আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপালি টেডি বিয়ার

যে জেলে নিরুপায় বুকে হাত দিয়ে বসে আছে আমি তার কথা ভাবি আমি ফাতিমা, আমার বয়স আট। সারাজীবন মানুষের কাছ থেকে শুনে এসেছি আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা, সত্যি বলতে, সমবয়সী অন্যদের চাইতে আমার নিজেকে আসলেই আলাদা মনে হয়, আমি যেখানে থাকতাম সে স্থানের জন্যই এমন হয়েছে। আমি স্কুলে যেতাম, অনেক বন্ধু ছিল, বন্ধুরা সবাই সবাইকে খুব ভালবাসতাম, বন্ধুরা বন্ধুর আনন্দে আনন্দিত হতাম দুঃখে হতাম দুঃখিত, তারা আমার কাছে দ্বিতীয় পরিবারের মতই ছিল । আমার একটি পরিবার ছিল, মা ছিল, চার ভাই ছিল এবং একটি বোন ছিল… এখন নেই। একদিন, যেদিন আমার সব শেষ হয়ে গেল, ঐ দিনের কথা আমার খুব ভাল মনে আছে, কারণ সেদিন ছিল আমার বোনের জন্মদিন।

সেদিন আমরা সবাই তাড়তাড়ি উঠে গিয়েছিলাম, সকালে ঘরে অনেক হৈ হুল্লোড় হচ্ছিল, আমার ভাইয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে বোনের কাছ থেকে তার উপহার লুকানোর চেষ্টা করছিল, মা একটি দারুন সুগন্ধি কেক তৈরী করছিল এবং আমি তা সাজাতে সাহায্য করছিলাম। তারপর আমরা সবাই বোনকে জ›মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে একত্রিত হলাম, মা চকচকে কাগজে মোড়ানো খুব বড় একটি উপহার দিলেন, আমরা জানতাম না তাতে কি ছিল। আমার বোন মা কে উষ্ণ চুমুতে ধন্যবাদ জানালো। হঠাৎ মায়ের মুখে আমি তীব্র আতঙ্ক দেখতে পেলাম, চোখে ছিল ভয়ানক ভয়ের ছাপ, সেকেন্ডের ভগ্নাংশকাল স্থায়ী ছিল সে দৃষ্টি, এরপর সবই অন্ধকার। আমি জানিনা কতক্ষণ অচেতন ছিলাম, কিন্তু যখন চোখ মেললাম, আমি অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পেলাম, এটা আমার ভাইদের হুল্লোড়ের শব্দ ছিল না, অনেক মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছিল এবং চিৎকার করে কাঁদছিল।

অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম আমি ধ্বংসস্তুপের মধ্যে রয়েছি….. আমি রাস্তায় এবং আমার মাথার উপরে কোন ছাদ নেই। আমি কাঁদতে শুরু করলাম এবং লক্ষ্য করলাম আমার মত আরো অনেকেই কাঁদছে এবং কারো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি কোনমতে উঠে দাঁড়ালাম এবং বাকিদের খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলাম। “মা” আমি কয়েকবার চিৎকার করে ডাকলাম “মা”… কেউ জবাব দিলনা। আমি হাঁটছি এবং হাঁটছি… আমার মনে হলো আমি অনেকক্ষণ যাবৎ হাটছি, সর্বত্রই একই দৃশ্য, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এবং আহত লোকেরা কাঁদছে।

আমি শুধু পরিচিত মুখের খোঁজ করছিলাম। ঠিক সেই সময় আমি ইটের নিচে উজ্জ্বল কিছু একটা দেখতে পেলাম, আমি সেটা হাতে তুলে নিলাম, এটি ছিল উপহার মোড়ানোর একটি কাগজ। সেটি অর্ধেক খোলা এবং সেখানে কিছু একটা ছিল, হ্যাঁ এইতো, একটি সুন্দর একটি রপালী টেডি বিয়ার…যদিও ওটা আর সুন্দর দেখাচ্ছিল না, ওটা ছিড়ে গিয়েছিল এবং তাতে রক্ত লেগে ছিল। আমি উপহারের কাগজটির দিকে আবার তাকালাম, কী আশ্চর্য! এটা সেই কাগজ যা আমার মা আমার বোনকে উপহার মুড়িয়ে দিয়েছিল। “তার মানে সে কাছে কোথাও আছে”- আমি ভাবলাম।

