আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা বেশি দিন চলতে পারে না

আমি ফিফা চেয়ারম্যান হতে চাই। চেয়ারম্যান হলে আমার নাম হবে জন ফু সোহেল টাইমকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা বেশি দিন চলতে পারে না কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোগান। মিসরসহ আরব বসন্ত প্রবাহিত হওয়া দেশগুলোর কাছে তিনি এখন একজন রকস্টার। চলতি সপ্তাহে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়ার দাবির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বরও তিনি। নিজ দেশেও তিনি সমান জনপ্রিয় সেই ২০০৩ সাল থেকে।

আর জনপ্রিয়তার সূত্র ধরেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন। তার সময়েই তুরস্ক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এবং বিশ্ব-রাজনৈতিক অঙ্গণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ঠিক এই সমেয়ই রিসেপ তায়েপ এরদোগান জাতিসংঘের বাইরে জাতিসংঘ বিষয়ে কথা বললেন বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে। তার সঙ্গে টাইমের হয়ে আলাপচারিতায় ছিলেন জিম ফ্রেড্রেরিক, ববি ঘোষ, টনি ক্যারন, শ্যাট ম্যাকঅ্যালেস্টার এবং ইশান ঠারোর। আর এই আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা, আরব বসন্তের পেছনে এরদোগানের সমর্থন, জাতিসংঘ প্রশ্নে হতাশা এবং তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চাওয়া প্রসঙ্গ।

টাইম: আপনি ফিলিস্তিন ইস্যু এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। অনেকেই বলছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের ভূমিকা আসলে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। আপনি কি নিজেও তাই মনে করেন? এরদোগান: সর্বপ্রথম এবং প্রধান কথা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দেওয়া। এরপরও যদি কিছু থাকে, তাহলে তা আলোচনা করা যেতে পারে। সেটা অবশ্যই দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে।

এখানে আরও একটা ব্যাপার কাজ করছে, আমাদের ১৯৬৭ সালের সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমানা বণ্টণ মেনে নিয়েছে। কিন্তু যে করেই হোক মনে হচ্ছে, তারা আদর্শিক জায়গা থেকে সড়ে গেছে। তাদের উচিত সেই জায়গায় ফিরে যাওয়া। ফিলিস্তিন এখন জটিল গোলক ধাঁধার মধ্যে আছে।

টাইম ম্যগাজিনের মাধ্যমে আমি মানবজাতির কাছে একটি বার্তা দিতে চাই, তাদের (ফিলিস্তিনি জনগণ) কি অস্তিত্ব আছে? তারা সেখানে নিন্দা অথবা চরিত্র সংশোধনের জন্য আসেনি। ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা আর বেশিদিন চলতে পারে না। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদেরও উচিত এই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। যারা এই দাবিকে নেতিবাচকভাবে দেখার বা বলার চেষ্টা করছে, তারা তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। টাইম: চার-পাঁচ বছর আগে মনে করা হতো, তুরস্ক আর ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালো এবং তারা এই অঞ্চলে একটা পরিবর্তন আনতে পারবে।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্পর্ক চূড়ান্ত অর্থেই ভেঙে গেছে। এরদোগান: ইসরায়েল ২০১০ সালে মাভি মারমারায় (ছোট রণতরী ফ্লোটিল্লা) হামলা চালানোর ফলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ততার দিকে গেছে। ইসরায়েল যখন আক্রমণ করে, তখন মাভি মারামা ছিল আন্তর্জাতিক জলসীমায়। ওই রণতরীতে বিতর্কিত এমন কিছুই ছিল না। ছিল শুধু খেলনা, খাবার এবং কিছু দাতব্য সামগ্রী।

ফ্লোটিল্লাতে ৩২টি দেশের ৪৫০ জনের বেশি মানুষ ছিল। মৃতদের মধ্যে একজন ছিল তুরস্কের বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এখনও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ফ্লোটিল্লাটিতে অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। রণতরীটি অস্ত্রে ভরা ছিল বলে তারা দাবি করছে, তাহলে রণতরী থেকে কেন কোনো গুলি ছোড়া হয়নি তাদের দিকে? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং জেনেভাভিত্তিক সংস্থা দুটি রিপোর্ট পেশ করেছিল ওই ঘটনা সম্পর্কে। কিন্তু কোনো রিপোর্টেই বলা হয়নি, ফ্লোটিল্লা ভর্তি অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল।

