আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনগণের সীমাহীন দুর্ভোগ এবং পণ্ডিতের গল্প

কি বলব পাঠশালায় পণ্ডিত ছাত্রকে পড়াচ্ছেন— বেগুনং বেকনং অর্থাত্ ‘বেগুন বাঁকা’। ছাত্র পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করল, ‘বেগুনং বেকনং কারণং’ অর্থাত্ ‘বেগুন বাঁকা কারণ কী’? পণ্ডিত বললেন, ‘তেতুলং বেকং দেখং বেগুনং বেকং’, অর্থাত্ তেতুল বাঁকা দেখে বেগুন বাঁকা হয়েছে। এবার ছাত্র জিজ্ঞেস করল ‘তেতুলং বেকনং কারণং’ অর্থাত্ তেতুল বাঁকা কেন? পণ্ডিত বললেন, ‘চন্দ্রনং বেকং দেখং তেতুলং বেকং’ অর্থাত্ চাঁদ বাঁকা দেখে তেতুল বাঁকা হয়েছে। এবার ছাত্র জিজ্ঞেস করল, ‘চন্দ্রনং বেকং কারণং’ অর্থাত্ চাঁদ বাঁকার কারণ? এবার পণ্ডিত কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে রেগে গিয়ে বললেন—চাঁদ বাঁকা হয়েছে তো তোর কী হয়েছে? তোর এত কথা জানার দরকার নেই, তার চেয়ে তুই পড় ‘হয়েছে তো হয়েছে’। ছাত্র পড়ছে হয়েছে তো হয়েছে, হয়েছে তো হয়েছে।

বলছিলাম যুগ যুগ ধরে চলে আসা অসঙ্গতির কথা। সরকার বদল হয় অসঙ্গতিগুলো সবাই দেখে, কিন্তু দূর হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে বিএনপি সরকারে থাকলে আগের আওয়ামী লীগ সরকারের দোষ দেয়, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে পূর্ববর্তী সরকার বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। অর্থাত্ যুক্তিতে না পারলে কমন উত্তর—‘হয়েছে তো হয়েছে’। কুমিল্লার মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই পৃথিবী বিখ্যাত।

যারা কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই খেয়েছেন তারাই বলতে পারবেন এটি কতটা খাঁটি এবং সুস্বাদু। এদেশের মানুষ তো বটেই, বিদেশি অতিথিদেরও লাইন লেগে থাকে এই রসমালাইয়ের জন্য। সুযোগসন্ধানীরাও বসে নেই। যদিও মাতৃভাণ্ডারের কোনো শাখা নেই, কিন্তু কুমিল্লা শহর থেকে শুরু করে দাউদকান্দি পর্যন্ত অন্তত ২০০টি মাতৃভাণ্ডার নামের রসমালাইয়ের দোকান। এসব ভুয়া মাতৃভাণ্ডার নামের রসমালাইয়ের চেয়ে দুধ দিয়ে চিনি মিশিয়ে আটার রুটি খেলে বেশি স্বাদের মনে হবে।

অনেকের মতো আমিও আসল-নকল না বুঝে প্রতারিত হয়েছি। অনেক প্রতারিত ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছি—ভাই এই মাতৃভাণ্ডার কি আসল মা, নাকি সত্মা? ঢাকায় মুসলিম সুইটসের মিষ্টির স্বাদও এমন যে অনেকের জিভে পানি ধরে রাখতে পারে না। সেই মুসলিম সুইটসের বিশুদ্ধতা এবং সুনাম ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মুসলিম সুইট্স নামের মিষ্টির দোকান। কিংবা বনফুলের মিষ্টি, ভাগ্যকূল, মধুবন, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমসহ সব বিখ্যাত মিষ্টির নামেই নকল মিষ্টির দোকান প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে। প্রতারিতও হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

কিন্তু কেন এই অনিয়ম দীর্ঘদিন চলছে? এ প্রশ্নের উত্তর গল্পের পণ্ডিতের মতো ‘হয়েছে তো হয়েছে’! কুমিল্লার দেবিদ্বারের বাকসার বাজার থেকে গুনাইঘর হয়ে দেবিদ্বারের রাস্তাটির অবস্থা নতুন করে বলতে হবে না, কারণ সারা দেশের মানুষই জানেন রাস্তাঘাটের কী বেহাল দশা! রিকশা উল্টে গিয়ে ৭ মাসের গর্ভবতী শাহীনূরের স্বপ্ন ভেঙে যায়। জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে শাহীনূর বেঁচে গেলেও তার সন্তান এবং ভবিষ্যতে সন্তান ধারণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে যায় তার সংসারটিও। তার স্বামী তাকে তালাক দেয়। শাহীনূর আশ্চর্য হয়ে ভাবে—তার কী দোষ ছিল? সে রিকশাও চালায়নি কিংবা রাস্তাও নষ্ট করেনি; কিন্তু তবুও কেন সব হারাল সে? এরকম কতজনের কথা আমি বলব? তারেক মাসুদ, মাশুক মুনীরের মৃত্যুর পরপর হৈ চৈ দেখে ছোট হুজুরের গল্পটি মনে পড়ে গেল। গ্রামের বাড়িতে এক মহিলার স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় চল্লিশার মিলাদ পড়াতে হুজুরকে দাওয়াত দেয়া হয়।