আমাকে সাহায্য করার জন্য আমি কাউকে খুঁজছিলাম, সবচাইতে কাছে যে অ্যাম্বুলেন্সটি দেখলাম তার কাছে গেলাম এবং কাউকে সাহায্য করতে বললাম। সবাই ব্যস্ত ছিল তবু একজন রাজি হল আমাকে সাহায্য করতে। আমরা ধ্বংসস্তুপের মধ্যে খুঁজতে শুরু করলাম কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর লোকটি, “সকালে একটি উদ্ধারকারী দল আসবে” এই বলে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে রাত ঘনিয়ে এল, আমি কাঁদতে থাকলাম এবং কখনো বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা ভাবতে লাগলাম।

এটা ছিল একটা ভয়ঙ্কর রাত। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই একটা টেলিভিশন দৃশ্যের মত মনে হচ্ছিল। এ ধরণের দৃশ্য যখনই টেলিভিশনে দেখানো হতো, মা তখন চ্যানেল পাল্টে ফেলতেন, কারণ তাতে রক্ত এবং রিপোর্টের ভাষ্যে “সহিংসতা” দেখানো হতো। যদিও “সহিংসতা বলতে কী বোঝানো হত তা আমি কখনোই বুঝতাম না। আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম, আমাদের কখনো এমন হবে কিনা, এসব কথা বললে মাকে খুব বিমর্ষ দেখাত এবং তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতেন।

আমি টেডি বিয়ারটি হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকলাম…কিছু খালি দোকানের পাশ দিয়ে যেতে আমি টিভির শব্দ শুনতে পেলাম। তখন সন্ধ্যার খবর চলছিল এবং তাতে “বোমা” এবং “হামলা” এ ধরনের কিছু নিয়ে বলা হচ্ছিল। আমি সবকিছু ভালভাবে বুঝিনি কিন্তু শত শত মানুষ নিহত হওয়ার ব্যাপারটি বুঝলাম। “শত শত? এত মানুষ!” আমি ভাবলাম, তার মানে আমি আর কখনই আমার পরিবারের কাউকে দেখতে পাবো না? আমি জানি না কিন্তু আমি খুব ভীত ছিলাম এবং অনেক ক্লান্তও। আমি চোখ খোলা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ফাতিমা?… ফাতিমা, উঠ…তুমি ঠিক আছো? আমি চোখ খুললাম এবং অবশেষে একটি পরিচিত মুখ দেখতে পেলাম, তিনি ছিলেন আমার চাচা। “আপনি কীভাবে আমাকে খুঁজে পেলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, কি ঘটেছে তিনি শুনেছেন এবং আমাদের খোঁজে তিনি এসেছেন, তিনি সারারাত আমাদের খোঁজ করেছেন। আমিও যে পরিবারের সবাইকে খুঁজেছি তাও আমি তাকে জানালাম। তখনকার জন্য তিনি আমাকে তার সাথে থাকতে বললেন, তিনি শহরের অন্য দিকে থাকতেন।