আসলে ইসরায়েলের সরকার সৎ নয়। ফ্লোটিল্লাতে তুরস্কের বংশোদ্ভুত যে নয়জন মানুষ মারা গেছে, তাদের ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে ইসরায়েল সরকার। এমনকি তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্যই গাজার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়নি তারা। এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হওয়ার নয়।

টাইম: জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আপনি এবং (ফ্রান্সের) প্রেসিডেন্ট সারকোজি দু’জনেই বলেছেন, শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পুরোপরি ব্যর্থ হয়েছে। কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য আপনি কি আলাদা কিছু ভাবছেন? এরদোগান: এখানে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- ‘এই কাজটি সুসম্পন্ন করার আগে আপনাকে প্রয়োজনীয় আন্তরিকতা দেখাতে হবে। আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি আসলেই এই সমস্যার সমাধান করতে চাই, না চাই না? দুর্ভাগ্যবশত আমি এর আলামত জোটের মধ্যে দেখিনি। কারণ যদি জোট আসলেই এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতো, তাহলে তারা অবশ্যই ইসায়েলের ওপর কিছু শাস্তি ধার্য করতো। আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল বরাবর ৮৯টি প্রস্তাব রেখেছে।

কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি ইসরায়েল। সাধারণ পরিষদ ২০০টি প্রস্তাব দিয়েছে তাদের বরাবর। কিন্তু এর একটাও প্রতিপালিত হয়নি। এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, কেন ইসরায়েলের ওপর কোনো শাস্তি ধার্য করা হয়নি। যখন ইরানের ক্ষেত্রে কথা ওঠে, তখন আপনি শাস্তি দেন।

একই ঘটনা সুদানের ক্ষেত্রেও। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে কি হয় তাহলে? যদি সঠিক সময়ে ইসরায়েলের ওপর শাস্তি ধার্য করা হতো, তাহলে অনেক আগেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসন হতো। এই কারণে আমি মনে করি, আন্তরিকভাবে ওই প্রস্তাবের পেছনে সব পক্ষের দাঁড়ানো উচিত। একই সঙ্গে জাতিসংঘের পুনর্গঠনও দরকার। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন আকারে থাকা সদস্যদের ঘটনা কি? তাদের অবশ্যই সরিয়ে দেওয়া উচিত।

পুরো বিশ্ব এই পাঁচ স্থায়ী আসনধারী দেশের কাছে দাস হয়ে আছে। ’ টাইম: আরব বিশ্বের যে সব দেশে আরব বসন্ত হয়েছে, সে সব দেশে আপনার বেশ সুনাম। তারা তাদের দেশের স্বৈরশাসকদের হটিয়ে দিয়ে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপ অনুসরণ করতে চাচ্ছে। আপনার এই সাহায্য কি আপনাকে সমালোচনার মুখে ফেলবে না, যখন যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বব্যপী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা বলে সমালোচিত হচ্ছে? এরদোগান: অন্যদের মতো আমি সেসব জায়গায় শুধু রাস্তার কিছু মানুষ দেখতে যাই না। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমি সেখানকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

এই অবস্থায় আমার এমন অনেকের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমার আলোচনাগুলোতে আমি বলি, ঠিক আছে, তুরস্ক গণতন্ত্রের রূপ, এটা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র, আইনের শাসন এবং সামাজিক অবস্থা সম্পন্ন একটি দেশ। আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আমাদের শাসনব্যবস্থা রপ্তানি করছি না। আমরা এর পরোয়া করি না। যদি কেউ আমাদের সাহায্য চায়, তাহলে আমরা তার প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করবো।

কিন্তু মানসিকভাবে আমাদের ব্যবস্থা রপ্তানি করতে চাচ্ছি না। টাইম: সিরিয়াকে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপের প্রতি মাথা নত করতে দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো আপনিও প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সে সম্পর্কও ভঙ্গুর অবস্থায়। সিরিয়ার শান্তির জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ আছে কি, যাতে করে আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারে।

