আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের গ্রাম

‘’ আমাদের গ্রাম’’ রচনাটি আমি প্রথম শিখি ক্লাস থ্রিতে উঠে। যে পাঠ্য বই থেকে আমি রচনাগুলো শিখতাম, সেখানে ভিন্ন একটা গ্রাম নিয়ে লেখা রচনা দেখে চিন্তিত হয়ে গেলাম। নিজের গ্রাম নিয়ে এত তথ্য আমি ছোট মানুষ কোথায় পাব? আম্মাই সমাধানটা দিয়ে দিলেন। আব্বা অফিস থেকে ফিরলে তথ্যগুলো জেনে নেওয়া যেতে পারে। রাতে আব্বাকে নিয়ে বসলাম নিজের গ্রাম নিয়ে রচনাটা গুছিয়ে লেখার জন্য।

আমাদের গ্রামের নাম তরগাঁও। এটা আগে থেকেই জানতাম। যেটা জানতাম না সেটা হলো, এ নামটির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল। এ গ্রামের আদি নাম ছিল তরীগাঁও। অনেক নৌকা ছিল বা বানানো হত এখানে।

তাই অমন নাম। তরীগাঁও লোকের মুখে ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল তরগাঁও। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এত সুন্দর তরীগাঁও নামটাকে গ্রামের মানুষ তরগাঁও বানিয়ে দিল! ক্লাসে রচনা লেখার সময় বান্ধবীরা একে অপরের খাতায় দেখতাম, কার গ্রামের নাম কী। সবাই আমার গ্রামের নাম শুনে বলত, ‘’তোমার গ্রামের নামটা তো সুন্দর!’’ তবু তরীগাঁও নামটাই আমার ভাল লাগত।

আমাদের গ্রামটা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। ঐ রচনা লেখার সময় জেনেছিলাম গ্রামে কতগুলো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল ইত্যাদি। আশপাশের কোন গ্রামে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সুযোগ সুবিধা ছিল না। উপজেলার খুব কাছে বলে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল। সেই ছোট্টবেলাতেই দেখেছি সন্ধ্যায় গ্রামের ঘরে ঘরে টিমটিমে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলতে।

রচনা লেখার সময় আব্বা আমাকে শিখিয়েছিলেন, ‘’আমাদের গ্রামে শিক্ষিত লোকের হার ৯৯.৯৯%’’। তখন শিক্ষিত, সাক্ষর, অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এসব টার্ম খুব একটা শুনি নি। আমাদের গ্রামে এত শিক্ষিতের হার শুনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আব্বা তো বড় মুখ করে আরো বললেন, বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিতের হার হলো আমাদের গ্রামে। তথ্যটা কতটুকু সত্য বা মিথ্যা তা যাচাই করা হয় নি কখনো।

তবে কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম। আমার ভাইয়াকেও অমন কথা বলতে শুনেছি। আমাদের গ্রামের সব লোক শিক্ষিত ভেবে ভাল লাগত। আবার মাঝে মাঝে খটকাও লাগত। ঐ যে মুদি দোকানদারটা, তাকে তো শিক্ষিত মনে হয় নি! দাদুবাড়ির গরু রাখে যে লোকটা তাকেও মনে হয়নি।

এই রকম আরো কয়েকজনের কথা আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠত। কিন্তু আব্বার কথাটাও ঠিক ফেলে দিতে ইচ্ছে হতো না। এর অনেক বছর পরে একবার পেপারে দেখেছিলাম বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত জেলা হিসেবে গাজীপুরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমার গ্রামটা আবার এই জেলারই অন্তর্গত। তাই সে সময় নিজের গ্রামটিকেও বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে, বাবার মত আমিও নিজে নিজেই স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম।

গ্রামে আমার খুব বেশি যাওয়া হয় নি। তবে যখনই যেতাম সারাটাক্ষণ কাটত নদীর পাড়ে খেলা করে। ভাল লাগত এপাশে তাকালে রূপালি নদীর ঢেউ আর ও পাশে তাকালে সবুজ ধানক্ষেতের ঢেউ। আশ্চর্য লাগত, নদীর ভেতরের মাটিগুলোও কেমন ঢেউ খেলানো। ওগুলো যে পলি মাটি, এটা জানা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে।

সাঁতার জানা নেই বলে হাঁটুপানি পর্যন্তই আমার দস্যিপনা। এখন ভাবলে অবাক লাগে, যে মা আমাকে এক মুহূর্তও চোখের আড়াল করতে চান না, সেই তিনিই গ্রামে গেলে আমার কোন খোঁজ খবর রাখতেন না। অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে দিতেন না এই ভয়ে, যদি না বুঝে ওরা আমাকে বারান্দায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়! সেই আমিই গ্রামে এসে নদীর পানিতে নেমে খেলা করছি, আম্মা কোন খবরই রাখতেন না! আমার নিজেরই তো ব্যাপারটা ভাবলে ভয় লাগে এখন। ছোটবেলায় মানুষ আসলেই অনেক নির্ভীক থাকে। একটু বড় হবার পরে জানতে পারলাম, তরগাঁওয়ের মেয়েরা নাকি ডেঞ্জারাস! নানুবাড়িতে গেলে প্রায়ই শুনতে পেতাম তরগাঁওয়ের কোন মেয়ে , কীভাবে বাড়ি থেকে ভেগে গিয়ে বিয়ে করেছে, এই রকম মুখরোচক গল্প।