হুজুর তার ছোট ছেলেটিকে আগে আগে পাঠালেন গিয়ে সূরা কেরাত পড়া শুরু করতে। তিনি এসে মোনাজাত দেবেন বলে। হুজুরের ছোট ছেলেটি মহিলার বাড়িতে গিয়ে সুন্দর উচ্চারণে সূরা পড়তে লাগল। এদিকে হুজুরের আসতে দেরি দেখে উপস্থিত লোকজন হুজুরের ছেলেকেই মোনাজাত করার জন্য বলল। ছেলেটি এরকম চল্লিশার মোনাজাত কীভাবে করতে হয় জানে না।

এদিকে সবাই দেরি করতে চাচ্ছে না। তখন বাধ্য হয়ে ছোট হুজুর তার মতো করে মোনাজাত শুরু করল। মোনাজাতের এক পর্যায়ে সে বলল—‘আল্লাগো, গত মাসে এ বাড়ির একজন মানুষ মারা গিয়েছিল তারপর এ বাড়ির লোকজন আমাকে আর অব্বাকে দাওয়াত করে মুরগির গোস্ত দিয়ে ভাত খাইয়েছে, যাওয়ার সময় আব্বাকে ৫০ টাকা আর আমাকে ১০ টাকা দিয়েছে। আজকেও কত মজার খাবার খাইয়েছে, টাকাও নিশ্চয়ই দেবে। আল্লাগো, মৃতের আত্মার মাগফিরাতের পাশাপাশি আমাদের বিষয়টাও তুমি খেয়াল রেখো, যেন আবার আগামী মাসে কেউ মরে আর আমরা এভাবে দাওয়াত পাই।

’ তারপর কী হলো? তার পরের ঘটনা না বলে বরং বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের বিশিষ্ট জনের মৃত্যুর পরের ঘটনা বলি। দেশের বিশিষ্টজনের মধ্যে কারও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। সড়কের বেহাল দশা, ড্রাইভারদের অদক্ষতাসহ বিভিন্ন সমস্যা বের করে দেশের হর্তাকর্তারা যেভাবে হৈচৈ শুরু করে দেন, আমরা মনে মনে ভাবি যাক এবার বুঝি সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যেভাবে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তার অরাজনৈতিক এবং অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, এতে করে জাহানারা কাঞ্চনের প্রতি দোয়া করার পাশাপাশি তার আন্দোলনের সফলতা প্রার্থনা করে খুশি হয়ে কেন জানি না বাচ্চা হুজুরের ঘটনা মনে পড়ে যায়। চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনকে নকল বন্ধ করার জন্য এবং মহাজোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে তার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সচেষ্ট থাকার কারণে আমি খুবই পছন্দ করি।

শিক্ষা ভবনের দুর্নীতি বন্ধ করতে তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন এ সরকারের শুরু থেকে। কিন্তু বারবার তিনি ঘুষখোর কর্মকর্তাদের প্রমাণসহ ধরছেন ঠিকই, তবুও শিক্ষা ভবনে কি দুর্নীতি কমেছে সামান্যতম? বরং ঘুষের রেট বেড়েছে। সবাই বলে, তিনি নিজে সত্ এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে আন্তরিক। তার পরও কেন দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কতবার দৌড়াবেন শিক্ষা ভবনে, কিংবা কতজন ঘুষখোরকে হাতেনাতে ধরবেন? তিনি কেরানীদের সাসপেন্ড করেন কিন্তু ডিজিকে চোখে দেখেন না? ডিজিকেই তো তার অফিসের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়।

২০০১ সালের আগের সময়গুলোতে এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে স্থানভেদে ১০০০ টাকাও আদায় করা হতো। টাকা আদায় করার কারণ প্রকাশ্যে বলা হতো, অবাধে নকলের সুবিধার্থে ম্যাজিস্ট্রেট বশীকরণের কাজে এ টাকা ব্যবহার করা হবে। এইচএসসি পরীক্ষায় নকলের অবাধ সুযোগ দেয়ার সুব্যবস্থার অঙ্গীকার করত কলেজ সংসদ নির্বাচনের সময় বিভিন্ন প্যানেল। ছাত্রছাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি সাহেবের অঙ্গীকার চাইতেন। এমপি সাহেবরাও তাদের আশার বাণী শোনাতেন এবং বলতেন, সরকারের ঘরে সার্টিফিকেটের অভাব নেই।