অথবা তাকে যদি যেতে হয়? এরদোগান: আমি কিছু নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক নির্ধারণ করি। যারা অভিযুক্ত নেতা এবং যখন তারা নিজ জনগণের ওপর আক্রমণ করতে গুলি, ট্যাংক এবং অন্যান্য ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে, তখন তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখা অসম্ভব। এমনকি যখন আমাদের সঙ্গে সিরিয়ার কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উষ্ণ সম্পর্ক ছিল, তখনও তাদের ভেতর আমাদের গণতন্ত্রকে সুনজরে দেখার কোনো অভিপ্রায় দেখিনি। আমরা সবসময়ই আমাদের কথা বলে গেছি। কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের কথাই শোনেনি।

আমাদের আগের প্রতিনিধি আমাকে বলেছিল, বেশিরভাগ রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আসাদ আমাকে বলেছিল, ‘কারাগারে আমাদের মাত্র ৮৩ জন রাজবন্দী আছে’। কিন্তু আসলে সেখানে রাজবন্দী আছে হাজার হাজার। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কখনও কোনো সহিংসতা বা অভুত্থানের সঙ্গে জড়িত নয়। দুর্ভাগ্যবশত তাদের বিশ্বাসের অভিব্যক্তির কারণে তারা কারাবরণ করছে।

আপনি জানেন বোধহয়, সিরিয়া থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা সাত হাজার শরণার্থীকে আমরা হাতাই প্রদেশে আশ্রয় দিয়েছি। টাইম: কিন্তু আপনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেননি। সিরিয়াতে কি আসাদের ভবিষ্যৎ আছে? এরদোগান: এই মুহূর্তে এ বিষয়ে বলার আগে আমাকে প্রথমে হাতাইয়ের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে হবে। কিন্তু আশা-আকাঙ্ক্ষার দিক দিয়ে আমি আগেই বলেছি, আমি অতটা আশাবাদী নই। তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিগত বছরগুলোতে।

বিশেষত নতুন প্রশাসন আসার পর। বিগত নয় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের সম্পর্কে কোনো টানাপোড়ন নেই। কিন্তু সম্পর্ক যতটা উন্নত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। ওবামা এবং আমাদের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই খুবই ইতিবাচক। যখন আমাদের মাঝে কথা হয়, তখন আমরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করি।

আমাদের মধ্যে বেশ খোলামেলা আলোচনাই হয়। কিন্তু অবশ্যই আমরা দু’দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক চাই। বিশেষত অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। আর এক্ষেত্রে তুরস্ক অনেকটাই এগিয়ে। আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের আরও দেখতে চাই আমরা।

আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। আমি আপনাকে সততার সঙ্গে বলছি, আমাদের সম্পর্কের মাঝে কোনো উত্তেজনা নেই। টাইম: তাহলে ইসরায়েল সম্পর্কে কি বলবেন? এরদোগান: এখানে একটু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। বর্তমান ইস্যু নিয়ে আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে নেই। কিন্তু এই ভিন্নমত পোষণ করার কারণ সম্পর্কহীনতা নয়।

তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সার্বভৌম দেশ। আমাদের পরিকল্পনা এবং অনুভূতির ওপর নির্ভর করে আমাদের ভিন্নভাবে চলতে হতে পারে। কিন্তু আমরা সব সময়ই বন্ধুদের চাই। টাইম: মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের ভূমিকা বাড়ছে। এখন কি তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করবে? ইউরোপের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার ইচ্ছা কি শেষ? এরদোগান: যখন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক অথবা সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার ছিলেন, তখন তুরস্ক ইউরোপীয় নেতাদের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতো।

কিন্তু যখন মেরকেল অথবা সারকোজি দায়িত্বে এলেন, তখন সেই পরিবেশ নাটকীয়ভাবে বদলে গেল। এত কিছু সত্ত্বেও আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আমাদের জনগণ বিশ্বাস হারাতে লাগলো। আমরা এখনও দৃঢ় সংকল্প কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো নেতাই চিরস্থায়ী নয়। একদিন তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবেই।

আমরাও এক দিন ইইউর অন্তর্ভূক্ত হবো। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তুরস্ক শক্তিশালী হচ্ছে এবং অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অবস্থা এখন সুস্পষ্ট। বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১১টাইমকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা বেশি দিন চলতে পারে না কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোগান। মিসরসহ আরব বসন্ত প্রবাহিত হওয়া দেশগুলোর কাছে তিনি এখন একজন রকস্টার। চলতি সপ্তাহে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়ার দাবির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বরও তিনি।