সেই রাতে আমি ঘুমাইনি, আমার মনে হয় কেউই ঘুমায়নি, সেদিনের ঘটনায় আমরা সবাই শোকাহত ছিলাম। আমি খেয়াল করার আগেই…ভোর হয়ে গিয়েছিল, চাচা আমাকে কিছুক্ষণ ঘুমাতে বললেন, আমাদের আরেকটি দীর্ঘ দিনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু আমি সহজেই বুঝতে পারলাম, চাচাও রাতে ঘুমাননি। চাচার গাড়িতে করে আমরা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, এক সময়কার পরিচিত দালানগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দালানগুলোর জায়গায় শূণ্যস্থান দেখে আশ্চর্য এক অনুভূতি হচ্ছিল। পুরোটা সময় আমি টেডিটি ধরে রেখেছিলাম, এটাই আমার কাছে একমাত্র আশা ছিল, আমার বোন কে ফিরে পেলে আমি তাকে এটা ফিরিয়ে দেবো।

আমাদের বাড়ির আশেপাশে যে হাসপাতালগুলো ছিল সেগুলোতে খোঁজ করতে শুরু করলাম, যদিও সেগুলোকে দেখতে আর হাসপাতালের মত লাগছিল না, সেখানে এমন ভীড় ছিল যে, আমার হাঁটার মত জায়গাও ছিল না। হাসপাতালের এক কর্মীকে চাচা আমার পরিবারের বর্ণনা দিলেন, কিন্তু কোন জবাব পেলেন না। সারাদিন অসহায়ভাবে আমরা খুঁজতে থাকলাম, কিন্তু কাউকে পেলাম না। হতাশ ও ব্যাথাতুর মনে আমি চাচার সাথে ফিরে গেলাম। আমি সেখানে এক সপ্তাহ ছিলাম, দিনগুলো শুধু খারাপই হচ্ছিল, যতই সময় যাচ্ছিল আমি ততই আমার পরিবারের অভাব বোধ করছিলাম, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

এবং টেডি বিয়ারটি কখনই আমার সঙ্গ ত্যাগ করেনি। একদিন আমার চাচা আমার কাছে আসলেন। তাঁর বিবর্ণ চেহারা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি বিছানায় আমার পাশে বসলেন এবং বললেন, “আমি তোমার ভাইকে পেয়েছিলাম। ” তাঁর বলার ভঙ্গি দেখে আমি দ্বিধান্বিত হলাম।

চাচা বললেন, “আমি দুঃখিত। ” আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না, হয়তো তখনো কিছুই বুঝিনি। “সে চলে গেছে, তোমার পরিবারের সবাই চলে গেছে!” “চলে গেছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি বোঝাতে চাইছেন তারা সবাই মৃত?” আমি টেডিটির দিকে তাকালাম, মনে হচ্ছে এটাই আমার পরিবারের একমাত্র বস্তু যা আমার কাছে রয়েছে। “ফাতিমা, তুমি নিশ্চিত থাকো, তারা সকলেই বেহেশতে আছে। তুমি কি তাদের সুখ চাও না?” চাচার কথার কয়েকটি শব্দই আমি শুনলাম।

সেদিন আমিও তো তাদের সাথে ছিলাম…শুধু আমিই কেন বেঁচে গেলাম? আমিও কেন নিহত হলাম না? আমার পরিবারকে ফিরে পেতে হলে আমাকে কি করতে হবে? আমাদের সাথেই বা কেন এমন হল? আমাদের দেশেই কেন সবসময় এমন হবে? সেদিনের পর অনেক বছর কেটে গেছে। এখন আমার বয়স তিরিশ। আমার নিজের একটি পরিবার আছে। আমি জানি, যে কোন দিন আমি এদের যে কাউকে সহজেই হারাতে পারি। কিন্তু আমি স্বেচ্ছায় আমার ও আমার পরিবারের জীবন উৎসর্গ করতে পারি সেই মহান উদ্দেশ্যে, যার জন্য আমার জন্ম হয়েছে: আমার ধর্মকে রক্ষা করা, দেশকে রক্ষা করা।

এটা আমার পরিবারের গলপ, আমার গল্প, এক আট বছর বয়স্ক ফিলিস্তিনি বালিকার গল্প। লেখক: সালমা তানতাওই, সাংবাদিকতা বিভাগ, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর। অনুবাদ: এস. এম সাইফুল্লাহ শাকিল  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।