আমি তোমাদের সার্টিফিকেট পাওয়ার ব্যবস্থা করব। তোমরা আমার দলকে দেখবে। ছাত্রছাত্রীরা মারহাবা মারহাবা বলে তালি বাজাত। সেসময় বাপ-মা হারা ছেলেরা নিজেদের কতটুকু এতিম মনে করতেন জানি না, তবে পরীক্ষার সময় নকল সাপ্লাই দেয়ার জন্য ৪-৫ জন সাহায্যকারী পরীক্ষার্থীর সঙ্গে না থাকলে সে নিজেকে মনে করত দুনিয়ার এতিম। আদর্শ দুলাভাইয়েরা শালীর নকলের সুবিধার্থে দূর দেশ থেকেও ছুটি নিয়ে আসতেন।

মামা-চাচারা তো আছেনই, বাবারাও পুলিশকে ম্যানেজ করে কিংবা পুলিশের লাঠির বাড়ি হজম করে ছেলেমেয়ের হাতে নকলটা ধরিয়ে দিতে পারলেই পিতা হিসেবে নিজেদের সার্থক মনে করতেন। আমি কিন্তু কোনো গল্প বলিনি। পরীক্ষার হলের চারপাশে নকল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি-লাফালাফির দৃশ্য কি সবাই ভুলে গেছেন ? সেই সময় বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো বেসরকারি চ্যানেল ছিল না। থাকলে তারা সরাসরি সম্প্রচার করত পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে। দেশের মানুষ ক্রিকেট খেলা না দেখে তাদের নিজেদের কাণ্ডকীর্তি দেখে বিমলানন্দ উপভোগ করতেন।

আচ্ছা, তত্কালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের নকল বন্ধের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবাই কি তাকে সাহায্য করেনি? নকলবাজ ছাত্র, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক, ঘুষখোর ম্যাজিস্ট্রেট সবাই আছে; কিন্তু নকল আজ নেই বললেই চলে। মিলন সাহেব নকলের সংস্কৃতিটাই ধ্বংস করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাকে ছাত্র, শিক্ষক, ম্যাজিস্ট্রেট, এমপি সাহেবরা সবাই সাহায্য করেছিলেন। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের মানুষ ভালোকে ঠিকই পছন্দ করে। তবে তা চাইতে হবে আন্তরিকভাবে।

যে কোনো ভালো সিদ্ধান্তে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে সাপোর্ট দিতে হবে। না হলে যানজটের জন্য হকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত সকালে নেয়া হবে, সন্ধ্যায় আরেক পক্ষ সরকারের ভোট কমে যাবে বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত বাতিল করিয়ে দিলে জনগণকে তো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য গল্পের মতো শোনাতে হবে—‘হয়েছে তো হয়েছে’। আমরা অসহায় জনগণ দিনের পর দিন যানজট, লোডশেডিং, সন্ত্রাস, দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হতেই থাকব। আর সরকারের লোকজন বলতে থাকবে, এগুলো সব বিরোধী দলের যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র, আগের সরকার সব শেষ করে দিয়েছে, আমরা সব নতুন করে শুরু করেছি। আমাদের অমুক মন্ত্রী এত ঘণ্টা অফিস করে, তমুক মন্ত্রী অত্যন্ত ভালো মানুষ, তমুক এমপি মসজিদের ইমামতি করেছেন, আর একটু অপেক্ষা করুন দেশটাকে আমরা সত্যিকারের ডিজিটাল সোনার বাংলা করে দেব।

আমাদের অপেক্ষার পালা কি শেষ হবে না? পণ্ডিতের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষও করছি পণ্ডিতের গল্প দিয়েই। এক বোকার দেশে এক পণ্ডিতকে দেয়া হলো তাদের একমাত্র পাঠশালার দায়িত্ব। পণ্ডিত ছাত্র পড়াবেন কি, নিজেই বকলম। চালাক পণ্ডিত ভেবে দেখলেন, বোকার দেশে তিনি যা শেখাবেন ছাত্ররা তাই শিখবে। তাই ভেবে পরদিন থেকে ছাত্রদের পড়াতে লাগলেন—‘এইভাবে গোলমেলে যাক কিছুদিন’।

ছাত্ররা প্রতিদিন এ পড়া মুখস্থ করে। এভাবে একই পড়া পাঠশালার ছাত্রদের দিয়ে পণ্ডিত বাড়িতে ঘুমিয়ে দিন কাটান। একদিন আরেক চালাক লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শুনল ছাত্ররা পড়ছে—‘এইভাবে গোলমেলে যাক কিছুদিন’। চালাক লোকটি পাঠশালায় পণ্ডিতকে খুঁজে না পেয়ে ছাত্রদের কাছেই সব শুনলেন। যাওয়ার সময় লোকটি ছাত্রদের নতুন একটা পড়া শিখিয়ে দিয়ে গেলেন।

পরদিন পণ্ডিত পাঠশালায় এসে দেখলেন ছাত্ররা পড়া মুখস্থ করছে—‘এইভাবে তুমি আর খাবে কতদিন’? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.