আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একান্ত সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ -আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন

'শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা, এশিয়ায় যারা আনে শ্রমজীবী সাম্যের দাওয়াত তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকমা। আমাদের ধর্ম হলো ফসলের সুষম বণ্টন...' ধর্ম আর ফসলের 'সুষম বণ্টন' হলেই পরম স্বস্তির মন্ত্রে শ্রেণী উচ্ছেদের জয়গানই গান কবি, এই মন্ত্র পাঠ করতে বলেন প্রিয়তমাকে, যাঁকে সাম্যের দাওয়াতের পোশাকে বীরের মতো সাজাবেন আল মাহমুদ। আদর্শ এক সাম্যের রাষ্ট্রের কথা উচ্চারণ করেন, যা এখন আমাদের স্বপ্নের সীমানায় অবস্থিত। আল মাহমুদ নিম্নবর্গ মানুষের ভাষ্যকার; তাঁর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকৃতি এসেছে সাধারণ মানুষের ঘামের ঘ্রাণে ঘ্রাণে যেন, বিন্যস্ত সমস্ত সত্তায়, চেতনায় আল মাহমুদ মাটি ও শ্রেণীহীন মানুষের কবি। প্রথম দিকের তিনটি কাব্যগ্রন্থ এসবেরই সাক্ষ্য দেয়, পরবর্তী সময়ে তাঁর দার্শনিক বোধে অবক্ষয় দেখা দেয়, এখন তিনি প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমান্তে; সব দোষ মাফ করে দিয়ে আমাদের সামনে চলে আসেন কবি আল মাহমুদ।

সোনালি কাবিনের আল মাহমুদ; তিনি চোখে তেমন দেখতে পান না, কানে তেমন শুনতে পান না, এমন কবির ৭৫তম জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। শিলালিপির পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন শোয়েব সর্বনাম । শিলালিপি : এখন কি লিখছেন? কী লিখছেন? আল মাহমুদ : লিখি তো! কলামটলাম লিখি তো। শিলালিপি : কবিতা? আল মাহমুদ : কবিতাও মাঝেমধ্যে লিখি। খুব কম, কিন্তু লিখি।

শিলালিপি : সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কার কার কবিতা আপনার পছন্দের? আল মাহমুদ : আমার সমসমায়িক যাঁরা লিখতেন, তাঁদের মধ্যে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ছিলেন। আর কারো কথা তো মনে পড়ে না। শিলালিপি : আপনার পরবর্তী সময়ের কবিদের মধ্যে_ আল মাহমুদ : তাঁদের কবিতা তো পড়তে পাই না। আগে যখন স্বাস্থ্য ভালো ছিল তখন হয়তো পড়েছিলাম। এখন চোখে দেখি না, কানেও কম শুনি।

শিলালিপি : আপনি তো নব্বইয়ের দশকের কবিদের নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন আপনার নানান লেখায়... আল মাহমুদ : কোথায় কী লিখেছি তা তো এখন মনে নেই; নব্বইয়ের দশকের কবিতার মধ্যে হয়তো আলাদা কোনো কাব্যবোধ ছিল_সেই জন্যই বলেছি। তরুণরা যখন কবিতা লেখে, তখন সবাই নতুন কিছু একটা আশা করে। আমিও করি। শিলালিপি : কৈশোরেই আপনি নিজেকে ফেরারি বালক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সেই যে ঘর ছাড়লেন আপনি, আর কি ফিরতে পেরেছেন? আল মাহমুদ : আর ফিরলাম কই? আর তো ফিরতেই পারিনি।

গোলকধাঁধার মতো এই নখরে পাক খাচ্ছি। শিলালিপি : আপনার বন্ধুবান্ধব? আল মাহমুদ : বন্ধুবান্ধব তো আর তেমন কেউ বেঁচে নেই। শহীদ কাদরী আছেন, মাঝে মাঝে ফোন করেন। আর তেমন কারো সঙ্গে কথা হয় না। রজত সিকিস্তি আবৃত্তি করে শোনালেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা _ 'শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটি উদ্ভিদ হবে না আপনার এ বাংলাদেশ এরকম নিষ্ফলা, ঠাকুর।

