আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্বলতা

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। দুর্বলতা মোহাম্মদ ইসহাক খান তাঁর পরাক্রম আকাশচুম্বী। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহদর্শন এই ভদ্রলোকের নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খায়।

তিনি হুকুম দিলে পথের ভিখিরি সাতমহলা বাড়ির বরাদ্দ পেয়ে যায়। আবার তাঁর আদেশেই সকালবেলার একজন বিত্তশালী মানুষ বিকেলে মাথা নিচু অবস্থায় থালা নিয়ে রাস্তায় নেমে যায়। পৃথিবীর অনেক রহস্যের মধ্যে একটি রহস্য হল, মানুষকে দেখলে তার ভেতরটা বোঝা যায় না। অতি ভাল মানুষকে মনে হয় বদের ঝাড়, আবার অতি খারাপ মানুষকে মনে হয় ফেরেশতাতুল্য। এই মানুষটির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি।

তাঁর মুখের হাসিটি শিশুর মতো সরল, দেখে কে বলবে যে তাঁর এই নাজুক কাঁধ দুটিতে বিশাল দায়িত্ব নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আজ দেশ তো কাল বিদেশ। আজ রাস্তায় তো কাল রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। চরম জনপ্রিয় এই মানুষটিকে ছুটে বেড়াতে হয় পথে-প্রান্তরে। অসংখ্য তাঁর ভক্ত, যারা তাঁর জন্য আর্মি কনভয়ের সামনে চিত হয়ে শুয়ে পড়তে পারে।

আবার তাঁর শত্রুর সংখ্যাও বিপুল, যারা তাঁকে হত্যা করতে শিকারি কুকুরের মতো ছুটে বেড়ায় অহর্নিশি। মায়া লাগে মানুষটির নিদারুণ ব্যস্ততা দেখে, তিনি একটুও স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছেন না দেখে, সবসময় কিছু না কিছু ভাবতে হচ্ছে দেখে। মনে হয়, বিধাতা তাঁর জন্য একটি দিন পঁচিশ ঘণ্টার করে দিলেও পারতেন! এই মানুষটির সাথে বহুদিন থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। আমি পেশায় একজন রক্ষী, পয়সার বিনিময়ে মানুষের নিরাপত্তা দিই। কাজটি শুনতে যত সহজ মনে হয়, আসলে ততো সহজ নয়।

এই পেশায় আসার আগে আমাকে অমানুষিক সব প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে, পাঁজরের হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো কঠোর পরিশ্রম করে প্রমাণ করতে হয়েছে যে একজন মানুষ নির্বিঘ্নে আমার শক্ত দুটি হাতে নিজের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দিতে পারে। তারপর থেকে আমি বিভিন্ন মেয়াদে কাজ করেছি, অনেকের নিরাপত্তার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছি যেখানে-সেখানে, অস্ত্র হাতে কিংবা ছদ্মবেশে। শখের বশে এই কাজ করে, এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে হাতেগোনা। কারণ, কাজটি বিপজ্জনক, ভীষণ বিপজ্জনক। বহুকাল আগে আমি কেন এই কাজ বেছে নিয়েছিলাম, আজ আর মনে পড়ে না।

পৃথিবীতে প্রাইভেট গার্ড, স্কুবা ডাইভার এবং সিনেমার স্টান্টম্যান - এই তিন প্রকার মানুষদের জীবনবীমা কোন কোম্পানিই সহজে করতে চায় না, কারণ যখন-তখন যা খুশি ঘটে যেতে পারে তাদের। যা হোক, নিরাপত্তার জন্য তিনি আমাকে নিয়োগ করেছিলেন, মৌখিক এবং শারীরিক পরীক্ষা শেষে। আমি উৎরে গিয়েওছিলাম। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কিংবা বিপজ্জনক রাস্তাগুলোতে তাঁকে নিরাপদে পার করে দিতে আমি সতর্ক চোখ পেতে রাখতাম চতুর্দিকে, আর তাই দীর্ঘ পাঁচ বছরে তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি কোন বিপদ। আমার কাজে খুশি হয়েই কীনা জানি না, তিনি আমার সাথে নানা ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতেন।