নিজ দেশেও তিনি সমান জনপ্রিয় সেই ২০০৩ সাল থেকে। আর জনপ্রিয়তার সূত্র ধরেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন। তার সময়েই তুরস্ক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এবং বিশ্ব-রাজনৈতিক অঙ্গণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ঠিক এই সমেয়ই রিসেপ তায়েপ এরদোগান জাতিসংঘের বাইরে জাতিসংঘ বিষয়ে কথা বললেন বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে। তার সঙ্গে টাইমের হয়ে আলাপচারিতায় ছিলেন জিম ফ্রেড্রেরিক, ববি ঘোষ, টনি ক্যারন, শ্যাট ম্যাকঅ্যালেস্টার এবং ইশান ঠারোর।

আর এই আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা, আরব বসন্তের পেছনে এরদোগানের সমর্থন, জাতিসংঘ প্রশ্নে হতাশা এবং তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চাওয়া প্রসঙ্গ। টাইম: আপনি ফিলিস্তিন ইস্যু এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। অনেকেই বলছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের ভূমিকা আসলে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। আপনি কি নিজেও তাই মনে করেন? এরদোগান: সর্বপ্রথম এবং প্রধান কথা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দেওয়া। এরপরও যদি কিছু থাকে, তাহলে তা আলোচনা করা যেতে পারে।

সেটা অবশ্যই দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে। এখানে আরও একটা ব্যাপার কাজ করছে, আমাদের ১৯৬৭ সালের সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমানা বণ্টণ মেনে নিয়েছে। কিন্তু যে করেই হোক মনে হচ্ছে, তারা আদর্শিক জায়গা থেকে সড়ে গেছে। তাদের উচিত সেই জায়গায় ফিরে যাওয়া।

ফিলিস্তিন এখন জটিল গোলক ধাঁধার মধ্যে আছে। টাইম ম্যগাজিনের মাধ্যমে আমি মানবজাতির কাছে একটি বার্তা দিতে চাই, তাদের (ফিলিস্তিনি জনগণ) কি অস্তিত্ব আছে? তারা সেখানে নিন্দা অথবা চরিত্র সংশোধনের জন্য আসেনি। ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা আর বেশিদিন চলতে পারে না। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদেরও উচিত এই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। যারা এই দাবিকে নেতিবাচকভাবে দেখার বা বলার চেষ্টা করছে, তারা তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না।

টাইম: চার-পাঁচ বছর আগে মনে করা হতো, তুরস্ক আর ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালো এবং তারা এই অঞ্চলে একটা পরিবর্তন আনতে পারবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্পর্ক চূড়ান্ত অর্থেই ভেঙে গেছে। এরদোগান: ইসরায়েল ২০১০ সালে মাভি মারমারায় (ছোট রণতরী ফ্লোটিল্লা) হামলা চালানোর ফলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ততার দিকে গেছে। ইসরায়েল যখন আক্রমণ করে, তখন মাভি মারামা ছিল আন্তর্জাতিক জলসীমায়। ওই রণতরীতে বিতর্কিত এমন কিছুই ছিল না।

ছিল শুধু খেলনা, খাবার এবং কিছু দাতব্য সামগ্রী। ফ্লোটিল্লাতে ৩২টি দেশের ৪৫০ জনের বেশি মানুষ ছিল। মৃতদের মধ্যে একজন ছিল তুরস্কের বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এখনও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ফ্লোটিল্লাটিতে অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। রণতরীটি অস্ত্রে ভরা ছিল বলে তারা দাবি করছে, তাহলে রণতরী থেকে কেন কোনো গুলি ছোড়া হয়নি তাদের দিকে? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং জেনেভাভিত্তিক সংস্থা দুটি রিপোর্ট পেশ করেছিল ওই ঘটনা সম্পর্কে।

কিন্তু কোনো রিপোর্টেই বলা হয়নি, ফ্লোটিল্লা ভর্তি অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। আসলে ইসরায়েলের সরকার সৎ নয়। ফ্লোটিল্লাতে তুরস্কের বংশোদ্ভুত যে নয়জন মানুষ মারা গেছে, তাদের ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে ইসরায়েল সরকার। এমনকি তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্যই গাজার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়নি তারা।

এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হওয়ার নয়। টাইম: জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আপনি এবং (ফ্রান্সের) প্রেসিডেন্ট সারকোজি দু’জনেই বলেছেন, শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পুরোপরি ব্যর্থ হয়েছে। কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য আপনি কি আলাদা কিছু ভাবছেন? এরদোগান: এখানে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- ‘এই কাজটি সুসম্পন্ন করার আগে আপনাকে প্রয়োজনীয় আন্তরিকতা দেখাতে হবে। আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি আসলেই এই সমস্যার সমাধান করতে চাই, না চাই না? দুর্ভাগ্যবশত আমি এর আলামত জোটের মধ্যে দেখিনি। কারণ যদি জোট আসলেই এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতো, তাহলে তারা অবশ্যই ইসায়েলের ওপর কিছু শাস্তি ধার্য করতো।

আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল বরাবর ৮৯টি প্রস্তাব রেখেছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি ইসরায়েল। সাধারণ পরিষদ ২০০টি প্রস্তাব দিয়েছে তাদের বরাবর। কিন্তু এর একটাও প্রতিপালিত হয়নি। এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, কেন ইসরায়েলের ওপর কোনো শাস্তি ধার্য করা হয়নি।

যখন ইরানের ক্ষেত্রে কথা ওঠে, তখন আপনি শাস্তি দেন। একই ঘটনা সুদানের ক্ষেত্রেও। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে কি হয় তাহলে? যদি সঠিক সময়ে ইসরায়েলের ওপর শাস্তি ধার্য করা হতো, তাহলে অনেক আগেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসন হতো। এই কারণে আমি মনে করি, আন্তরিকভাবে ওই প্রস্তাবের পেছনে সব পক্ষের দাঁড়ানো উচিত। একই সঙ্গে জাতিসংঘের পুনর্গঠনও দরকার।

নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন আকারে থাকা সদস্যদের ঘটনা কি? তাদের অবশ্যই সরিয়ে দেওয়া উচিত। পুরো বিশ্ব এই পাঁচ স্থায়ী আসনধারী দেশের কাছে দাস হয়ে আছে। ’ টাইম: আরব বিশ্বের যে সব দেশে আরব বসন্ত হয়েছে, সে সব দেশে আপনার বেশ সুনাম। তারা তাদের দেশের স্বৈরশাসকদের হটিয়ে দিয়ে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপ অনুসরণ করতে চাচ্ছে। আপনার এই সাহায্য কি আপনাকে সমালোচনার মুখে ফেলবে না, যখন যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বব্যপী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা বলে সমালোচিত হচ্ছে? এরদোগান: অন্যদের মতো আমি সেসব জায়গায় শুধু রাস্তার কিছু মানুষ দেখতে যাই না।

উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমি সেখানকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এই অবস্থায় আমার এমন অনেকের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমার আলোচনাগুলোতে আমি বলি, ঠিক আছে, তুরস্ক গণতন্ত্রের রূপ, এটা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র, আইনের শাসন এবং সামাজিক অবস্থা সম্পন্ন একটি দেশ। আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আমাদের শাসনব্যবস্থা রপ্তানি করছি না। আমরা এর পরোয়া করি না।

যদি কেউ আমাদের সাহায্য চায়, তাহলে আমরা তার প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করবো। কিন্তু মানসিকভাবে আমাদের ব্যবস্থা রপ্তানি করতে চাচ্ছি না। টাইম: সিরিয়াকে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপের প্রতি মাথা নত করতে দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো আপনিও প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সে সম্পর্কও ভঙ্গুর অবস্থায়।

সিরিয়ার শান্তির জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ আছে কি, যাতে করে আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারে। অথবা তাকে যদি যেতে হয়? এরদোগান: আমি কিছু নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক নির্ধারণ করি। যারা অভিযুক্ত নেতা এবং যখন তারা নিজ জনগণের ওপর আক্রমণ করতে গুলি, ট্যাংক এবং অন্যান্য ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে, তখন তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখা অসম্ভব। এমনকি যখন আমাদের সঙ্গে সিরিয়ার কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উষ্ণ সম্পর্ক ছিল, তখনও তাদের ভেতর আমাদের গণতন্ত্রকে সুনজরে দেখার কোনো অভিপ্রায় দেখিনি। আমরা সবসময়ই আমাদের কথা বলে গেছি।

কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের কথাই শোনেনি। আমাদের আগের প্রতিনিধি আমাকে বলেছিল, বেশিরভাগ রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আসাদ আমাকে বলেছিল, ‘কারাগারে আমাদের মাত্র ৮৩ জন রাজবন্দী আছে’। কিন্তু আসলে সেখানে রাজবন্দী আছে হাজার হাজার। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কখনও কোনো সহিংসতা বা অভুত্থানের সঙ্গে জড়িত নয়।

দুর্ভাগ্যবশত তাদের বিশ্বাসের অভিব্যক্তির কারণে তারা কারাবরণ করছে। আপনি জানেন বোধহয়, সিরিয়া থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা সাত হাজার শরণার্থীকে আমরা হাতাই প্রদেশে আশ্রয় দিয়েছি। টাইম: কিন্তু আপনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেননি। সিরিয়াতে কি আসাদের ভবিষ্যৎ আছে? এরদোগান: এই মুহূর্তে এ বিষয়ে বলার আগে আমাকে প্রথমে হাতাইয়ের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে হবে। কিন্তু আশা-আকাঙ্ক্ষার দিক দিয়ে আমি আগেই বলেছি, আমি অতটা আশাবাদী নই।

তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। বিশেষত নতুন প্রশাসন আসার পর। বিগত নয় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের সম্পর্কে কোনো টানাপোড়ন নেই। কিন্তু সম্পর্ক যতটা উন্নত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। ওবামা এবং আমাদের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই খুবই ইতিবাচক।

যখন আমাদের মাঝে কথা হয়, তখন আমরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের মধ্যে বেশ খোলামেলা আলোচনাই হয়। কিন্তু অবশ্যই আমরা দু’দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক চাই। বিশেষত অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। আর এক্ষেত্রে তুরস্ক অনেকটাই এগিয়ে।

আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের আরও দেখতে চাই আমরা। আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। আমি আপনাকে সততার সঙ্গে বলছি, আমাদের সম্পর্কের মাঝে কোনো উত্তেজনা নেই। টাইম: তাহলে ইসরায়েল সম্পর্কে কি বলবেন? এরদোগান: এখানে একটু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। বর্তমান ইস্যু নিয়ে আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে নেই।

কিন্তু এই ভিন্নমত পোষণ করার কারণ সম্পর্কহীনতা নয়। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সার্বভৌম দেশ। আমাদের পরিকল্পনা এবং অনুভূতির ওপর নির্ভর করে আমাদের ভিন্নভাবে চলতে হতে পারে। কিন্তু আমরা সব সময়ই বন্ধুদের চাই। টাইম: মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের ভূমিকা বাড়ছে।

এখন কি তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করবে? ইউরোপের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার ইচ্ছা কি শেষ? এরদোগান: যখন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক অথবা সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার ছিলেন, তখন তুরস্ক ইউরোপীয় নেতাদের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু যখন মেরকেল অথবা সারকোজি দায়িত্বে এলেন, তখন সেই পরিবেশ নাটকীয়ভাবে বদলে গেল। এত কিছু সত্ত্বেও আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আমাদের জনগণ বিশ্বাস হারাতে লাগলো। আমরা এখনও দৃঢ় সংকল্প কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো নেতাই চিরস্থায়ী নয়।

একদিন তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবেই। আমরাও এক দিন ইইউর অন্তর্ভূক্ত হবো। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তুরস্ক শক্তিশালী হচ্ছে এবং অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অবস্থা এখন সুস্পষ্ট। বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১১টাইমকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা বেশি দিন চলতে পারে না কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোগান। মিসরসহ আরব বসন্ত প্রবাহিত হওয়া দেশগুলোর কাছে তিনি এখন একজন রকস্টার।

চলতি সপ্তাহে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়ার দাবির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বরও তিনি। নিজ দেশেও তিনি সমান জনপ্রিয় সেই ২০০৩ সাল থেকে। আর জনপ্রিয়তার সূত্র ধরেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন। তার সময়েই তুরস্ক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এবং বিশ্ব-রাজনৈতিক অঙ্গণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ঠিক এই সমেয়ই রিসেপ তায়েপ এরদোগান জাতিসংঘের বাইরে জাতিসংঘ বিষয়ে কথা বললেন বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে।