' আল মাহমুদ : এটাও তো কবিতা, এটা তো কবিতাই। কি বলো? শিলালিপি : বাংলা গদ্যসাহিত্য নিয়ে আপনার পর্যালোচনা কী? বাংলা গদ্যে আপনার অবস্থানকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি? আল মাহমুদ : বাংলা গদ্যসাহিত্য খুবই সম্ভাবনাময় এবং খুব আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে আমাদের গদ্যসাহিত্য। এ ক্ষেত্রে আমার অবদান তো আছেই, আমার অবদান কম না। শিলালিপি : সে দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার সার্থকতা কবি হিসেবে বেশি, না গদ্যকার হিসেবে? আল মাহমুদ : দুইটা পরিচয়ই তো আমার আছে, আর এই দুইটা বিষয়েই আমি দক্ষ। শিলালিপি : আপনার ছোটগল্প জলবেশ্যা অথবা কালো নৌকা-র চরিত্রগুলো সৃষ্টির পেছনে আপনার ভাবনা কী ছিল? আল মাহমুদ : আমার অভিজ্ঞতার ভেতরে যেসব চরিত্র আছে, তারাই আমার গল্পে উঠে এসেছে।

তাদের তো নিজের চোখে দেখেছি আমি, কথা বলেছি। তারপর তাদের নিয়ে লিখেছি_তারাই আমার চরিত্র। শিলালিপি : আপনার বিভিন্ন চরিত্রে যেমন নিম্নবর্গীয় মানুষ ছিল, তেমনি ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষ। লক্ষ করলে বোঝা যায়, প্রায় প্রতিটি চরিত্রই যেন কোনো না কোনোভাবে অতৃপ্ত। যৌন বাসনায় যেন উন্মুখ হয়ে থাকে প্রত্যেকে।

বাঙালির কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনি কি মনে করেন সর্বোপরি বাঙালির এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য? আল মাহমুদ : তা না, সেটা আমি মনে করি না। তবে যেসব চরিত্র আমার গল্পে আছে, তাদের প্রত্যেকেই আমার অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি। আকাশ থেকে পড়েনি তো কিছু... শিলালিপি : আপনার উপন্যাস, যেমন উপমহাদেশ (১৯৯৩) অথবা পুত্র (২০০০) পড়ে আমরা দেখতে পাই, এখনো যেন রোমান্টিকতার ঘরানায় বন্দি। অথচ আধুনিক বাংলা উপন্যাস তত দিনে অনেক দূর এগিয়েছে... আল মাহমুদ : হয়তো ঠিকই আছে তোমাদের কথা। শিলালিপি : আপনি কি সচেতনভাবেই গতানুগতিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন? কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি ছিল না একদম শুরুতেও? আল মাহমুদ : দেখো, সাহিত্য এমন একটা বিষয়, এটা সৃষ্টি করা মাত্রই বেশ একটা পরীক্ষা হয়ে যায়।

এর ভেতর আর পরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে কি? শিলালিপি : সব লেখকের জীবনেই লিখতে লিখতে একসময় বন্ধ্যত্ব আসে। আপনি সে সময়গুলো কিভাবে কাটাতেন? আল মাহমুদ : লিখতে না পারলেও পড়তে তো পারবে। আমার উপদেশ হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে প্রচুর পড়তে হবে তখন। শিলালিপি : আপনার কবিতাকে বিশেষায়িত করতে চাইলে কি বলা যায় একজন আল মাহমুদ প্রেম, দ্রোহ ও প্রার্থনার কবি? আল মাহমুদ : আমার আপত্তি নেই। তা বলতে পার! আমার সম্মতি আছে।

শিলালিপি : আপনার মধ্যে মৃত্যুচেতনা কাজ করছে, মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী? আল মাহমুদ : মৃত্যু তো একটা স্বাভাবিক পরিণতি। আমিও মৃত্যুকে সেভাবেই দেখছি। কবি তাকিয়ে থাকেন শূন্য দৃষ্টিতে। যেন বলছেন_'কতদূর এগোলো মানুষ' শিলালিপি : আমরা প্রসঙ্গ বদলাই, জানতে চাই, সাহিত্যকেন্দ্রিক রাজনীতিতে কলকাতার ভূমিকা কী ছিল আপনাদের সময়? কতটুকু প্রভাবিত করতে পারত তা বাংলা সাহিত্যকে? আল মাহমুদ : একসময় তো প্রত্যক্ষ ভূমিকাই ছিল। তবে এখন তা আর নেই।

