আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহবাগের জন প্রতি ৫০০ টাকার মনস্তত্ত্ব ঃ কগনিটিভ ফাংশন বনাম রুডিমেন্টারি স্কিল

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য শাহাবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় থেকেই কিছু চিহ্নিত পেজ আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে নানা কাহিনী ছড়াতে থাকে। তাদের বিস্ময়ের মুল কারণ ছিল, কোন তাড়নায় হাজার হাজার তরুণ দিন রাত ২৪ ঘণ্টা এই শাহাবাগে এসে থাকছে? নিঃসন্দেহে এটা একটা বিস্ময়কর ফেনমেনা। এই বিস্ময়ের অবগুণ্ঠন খুলে সত্য খুঁজে বের করার ইন্টারেস্টিং এক্সারসাইজ হতে পারতো। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সেটা করছেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কে কাউকে কাউকে দেখছি ৫০০ টাকার তত্ত্বকে বেশ উৎসাহের সঙ্গে প্রচার করছেন।

প্রচার কর্তার মানসিক গঠন বুঝতে পারলে এই প্রচারণার গুঢ় উদ্দেশ্য পরিস্কার হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় আমরা দেখি একটা নিদারুন পণ্য কেন্দ্রিকতা। এখানে সব কিছুই পণ্য। এমনকি ভোটও। বাংলাদেশে ভোটের অবাধ কেনাবেচা হয়।

পণ্য মূল্যে নির্ধারিত হয় কোন সম্পর্ক বা আইডিয়া বিকাবে কিনা। এই অবস্থা অনেক চেষ্টা করে তৈরি করা হয়েছে। এই অবস্থা তৈরির পিছনে আছে বাংলাদেশের উঠতি ধনিক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ চেষ্টা। তারাই ভিতর থেকে সমাজকে আদর্শহীন করে তুলে সম্পদকে একমাত্র কাম্য বস্তু করে তুলেছে। কারণ এই অবস্থাই তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে পারে।

দুর্নীতির অনুপার্জিত সম্পদে কেনা যাবে সকল আনুগত্য। এই অবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের আকাঙ্খা কে রুডিমেন্টারি লেভেলে আঁটকে রাখতে হবে। এই অবস্থায় মানুষের কাছে শুধু শরীরের শ্রম পাওয়া যাবে চিন্তা পাওয়া যাবেনা। মুল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড একইভাবে হয়ে উঠেছে “পাইয়ে দেয়ার রাজনীতি”। যেখানে আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে কর্মীদের রুডিমেন্টারি আনুগত্য পাওয়া যায়।

সেই কর্মীদের শরীরের চণ্ড শক্তিই একমাত্র সম্পদ। তাদের কাছে রাজনীতি হয়ে ওঠে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া। হামলা, ভাংচুর, প্রতিপক্ষকে শারীরিক আক্রমণ, বোমাবাজি এগুলোই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মসূচী। মৌলবাদী দলগুলোও পিছিয়ে নাই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চাকরির লোভনীয় হাতছানি দিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে।

এরা মিছিলে আসার জন্য টাকা পায়, শ্লোগান দেয়ার জন্য টাকা পায়, মারপিটের জন্য টাকা পায়, নেতৃত্বের জন্য টেন্ডার পায়, মাস্তান জোটালে নমিনেশন পায়। বাংলাদেশের রাজনীতি সেকারণেই সংঘাতময় রুডিমেন্টারি লেভেলে আঁটকে আছে। এদের মাথায় শাহবাগ ঢুকবে না। ঢুকাতে হলে ৫০০ টাকা আর বিরিয়ানির গল্প বলতে হবে, তাহলেই তাদের রুডিমেন্টারি চিন্তার জগতে শাহবাগের তারুণ্যের উপস্থিতি যৌক্তিকতা পাবে। মানুষ কিছু কিছু কাজ করে অন্তর্গত তাড়নায়।