তার সঙ্গে টাইমের হয়ে আলাপচারিতায় ছিলেন জিম ফ্রেড্রেরিক, ববি ঘোষ, টনি ক্যারন, শ্যাট ম্যাকঅ্যালেস্টার এবং ইশান ঠারোর। আর এই আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা, আরব বসন্তের পেছনে এরদোগানের সমর্থন, জাতিসংঘ প্রশ্নে হতাশা এবং তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চাওয়া প্রসঙ্গ। টাইম: আপনি ফিলিস্তিন ইস্যু এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। অনেকেই বলছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের ভূমিকা আসলে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। আপনি কি নিজেও তাই মনে করেন? এরদোগান: সর্বপ্রথম এবং প্রধান কথা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দেওয়া।

এরপরও যদি কিছু থাকে, তাহলে তা আলোচনা করা যেতে পারে। সেটা অবশ্যই দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে। এখানে আরও একটা ব্যাপার কাজ করছে, আমাদের ১৯৬৭ সালের সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমানা বণ্টণ মেনে নিয়েছে। কিন্তু যে করেই হোক মনে হচ্ছে, তারা আদর্শিক জায়গা থেকে সড়ে গেছে।

তাদের উচিত সেই জায়গায় ফিরে যাওয়া। ফিলিস্তিন এখন জটিল গোলক ধাঁধার মধ্যে আছে। টাইম ম্যগাজিনের মাধ্যমে আমি মানবজাতির কাছে একটি বার্তা দিতে চাই, তাদের (ফিলিস্তিনি জনগণ) কি অস্তিত্ব আছে? তারা সেখানে নিন্দা অথবা চরিত্র সংশোধনের জন্য আসেনি। ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা আর বেশিদিন চলতে পারে না। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদেরও উচিত এই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া।

যারা এই দাবিকে নেতিবাচকভাবে দেখার বা বলার চেষ্টা করছে, তারা তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। টাইম: চার-পাঁচ বছর আগে মনে করা হতো, তুরস্ক আর ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালো এবং তারা এই অঞ্চলে একটা পরিবর্তন আনতে পারবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্পর্ক চূড়ান্ত অর্থেই ভেঙে গেছে। এরদোগান: ইসরায়েল ২০১০ সালে মাভি মারমারায় (ছোট রণতরী ফ্লোটিল্লা) হামলা চালানোর ফলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ততার দিকে গেছে। ইসরায়েল যখন আক্রমণ করে, তখন মাভি মারামা ছিল আন্তর্জাতিক জলসীমায়।

ওই রণতরীতে বিতর্কিত এমন কিছুই ছিল না। ছিল শুধু খেলনা, খাবার এবং কিছু দাতব্য সামগ্রী। ফ্লোটিল্লাতে ৩২টি দেশের ৪৫০ জনের বেশি মানুষ ছিল। মৃতদের মধ্যে একজন ছিল তুরস্কের বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এখনও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ফ্লোটিল্লাটিতে অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল।

রণতরীটি অস্ত্রে ভরা ছিল বলে তারা দাবি করছে, তাহলে রণতরী থেকে কেন কোনো গুলি ছোড়া হয়নি তাদের দিকে? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং জেনেভাভিত্তিক সংস্থা দুটি রিপোর্ট পেশ করেছিল ওই ঘটনা সম্পর্কে। কিন্তু কোনো রিপোর্টেই বলা হয়নি, ফ্লোটিল্লা ভর্তি অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। আসলে ইসরায়েলের সরকার সৎ নয়। ফ্লোটিল্লাতে তুরস্কের বংশোদ্ভুত যে নয়জন মানুষ মারা গেছে, তাদের ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে ইসরায়েল সরকার। এমনকি তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতেও অস্বীকৃতি জানায়।

অবশ্যই গাজার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়নি তারা। এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হওয়ার নয়। টাইম: জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আপনি এবং (ফ্রান্সের) প্রেসিডেন্ট সারকোজি দু’জনেই বলেছেন, শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পুরোপরি ব্যর্থ হয়েছে। কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য আপনি কি আলাদা কিছু ভাবছেন? এরদোগান: এখানে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- ‘এই কাজটি সুসম্পন্ন করার আগে আপনাকে প্রয়োজনীয় আন্তরিকতা দেখাতে হবে। আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি আসলেই এই সমস্যার সমাধান করতে চাই, না চাই না? দুর্ভাগ্যবশত আমি এর আলামত জোটের মধ্যে দেখিনি।

