আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হযরত খাদিজা (রাঃ) এর মর্যাদা ও মহাত্ম্য

’নারী’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হয় বিলেত থেকে। মাননীয় সম্পাদক থেকে নারী বিষয়ক একটি লেখার অনুরোধ পেলাম, ভাবলাম নারীদের সম্পর্কে কি ই বা লেখা যায়। তবে এ নিয়ে আমার আর ভাবনা করতে হলো না, অভিজ্ঞ সম্পাদক নিজেই বিষয় ঠিক করে দিলেন। তখন সর্বপ্রথমে মাথায় আসলো নারীদের আদর্শ হিসাবে কাউকে নিয়ে লিখবো। প্রায় দীর্ঘদিন পরে যখন আবার তাড়না পেলাম তখন খুঁজতে লাগলাম, অনেক নারীদের কিন্তু আদর্শ হিসাবে দাঁড় করানো যায়।

মুসলিম সমাজের নারীদের আদর্শ হিসাবে সর্বপ্রথম যিনি আসেন তিনি হচ্ছেন এমন একজন মহায়সী নারী যার কাছে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন সালাম পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তিনি হচ্ছেন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ)। উনাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমি শুধু তাহার মাহাত্ম ও মর্যাদা নিয়েই লিখবো। তিনি দেখিয়েছেন স্বামী সেবা করে কি ভাবে সুখী হওয়া যায়।

অথচ রসুল (সঃ) বয়স ছিল উনার চাইতে প্রায় অর্ধেক। তিনি ছিলেন বিত্তশালী ব্যবসায়ী এবং বিধাবা। এমন এক দুঃসময়ে তিনি রাসুল্লাহ (সঃ) এর জীবন সঙ্গীনি হয়েছিলেন যখন বিশ্ব নবী ছিলেন চিন্তাক্লিষ্ট, অসহায়, বিপদগ্রস্থ ,অভাবে জর্জরিত ও শত্রুকূল দ্বারা পরিবেষ্টিত। চারিদিকে তাহাকে তিরষ্কার করা হচ্ছে। এতো দুর্নাম হয়েছিল যে দ্বাড়াবার পর্যন্ত ঠাই ছিল না।

এমন কি আপন পরিজন এবং স্বজনরাও তাহাকে হত্যা করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল। তখনকার সময়ের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, কবিসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত তাহাকে পাগল বলে অখ্যায়িত করেছিল। আশা নিরাশার চরম সন্ধিক্ষণে যখন বিশ্বনবীর সাধনার তরী অথৈ জলে ভাসছিল ঠিক তখনি আবির্ভাব হলেন হযরত খাদিজাতুল কোবরার। তিনি তাহাকে শুধুই কাজ দিলেন না, পরমস্নেহে আশ্রয় দিয়ে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে অসীন করলেন মর্যাদার চরম শিখরে। অসহায়কে আশ্রয় দিলে যে আল্লাহতায়ালা সহায় হন এর প্রমাণই এই মহীয়সী।

ঠিক সেই দিন থেকেই তিনি বিশ্বের নারীদের জন্য আদর্শ হয়ে আভিভূত হলেন। নিজের সম্পূর্ন সত্তাকে পরিপূর্ণরুপে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সেবা যত্ন ও ভালোবাসার সাগরে বিলিন করে দিয়েছিলেন। সেখানে ছিল না কোন কৃত্রিমতা বা শূন্যতার সামান্যতম অবকাশ। তিনি ছিলেন স্বামীর সংগ্রামী কর্মী এবং কর্মপ্রেরণা উৎসাহ দাত্রী। স্বামীর সাধনায় সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন একান্ত সঙ্গিনী ও সম অংশীদার।

প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলায় ভগ্নোদ্যম হতাশায়, দুর্গম পথ যাত্রায় তিনি ছিলেন উৎসাহ প্রদায়িনী। ভয়-ভীতিনাশিনী, আশাতরু সঞ্চারিনী, একান্ত সহগামিনী ও আলোর মশাল বৈরিনী এক আদর্শ সহধর্মিনী কুল মাখলুকাতের গুল বাগিচার যিনি খায়রুলবাশার হিসাবে পরিচিত। যার নুরানী কায়া দর্শনে নরকাগ্নি নির্বাপিত হয়ে যায়। যার অক্ষয় মধুর বানী শ্রবনে শ্রবনন্দ্রীয় সার্থকতার দোয়ার প্রান্তে উপনীত হয়। সেই পরম সত্ত্বার পত্নীর পদ লাভ করা কি কম সৌভাগৌর কথা? বিবি খাদিজা (রাঃ) এ দিক দিয়ে প্রকৃতই সৌভাগ্যবতী ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারীনি।

তার প্রেম ভালোবাসা এতোই প্রখর ছিল যে তার জীবদ্দশায় রাসুল (সঃ) দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি। মেয়েদেরকে স্বামীর ভালোবাসা পেতে কি করতে হয় তার প্রকৃত নমুনাই ছিলেন তিনি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সর্ব প্রথম বিবি খাদিজা ধন সম্পদই অবদান রেখেছে। তিনি এতো দান করেছিলেন যে পরে নিজের জন্য অবশিষ্ট কিছুই ছিল না। তাহাকে কেউ তিরষ্কার করলে তিনি জবাব দিতেন অনুগত্য করে।

