। রাজনীতিতে অনেকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল মাঠের কথা বলেন। কিন্তু জনপ্রশাসনে চাকরির ক্ষেত্রে নয় কেন?
কোটাপদ্ধতি বাতিলের পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি কোটা রাখার পক্ষেও যুক্তি থাকতে পারে। কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে মেধাবীরা আন্দোলন করলে অমেধাবীরা কোটা রাখার পক্ষেও আন্দোলন করতে পারেন; কিন্তু তাই বলে মাস্তানি করতে পারেন না। আগে বিসিএস পরীক্ষায় কোটাপদ্ধতি থাকলেও তা বিবেচনা করা হতো প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে।


সেখানেও বৈষম্য থাকলেও তুলনামূলক কম। একজন সাধারণ পরীক্ষার্থী ৮০ পেয়ে উত্তীর্ণ হতেন আর কোটাধারী পরীক্ষার্থী ৭৫ পেয়ে। কিন্তু এবারে পিএসসির তুঘলকি সিদ্ধান্তের কারণে মেধাবীরা অনেক বেশি পরিমাণে বঞ্চিত হলেন। যেখানে ৮০ পেয়েও একজন সাধারণ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে পারেননি, সেখানে ৫০ পেয়েই আরেকজন কোটাধারীর অনায়াসে উত্তীর্ণ হওয়া কেবল অস্বাভাবিক নয়, অন্যায্যও।
পিএসসি যদি এই কাণ্ডই করবে, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার কী দরকার ছিল? তারা সোজা বলে দিতে পারত, পরীক্ষা-টরীক্ষার দরকার নেই।

আমরা যাদের যোগ্য মনে করব, তারাই পাস করবে এবং চাকরি পাবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের জনপ্রশাসনে যে যোগ্যতা ও মেধার দুর্ভিক্ষ চলছে, তার জন্য পিএসসির কোটাপদ্ধতিও কম দায়ী নয়।
প্রথম আলো অনলাইনে একটি লেখায় দুই মেধাবী পরীক্ষার্থীর চিঠি উদ্ধৃত করায় বহু পাঠক তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করেছেন। সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের বঞ্চিত রাখায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।


আমার লেখায় চিঠি পড়ে চোখে জল আসার কথা বলেছিলাম। এর প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ লিখেছেন, ৪২ বছর ধরে রাষ্ট্রের বৈরী আচরণের কারণে মেধাবীদের চোখের জল অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। এখন চোখে জল আসবে কী করে!
আবার দু-একজন পাঠক ওই লেখায় জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন করার গন্ধও পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জেনে রাখা দরকার, যে দুই তরুণের চিঠি উদ্ধৃত করেছি, তাঁরা কখনোই জামায়াত-শিবিরের সদস্য হতে পারবেন না নাম ও পৈতৃক পরিচয়ের কারণেই। তাই বলব, সবকিছুতে জামায়াত-শিবির খোঁজা ঠিক নয়।

মেধা লালন না করে মেধা দমন করার জন্যই যে দেশের এই হাল হয়েছে।
সাড়ে চার বছরের মাথায় এসে মহাজোট সরকার যে সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলেছে, সেটি যতটা না প্রশাসনের অসততার জন্য, তার চেয়ে বেশি অযোগ্যতার জন্য। অতএব, মেধা দমনের সর্বনাশা পথ পরিহার করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।