কারণ যদি জোট আসলেই এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতো, তাহলে তারা অবশ্যই ইসায়েলের ওপর কিছু শাস্তি ধার্য করতো। আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েল বরাবর ৮৯টি প্রস্তাব রেখেছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি ইসরায়েল। সাধারণ পরিষদ ২০০টি প্রস্তাব দিয়েছে তাদের বরাবর। কিন্তু এর একটাও প্রতিপালিত হয়নি।

এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, কেন ইসরায়েলের ওপর কোনো শাস্তি ধার্য করা হয়নি। যখন ইরানের ক্ষেত্রে কথা ওঠে, তখন আপনি শাস্তি দেন। একই ঘটনা সুদানের ক্ষেত্রেও। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে কি হয় তাহলে? যদি সঠিক সময়ে ইসরায়েলের ওপর শাস্তি ধার্য করা হতো, তাহলে অনেক আগেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসন হতো। এই কারণে আমি মনে করি, আন্তরিকভাবে ওই প্রস্তাবের পেছনে সব পক্ষের দাঁড়ানো উচিত।

একই সঙ্গে জাতিসংঘের পুনর্গঠনও দরকার। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন আকারে থাকা সদস্যদের ঘটনা কি? তাদের অবশ্যই সরিয়ে দেওয়া উচিত। পুরো বিশ্ব এই পাঁচ স্থায়ী আসনধারী দেশের কাছে দাস হয়ে আছে। ’ টাইম: আরব বিশ্বের যে সব দেশে আরব বসন্ত হয়েছে, সে সব দেশে আপনার বেশ সুনাম। তারা তাদের দেশের স্বৈরশাসকদের হটিয়ে দিয়ে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপ অনুসরণ করতে চাচ্ছে।

আপনার এই সাহায্য কি আপনাকে সমালোচনার মুখে ফেলবে না, যখন যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বব্যপী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা বলে সমালোচিত হচ্ছে? এরদোগান: অন্যদের মতো আমি সেসব জায়গায় শুধু রাস্তার কিছু মানুষ দেখতে যাই না। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমি সেখানকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এই অবস্থায় আমার এমন অনেকের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমার আলোচনাগুলোতে আমি বলি, ঠিক আছে, তুরস্ক গণতন্ত্রের রূপ, এটা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র, আইনের শাসন এবং সামাজিক অবস্থা সম্পন্ন একটি দেশ। আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আমাদের শাসনব্যবস্থা রপ্তানি করছি না।

আমরা এর পরোয়া করি না। যদি কেউ আমাদের সাহায্য চায়, তাহলে আমরা তার প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করবো। কিন্তু মানসিকভাবে আমাদের ব্যবস্থা রপ্তানি করতে চাচ্ছি না। টাইম: সিরিয়াকে তুরস্কের গণতান্ত্রিক রূপের প্রতি মাথা নত করতে দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো আপনিও প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন।

এখন দেখা যাচ্ছে, সে সম্পর্কও ভঙ্গুর অবস্থায়। সিরিয়ার শান্তির জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ আছে কি, যাতে করে আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারে। অথবা তাকে যদি যেতে হয়? এরদোগান: আমি কিছু নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক নির্ধারণ করি। যারা অভিযুক্ত নেতা এবং যখন তারা নিজ জনগণের ওপর আক্রমণ করতে গুলি, ট্যাংক এবং অন্যান্য ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে, তখন তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখা অসম্ভব। এমনকি যখন আমাদের সঙ্গে সিরিয়ার কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উষ্ণ সম্পর্ক ছিল, তখনও তাদের ভেতর আমাদের গণতন্ত্রকে সুনজরে দেখার কোনো অভিপ্রায় দেখিনি।

আমরা সবসময়ই আমাদের কথা বলে গেছি। কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের কথাই শোনেনি। আমাদের আগের প্রতিনিধি আমাকে বলেছিল, বেশিরভাগ রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আসাদ আমাকে বলেছিল, ‘কারাগারে আমাদের মাত্র ৮৩ জন রাজবন্দী আছে’। কিন্তু আসলে সেখানে রাজবন্দী আছে হাজার হাজার।

এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কখনও কোনো সহিংসতা বা অভুত্থানের সঙ্গে জড়িত নয়। দুর্ভাগ্যবশত তাদের বিশ্বাসের অভিব্যক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.