পরিবারের ভেতরের কথা পর্যন্ত। হয়তো আমাকে নিজের লোক বলেই মনে করতেন। তিনি যে জগতের মানুষ, সে জগতে কারো ওপর ভরসা করা যায় না। পরম বন্ধুও হাসিমুখে পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়, কিছু টের পাবার আগেই, চোখের পলক ফেলার চেয়েও দ্রুত। কাজেই আমার সাথে তাঁর এ আচরণ ছিল বেশ অযৌক্তিক এবং বিস্ময়কর।

আমিও তাঁর প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলাম। প্রতাপশালী এই মানুষটির ভেতরটি ছিল ফুলের মতো কোমল; যারা তাঁর কাছে আসে নি, তারা কোনদিনও ব্যাপারটি জানতে পারে নি। সবাই তাঁর কাছে আসতো স্বার্থসিদ্ধির জন্য, নানা তদবির নিয়ে, ফায়দা লুটে নিতে। যারা তাঁকে ঘিরে থাকতো, তারা সবাই ছিল চাটুকার, অত্যন্ত ছোট মনের মানুষ; সুবুদ্ধির চেয়ে কুমন্ত্রণাই দিত বেশী। আমি, এই নগণ্য পাহারাদারই বলতে গেলে তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিলাম, অবশ্য যদি তিনি আমাকে সত্যি সত্যি আপনজন, বন্ধু ভেবে থাকেন।

তাঁর কাছ থেকে স্নেহ পেয়ে আমার স্পর্ধা বেড়েই চলছিল। আমি অরফানেজে বড় হয়েছি, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা বিষয়গুলো আমার অজানা ছিল, যার স্বাদ প্রথম তাঁর কাছেই পাই। দিনের পর দিন তাঁর ঠিক গা ঘেঁষে ভ্রমণ করার ফলে তাঁর সত্যিকারের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলাম। এক দিনের কথা আমার খুব মনে পড়ে। তাঁকে একদিন মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, স্যার, আমার মতো একজন বিপজ্জনক মানুষের হাতে আপনার জীবনের নিরাপত্তার ভার।

কখনো কি মনে হয় নি, আমি আপনাকে হত্যা করতে পারি? আমি থাকি আপনার সবচেয়ে কাছে, সকল নিরাপত্তা ব্যূহের ভেতরে। আমার সুযোগই তো সবচেয়ে বেশী। তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হা হা করে হেসে উঠলেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তাঁর মুখ হাসছে, কিন্তু চোখ হাসছে না। কেন হাসছে না, তা বোঝা গেল তাঁর কথাতেই।

তিনি বেদনামাখা স্বরে বললেন, মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী জানো? মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, কাউকে না কাউকে তার বিশ্বাস করতে হয়। জীবন বাঁচাতে, আমাকে হত্যা করতে যারা হন্যে হয়ে ঘুরছে, তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমার দেহরক্ষী রাখতে হয়েছে, অর্থাৎ তোমাকে। তোমার ওপরেও যদি ভরসা করতে না পারি, তাহলে আর লাভ কী? কাজেই তোমার ওপর বাধ্য হয়েই আমাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে যে, তুমি সুযোগ পেলেও আমার অনিষ্ট করবে না, আমাকে খুন করার চেষ্টা করবে না। আমার প্রভুটি এবার সামনের প্রশস্ত রাজপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁকে বেশ উদাস দেখাচ্ছে।

তিনি সারাজীবন সামনের দিকেই তাকিয়ে থেকেছেন, পেছনে তাকানোর সময় কিংবা সুযোগ, কোনটিই তাঁর হয় নি। কোনদিন হবে বলেও মনে হয় না। আমি নিজের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির দিকে তাকাই। কত শক্তিশালী একটি অস্ত্র নিয়ে তাঁর ঠিক পাশেই আমি বসে আছি, যার একটি বুলেটেই বেজে যাবে তাঁর জীবনাবসানের ঘণ্টা। আর তিনি কত নিশ্চিন্তেই না বসে আছেন, কত নির্লিপ্ত।

কুৎসিত এবং ভয়ংকরদর্শন অস্ত্রটির শীতল ক্ষুধার্ত নলটির পাশে এই দুর্বলদেহী মানুষটিকে কত অসহায়, কত ক্ষুদ্রই না মনে হচ্ছে। (১৯ মার্চ, ২০১৩) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.