তরগাঁওয়ের মেয়েদের পক্ষেই শুধু এমন ডেঞ্জারাস কাজ করা সম্ভব! অন্য গ্রামের মেয়েরাও যে এ ধরনের ডেঞ্জারাস কাজ করত না, তা নয়। তবু নন্দ ঘোষের মত ‘’ ডেঞ্জারাস’’ ট্যাগটা আমাদের গ্রামের মেয়েদের গায়েই লাগানো ছিল। হয়ত এখনো আছে। তা না হলে, বাসায় কোন কারণে হম্বি তম্বি করলে আম্মা বা ভাবি কেন আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, আমি তরগাঁওয়ের ডেঞ্জারাস মেয়ে! শুধু আমি কেন, আমার ছোট্ট ভাতিজিটাকেও জেদ দেখালে ‘’তরগাঁওয়ের মেয়ে না!’’ শুনতে হয়। উল্লেখ আমার মা ও ভাবি যথাক্রমে বড়হর ও হাইলজোরের মেয়ে।

বড়হরের মেয়েদের মধ্যে মা খালাদের যতটুকু দেখেছি, তাতে তাঁদেরকে ঠিক বুদ্ধিসম্পন্ন মনে হয়নি। যতটুকু বুদ্ধি না থাকলেই নয়, সেটুকুও তাঁদের অনেকের মধ্যে দেখিনি। তার উপর অতি বাচালতা তো আছেই। মা-খালারা একত্র হলেই আমার কানের পোকা তাঁরা নড়িয়ে দেন। আমি অবশ্য আম্মার কাছ থেকে বেশি কথা বলা ও হাবলামি করার মত দুটি গুণই ব্যাপকভাবে অর্জন করেছি।

এই ফিনোটাইপ বৈশিষ্ট্যের জন্য পুরোপুরি তরগাঁওয়ের মেয়ে আর হতে পারলাম কই? যাই হোক! আরেকটু বড় হবার পরে আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলাম। একদিন আম্মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, প্রেমনগর গ্রামটা চিনি কি না। এমন গ্রামের কথা আমার জানার কথা নয়। আমার নিরীহ উত্তর শুনে আম্মা পারলে মাটিরে গড়াগড়ি খেয়ে হাসে। ওটা নাকি আমাদের গ্রামেরই আরেকটা নাম! :O আশপাশের যত গ্রাম, ইউনিয়নের বাসিন্দা আছে, তারা টিটকারী করে এই নাম দিয়েছে।

কারণটাও জানলাম। অন্য গ্রাম বা ইউনিয়নগুলোতে আমাদের গ্রামের মত এত স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা ছিল না। ভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্ররা আমাদের গ্রামে লজিং থেকে পড়ালেখা করত। সে সময় তরগাঁওয়ের প্রতিটি বাড়িতেই দু-একজন লজিং মাস্টার থাকত। আর গ্রামের ঘরে ঘরে ছিল ডেঞ্জারাস সব মেয়ে।

ওরা নাকি রেডিই থাকত লজিং মাস্টারের সাথে প্রেম করে বিয়ে করতে। এই হলো প্রেমনগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই প্রেমনগর নিয়ে আম্মা যতই মশকরা করুক না কেন, আব্বার সামনে ঐসব ‘’ফাতরামি’’ (আব্বার ভাষায়) কথা বললে খবর আছে! এখানেই শেষ হতে পারতো আজকের পোস্টটা। কিন্তু কিছু কথা এখনো বাকি রয়ে গেল। বছর দুই আগে একটি ট্রেইনিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম।

সেখানে আমরা প্রশিক্ষণার্থীরা নিজেদের যত রকম প্রতিভা আছে তা দেখানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম। প্রত্যেকের মত আমারও প্রতিভা ছিল কিছু। সেই প্রতিভা দেখেই কিনা কে জানে প্রশিক্ষক ম্যাডাম আমার নাম ধাম জানতে চাইলেন। দেখা গেল ম্যাডাম আমার দেশী মানুষ! দেশী মানুষ পেয়ে আমরা দুজনেই খুশি। আরেকটু তথ্য ঘাঁটার পরে দেখা গেল আমাদের মধ্যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এক ধরনের আত্নীয়তাও আছে।

আর আমার গ্রামের নাম তরগাঁও জেনে তো তাঁকে আরো খুশি মনে হল। সবাইকে বললেন, ‘’তরগাঁওয়ের মেয়েরা...’’ আমি ভাবছি এই বুঝি ম্যাডাম বলে দেয় ডেঞ্জারাস! ‘’...সুন্দরী, মেধাবী, বুদ্ধিমতী আর সাহসী হয়ে থাকে। ‘’ বিশেষণগুলো আমার কাছে এত নতুন লাগছিল! এতদিনে বুঝতে পারলাম, এই বিশেষণোধারিনীরা কাদের কাছে এত ডেঞ্জারাস! বাসায় এসে আম্মাকে বিশেষণগুলোর কথা শুনিয়ে দিয়ে শান্তি শান্তি লাগলো। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৪৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।