এখন ঢাকায়ই তো সব কিছু। শিলালিপি : সাহিত্য নিয়ে দুই বাংলায়ই আপনি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছেন, নিন্দিত ও নন্দিত বটে। এর পেছনে কি আপনার ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দর্শন দুটোই কাজ করেছে? আল মাহমুদ : আমার কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। আমি যা করেছি তা আমার কবিতা, গদ্য, কথাসাহিত্য দিয়েই করেছি। শিলালিপি : নগরায়ণের এ পরিবর্তনগুলো আপনাদের সামনেই ঘটেছে, তবুও আপনার কবিতার ভেতর যেন গ্রামটাই বেশি... আল মাহমুদ : এগুলো তো আমার মর্মে ছিল।

কবিতার শরীর যাকে আমরা বলি তা আমার কবিতায়, তার মর্মে মর্মে ছিল গ্রাম প্রকৃতি আর সেখানকার মানুষ। শিলালিপি : সর্বোপরি বাংলা সাহিত্য নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? আল মাহমুদ : বাংলা সাহিত্য মর্মে এবং সময়ে আধুনিক। শিলালিপি : রাজনীতির যে ধারা চলছে বর্তমান বাংলাদেশে, এ থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা চোখে পড়ে? আল মাহমুদ : এই সময়টা সংঘাতময়। তবে আমি তো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই, আমি আশাবাদী। শিলালিপি : ভাষা নিয়ে কথা হলো কিছুক্ষণ।

কথায় কথায় জানতে চাইলাম, তরুণরা যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, এটা কি আপনি সমর্থন করেন? বাংলা একাডেমী তো আইন করার চেষ্টা করেছিল ভাষার ওপর এসব পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য। আল মাহমুদ : ভাষা তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আইন করে এসব বন্ধ করা যায় না। শিলালিপি : পৃথিবীতে আবার ফিরে আসতে হলে আপনি কি কবি হয়েই আসতে চান? আল মাহমুদ : বেশ কঠিন প্রশ্ন। মানুষ তো অভ্যস্ত জীবনই চায়।

শিলালিপি : কলকাতার কবিদের মধ্যে কাদের আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? আল মাহমুদ : শক্তি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। আর তেমন কে আছে? শিলালিপি : দীর্ঘদিন আপনি ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে কর্মরত। সেখানে আপনার উল্লেখযোগ্য অবদান কী? আল মাহমুদ : আমি তো সেখানে চাকরি করতে গিয়েছি। শুধু চাকরিই করেছি, কোনো অবদান রাখতে যাইনি।

শিলালিপি : আপনার 'শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ' বইটি উৎসর্গ করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে। তাঁর সাহিত্য কেমন লাগে আপনার কাছে? আল মাহমুদ : অ্যাঁ? উৎসর্গ করেছি নাকি? যাই হোক উনি তো সাহিত্য তেমন করতে পারেননি। সংগঠন-টংগঠন করেছেন। শিলালিপি : অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তো আপনাকে নিয়ে বেশ ক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন... আল মাহমুদ : আমি তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। ওতো একটা পাগল।

শিলালিপি : আহমদ ছফাকে চিনতেন আপনি? আল মাহমুদ : আহমদ ছফা, আমার ধারণা, খুব একটা সক্রিয় সাহিত্যিক না। শিলালিপি : লিটলম্যাগ আন্দোলন আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আল মাহমুদ : লিটলম্যাগ আন্দোলন সাহিত্যেরই আন্দোলন। যখন কোনো আন্দোলন হয় তখন বুঝতে হবে তরুণরা কিছু বলতে চায়। লিটলম্যাগ সে রকম কিছুই একটা হবে। শিলালিপি : সব মিলিয়ে কবি আল মাহমুদ সফল নাকি ব্যর্থ? আল মাহমুদ : সফলই তো মনে করি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।