আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঁজিতন্ত্র, সিভিল সোসাইটি ও নারী সৌন্দর্য (পর্ব- ২)

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী। আগের পর্বের লিঙ্কঃ দেশীয় ঐতিহ্য, ফ্যাশন হাউজ, পুঁজিবাদঃ ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে উঠছে একটার পর একটা ফ্যাশন হাউজ। এসব ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের ফ্যাশনের বিষয়বস্তুতে (theme) দেশীয় ঐতিহ্য, দেশ প্রেম, মানবিক বোধ এর মতো পবিত্র অনুভূতিগুলো। এটা খারাপ কিছু না। কিন্তু এসব বিষয়গুলোর ব্যবহার যখন নিছক ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয় তখন আমাদের প্রশ্নটা উত্থাপিত হয়।

কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন বিপ্লবী বা বৈপ্লবিক চেতনার ভাবধারা অথবা নিপীড়িত মানুষের স্বপ্নের সমাজ চিন্তার মতো বিষয়গুলো তাদের ফ্যাশনের পণ্য হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারপর ব্যবসা চাঙ্গা হলে এদের আসল রুপ খোলস থেকে বেরয়। এসব ফ্যাশন হাউজে তখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিশেবে বিশ্ব সঙ্গীতের নাম দিয়ে হরদম বাজতে থাকে হাল আমলের সস্তা হিন্দি মিউজিক অথবা হেঁড়ে গলায় গাওয়া, সঙ্করজাত, যান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুতকৃত বিকৃত উচ্চারণে গাওয়া বাংলা মিউজিক। তখন চে’ হয়ে উঠে নিছক একজন মডেলের নাম। কয়েকদিন পর পণ্যের দাম আর মান বেড়ে উঠে উচ্চবিত্তদের চৌকাঠ বরাবর।

মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা এখানে ঢুঁ মারা রীতিমত অপরাধ। স্পর্ধার বিষয়। ফ্যাশনের বিষয়বস্তু ও বদলে যায় ততদিনে। আর আবেগী উচ্চাভিলাসী বাঙ্গালীরা তবুও এসব গিলে খায় ভোল পাল্টে। অথচ এসব ফ্যাশন হাউজের উৎপাদন যন্ত্ররা হচ্ছে গ্রামের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারী সমাজ যারা অশিক্ষিত, অধিকার অসচেতন, যাদের অনবরত ঘানির বলদের মতো খাটানি আর পরিশ্রমের ফসল, আর এ ফসল ঘরে তুলছে কোনো এক দঙ্গল ভূস্বামী।

ধীরে ধীরে পৃথিবী ফিরে যাচ্ছে সুদখোর রক্তচোষা সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছার পৃথিবীতে। একবার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। নিবন্ধটিতে বলা হয়, ক্রিশ্চিয়ান ডিয়র নামের যে ফ্যাশন হাউজ কোম্পানি, তারা চাইলে এক রাতের মধ্যেই আমেরিকার পাঁচ কোটি মহিলার স্কার্টের দৈর্ঘ্যের মাপ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিতে পারে। এভাবেই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ নারীত্বের অবমাননা করছে নীরবে। ফ্যাশন হাউজগুলো আবার আজকাল নারী দেহের একটা স্ট্যান্ডার্ড মাপ ও তৈরী করে দিয়েছে ৩৬-২৪-৩৬।

আর ওজনের ক্ষেত্রে ও আছে সুনির্দিষ্টতা। এই স্ট্যান্ডার্ড মাপের দেহ তৈরী করতে গিয়ে কত্ত নারী মরিয়া হয়ে উঠছে দিন কে দিন। শেষে অপুষ্টিতে ভোগে কেল্লাফতে। মে ২২, ১৯৯৭ সালে বিবিসিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. ক্লিন্টন এক ভাষণে ফ্যাশন শো বন্ধ করার আহ্বান জানান। এর কারণ হিশেবে তিনি বলেন, ফ্যাশন শো’র নামে যে নারীদের নগ্ন দেহের প্রদর্শনী হয় তার কারণে যুব সমাজ উত্তেজনাকে প্রশমিত করার জন্য ড্রাগস নিচ্ছে।

পর্ণোগ্রাফি ওয়েবসাইট ও পুঁজিবাদঃ নারী সৌন্দর্য নিয়ে যে বাণিজ্য তার অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে ইন্টারনেট। বিশ্বে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম হল যৌনতা বা সেক্স। সেক্স এর প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষ আছে বলে মনে হয় না। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। এবং এটা সহজাত প্রবৃত্তি।

আর এটাকে পুঁজি বানিয়ে এ কারনেই ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটগুলোর বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে পর্ণোগ্রাফি ওয়েবসাইট। মানুষ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে ব্যবসায়িক পণ্য বানায়। ইন্টারনেট ওয়েবসাইটগুলোর পর্ণোগ্রাফি ব্যবসাকে আমরা বলব এটা এক ধরণের সাইলেন্ট ক্রাইম জব। ইন্টার্নেতে শুধুমাত্র শিশুদের নিয়ে তৈরী পর্ণো ওয়েবসাইট রয়েছে প্রায় ১ কোটি চল্লিশ লক্ষ। আর এর সাথে জড়িত প্রায় এক লক্ষ অবৈধ ব্যবসায়ী, সাইবার অপরাধী।