স্বামী প্রায়ই বলতেন, হে প্রভু দয়াময় সংসার জীবনে তুমি আমাকে খাদিজা (রাঃ) মতো শ্রেষ্ট নারী রত্নকে দান করে আমার জীবনকে ফুলে, ফসলে ও সুরভীতে বিমোহিত করে দিয়েছ। খাদিজা দ্বারা আমার জীবনকে ধন্য করে তুলেছ। রাসুল (সঃ) একবার আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর কথায় মনক্ষুন্ন হলেন। পরে জিজ্ঞাস করলেন হুজুর আপনার হয়েছেটা কি যে একজন বৃদ্ধা মহিলা তাও তিনি মারা গেছেন, তার কথা আপনার মনে পড়ে। আল্লাহপাক আপনাকে তার চেয়ে উত্তম কুমারী এবং সুশ্রী স্ত্রী দান করেছেন।

প্রতি উত্তরে রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, হ্যা আয়েশা তোমরা যা ভেবেছো তা নয়। যখন মানুষ আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, তখন আমি যে সত্য তা মেনে নিয়েছিল। এমন কি একটি কথাও বাড়ায়নি। আমাকে যারা সারা বিশ্বের মানুষেরা অবিশ্বাসী বলতো তখনি সে আমাকে বিশ্বাসী করেছে। যখন গোটা পৃথিবীর মানুষেরা ছিল আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী তখনই এই খাদিজা (রাঃ) মুখ থেকেই বের হয়েছিল লা ইলাহইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ (সাঃ)।

আর শোন হে আয়েশা আমি যখন অসহায় ছিলাম, যখন কেউ আমার সাহায্যকারী ছিল না এবং ঘৃনা ভরে প্রত্যাখান করেছে, তখন খাদিজা (রাঃ) আমাকে সাহায্য করেছে। সম্পূর্ন উজার করে ভালোবেসেছে। তখনকার যুগে আরবে নারীদের মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। তিনিই প্রথা ভেঙ্গে নারীদের স্বাবলস্বী করতে সহায়তা করছেন। ইসলাম নারীদের যথাযত মর্যাদা দেওয়ার পরে তিনি নারীদের কল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশ করেন।

সে বিধবা নারীদের বের করে এনে তাদের আশ্রয়ে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। অবসর সময়ে সুই দিয়ে সেলাই এবং রান্না করতেন। অ-শিক্ষার অথল গহব্বর নিমজ্জিত আরবী মহিলাদের তিনি তার বাড়ীতেই হুজুর পাক (সঃ) থেকে শিখে নিয়ে কালামুল্লাহ সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। রাসুল (সঃ) ঔরষজাত সব ক’টি সন্তানই বিবি খাদিজা (রাঃ) গর্ভের। তিনি আদর্শ কন্যা, আদর্শ ব্যবসায়ী, আদর্শ স্ত্রী এবং আদর্শ মাতা।

একাধারে এতো গুণের অধিকারী হওয়া এক বিশাল ব্যাপার। তাহার পিতা খোয়াইলিদ একজন বিত্ত্ববান, সসক্ষান্ত ব্যক্তি ছিলেন এবং মাতা ছিলেন আমের ইবনে খুয়াই বংশের। নাম ছিলো ফাতিমা বিনতে জাহেদা। তিনি তাদের একমাত্র কন্যা বলেই জানা যায়। তাহার এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু কোন সন্তান ছিল বলে তথ্য নেই।

তিনি হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরেই সম্পূর্ন সুখ লাভ করেন। তাহার গর্ভজাত সন্তানদের দ্বারাই রাসুল (সঃ) এর বংশধারা বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত হয়েছে। তারাই হচ্ছেন আহলে রাসুল, আহলে বাইত এর মর্যাদা সম্পন্ন। খাদিজা (রাঃ) এর বান্ধবীদের ভাষ্য মতে আরো জানা যায় যে তিনি যত কষ্ট ব্যথা পেয়েছিলেন তা লাঘব করার জন্যই তিনি অসহায়দের সেবাকেই বেছে নিয়েছিলেন। ইসলামের বীজ বপন করতে তাহাকে যে ত্যাগ করতে হয়েছে, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনন্ত কাল।

তাই তো স্বয়ং আল্লাহর রাসুলে (সঃ) গর্ব করে বলতেন, আমি মোহাম্মদ (সঃ) এর পেছনে যার ভূমিকা বেশি সেই হলো খাদিজাতুল তাহেরা। উনার সস্পর্কে আরো অনেক লিখার ছিলো কলেবর বৃদ্ধি পাবে তাই সম্পাদকের কথা অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত ভাবেই উনাকে উপস্থাপিত করলাম। অবশেষে উনার ইন্তেকাল হলে রাসুলে পাক নিজ জামা দিয়ে কাফন পরিয়ে কবরে নামিয়েছিলেন। শোকে মুহ্যমান মহানবী কবরের পাশে ইয়াতিমের মতো দ্বাঁড়িয়ে ছিলেন। কোনভাবেই সরছিলেন না।

সে দৃশ্য দেখে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা মালাইকা জীব্রাইল (আঃ)কে পাঠিয়ে আশ্বাস ও শান্তনা দিয়ে উনাকে বাড়ীতে পাঠিয়েছিলেন এবং পুরোটা বছর তিনি শোকের বলে কাটিয়েছিলেন। হযরত খাদিজা (রাঃ) দুনিয়া এবং আখেরাতের সেতু বন্ধন ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। জীবনে যতোখানি অবদান রেখে গেছেন, পরবর্তীকালে রমনীকুলের জন্য অনুকরনীয় হয়ে থাকবে। এতে কোন সন্তেহ নেই। তাহার মর্যাদার আসনে তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে চিন্তা ও করা যায় না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.