শাহবাগ ছিল তেমন একটা তাড়না। স্টিভ জবস এই কথাটাই বার বার বলেছেন, স্পিক টু ইউর হার্ট। হৃদয়ের সাথে এই বোঝাপড়ায় হৃদয় জানতে চায়, কী এমন উচ্চতর আদর্শ আছে যার জন্য আমি প্রানপাত করবো? রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে কর্মীরা লুটপাটের মচ্ছবে যোগ দিতে পারে, কিন্তু কাদের মোল্লার ফাঁসি হলে বস্তুগত কোন লাভ আন্দোলনকারীদের নেই। এখানে উচ্চতর আদর্শ, ন্যায় বিচারের আখাঙ্খা, ইতিহাসের দায় মোচন। এম আই টি তে একটা চমৎকার গবেষণা হয়েছিলো।

কয়েকদল ছাত্রছাত্রীকে ভালো কাজের জন্য আর্থিক পুরস্কারের ব্যাবস্থা করা হোল এবং তাঁদের নানা ধরণের কাজ দেয়া হোল। পুরস্কারের নীতি ছিল যত ভালো কাজ তত বেশী টাকা। ফলাফলটা মজার। দেখা গেলো যদি কাজটা হয় নিছক শারীরিক পরিশ্রমের যেখানে কোন মাথা খাটানোর সামান্যতম সুযোগও নেই, অর্থাৎ রুডিমেন্টারি স্কিল সেখানে টাকা দিয়ে কাজ আদায় করা যায়। কিন্তু সামান্যতম মাথা খাটানোর বিষয় থাকলে অর্থাৎ হাইয়ার কগনিটিভ ফাংশন যেখানে দরকার সেখানে টাকা দিলে কাজ হয়না।

এই ফলাফলে সবাই এত বিস্মিত হয়েছিলো যে পরে অনেক টাকা পয়সা খরচ করে আরেকটা বিরাট পরিসরে গবেষণা করা হোল ভারতের মাদুরাইতে। ফলাফল একই। কারণ কী? কারণ আমরা টাকার জন্য ভালো কাজ করিনা যে কাজে হাইয়ার কগনিটিভ ফাংশন লাগে, করি অন্তর্গত তাড়নায়। যে সমস্ত মানুষ মাথা খাটিয়ে কাজ করে তাঁরা কারো মুনাফা বাড়ানোর জন্য বা বদ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য, কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য, এক ফোটাও পরিশ্রম করতে চায়না, পরিশ্রম করতে চায় আরও অনেক উচ্চতর আদর্শের জন্য। শাহবাগ তেমনই একটা উচ্চতর আদর্শ তরুণদের সামনে হাজির করতে পেরেছিল।

উইকিপিডিয়া আর লিনাক্স এর মতো মুক্ত সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে দারুণ সব পেশাজীবীদের স্বেচ্ছাশ্রমে। যে অভ্র দিয়ে লিখছি, এটাও তাই। কিছুই পায়নি এই নির্মাতারা। অর্থ-যশ বা অন্য কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা থেকে কেউ এগুলো করেনি। তাঁরা তাদের হৃদয়ের কথা শুনেছে।

স্টিভ জবসের ভাষায় তাঁরা ইউনিভার্সে মেড অ্যা ডিঙ। শাহবাগের তরুণরাও সেখানে তাঁদের হৃদয়ের টানে এসেছে। শাহবাগের আন্দোলন প্রচলিত রাজনীতির রুডিমেন্টারি স্কিল নয়, হাইয়ার কগনিটিভ ফাংশন। দে ওয়ান্টেড টু মেক অ্যা ডিঙ ইন দা হিস্টরি। এই তারুণ্যকে রুডিমেন্টারি নলেজ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

প্যাথেটিক লুজারদের অলক্ষ্যেই তারুণ্যের যে আদর্শিক উল্লম্ফন হয়েছে শাহাবাগে, সেই উল্লম্ফন লুজারদের বাংলাদেশে অনাবশ্যক করে দেয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছে; যে লুজাররা নিজের মেধা আর যোগ্যতায় ৫০০ টাকা উপার্জনের ক্ষমতাও রাখেনা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।