নভেম্বর ৫-৭, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে অষ্ট্রেলিয়া, হংকং, শ্রীলংকা, নেপাল ও বাংলাদেশের সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সাইবার অপরাধ বিষয়ক সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানে ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, উএনডিপি’র বক্তব্যে উপস্থাপিত রিপোর্ট ছিল এরকমঃ “I do place a particular emphasis on this last point. In our drive towards the achievement of the Millennium Development Goals and towards the universal access to the technology it will be a challenge to ensure that those who are to benefit from it most, our children and youth, can do so without the fear of exploitation and without the violation of their fundamental right to dignity. The United Nations Office on Drugs and Crime, UNODC, estimates that there are 14 million pornography sites containing estimated 1 million pornographic images of children and that organized child pornography rings around the world have between 50,000 to 100,000 members. These are shocking statistics, clearly indicating the magnitude of the problem on a global scale”. একত্রিশ হাজারেরও বেশী অভি্যোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে ইন্টারনেট ওয়াচ ফাউন্ডেশন (আই ডব্লিউ এফ) যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়, হাজারেরও বেশী ওয়েবসাইট রয়েছে যারা শিশুদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের নিপীড়নের মাধ্যমে ধর্ষণের ছবি ও ভিডিও পর্ণোগ্রাফি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করে। শুধু ইউরোপেই নয়, এখন বাংলাদেশেই রয়েছে হাজারও পর্ণোগ্রাফি ওয়েবসাইট যারা ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে সেক্স ট্রেড চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ ধরণের অনেক সংবাদ পত্রিকায় দেখেছি। এখন পাড়ার ভিডিও’র দোকান, নীলক্ষেতের ওভার ব্রীজের নীচে, স্টেডিয়াম মার্কেটের ভ্রাম্যমান দোকানগুলোতে গিয়ে পর্ণসিডি খুঁজতে হয় না। পুঁজিবাদী তথ্য প্রযুক্তির প্রসার, ব্যবসায়িক যৌনতাকে আমাদের ড্রয়িং রুম, সন্তানের পড়ার টেবিলে রাখা কম্পিউটার বরাবর পৌঁছিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এটা নিশ্চয় একমাত্র তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রসারের কারণে নয়, তবে এটা একটা কারণ।

বিনোদন, ক্রিকেট ও পুঁজিবাদঃ হাল আমলের ক্রিকেটের আধুনিক বাণিজ্যিক সংস্করণে দেখা যায়, চার-ছক্কার ঝলক বা বোল্ড আউটের ক্যারিশমার সাথে সাথে গ্যালারিতে একদল সুন্দরীরা অর্ধনগ্ন হয়ে নেচে উঠে, শারীরিক কসরত দেখায়। কোনো কোনো সময় আবার খেলোয়াড়ের জবানবন্দি নেয় কোন এক রুপের জৌলশ ছড়ানো ললনা। অথচ বিষয়টার সাথে এমন কী ক্রিকেট বিষয়টার সাথে আপাতত সেক্ষেত্রে একজন রুপের জৌলশ ছড়ানো ললনার কোনও সম্পর্ক থাকে না। একজন খেলোয়াড়ের জবানবন্দি নেবার ক্ষেত্রে ঐ খেলায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিই কাজটা অত্যন্ত সাবলীল ভাবে করতে পারেন। একজন খেলোয়াড় নয় এমন ব্যক্তি সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, এ কাজটা ভালোভাবে করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ব্যতিক্রম উদাহরণ হতে পারে না। লোকজন এখন চার-ছক্কার ক্যারিশমা বা বোল্ড আউটের চমক দেখার চাইতে মুফত্ পাওয়া নাচটাকেই বেশী উপভোগ করে। আমরা দেখেছি গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশ দলের জার্সি প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের গ্রামীণ ফোন ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের আয়োজনে গ্রাণ্ড শো। সেখানে জার্সি প্রদর্শনের চেয়ে নারী দেহের প্রদর্শনীই হয়েছিলো বেশী যা আমরা অই অনুষ্ঠানেরই একজন অতিথি জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট দলের নির্বাচক অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল এর মতামত থেকে জানতে পারি। ক্যাম্পবেল কে যখন জার্সি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তার উত্তরে তিনি বলেন, আমি আসলে জার্সি নয়, দেখছিলাম মডেলদের।

জার্সিই যদি প্রদর্শন করা হবে, সেখানে স্বল্প বসনের নারী মডেলদের প্রদর্শনীর মানে কী যেখানে নারী মডেলদের কারো গায়ে একটিবারের জন্য ও একটি জার্সি ও প্রদর্শিত হয়নি। অথচ নারীদের সাথে জার্সির কী আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল? তখন নারী নীতি, নারী নীতি বাস্তবায়নের জন্যে মানববন্ধনকারীরা, নারী অধিকার আদায় আন্দোলনের সম্মানিত নারী নেতৃগণ, সিভিল সোসাইটি যাদের অনেকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শোচ্চার, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনার আয়োজনে মত্ত, গবেষণারত তারা কোথায় ছিলেন? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।