আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুটবল বিবর্তনঃ ট্যাকটিকসের সৃষ্টি এবং বিলুপ্তি

ইকার এর নিঃসঙ্গ বচন একটা সময় ছিল যখন ফুটবলে "ওয়ান ম্যান শো" ব্যাপারটা হরহামেশাই দেখা যেত । ৮৬ এর ম্যারাডোনার কথাই ধরুন । রীতিমত একা হাতে (নাকি পায়ে ?) আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছিলেন তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা । কিংবা ধরুন ৯৮ এবং ০৬ এর জিদান এর কথা । ৯৮ এ ফ্রান্সের দলটা অবশ্য খুবই ব্যালান্সড ছিল ।

শুরু থেকেই তারা ভালো খেলছিল । রক্ষণে লেবেউফ-দেসাইলি-ব্লাঙ্ক । মধ্যমাঠে জিদান, পেতিত , ভিয়েরা , দেশম , কারেমবেউ । আর সামনে ডিওরকায়েফ সাথে তরুন অনরি । গোলবারের নিচে বিশ্বস্ত প্রহরী ফ্যাবিয়ান বারথেজ ।

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্রাজিলকে রীতিমত নাকানিচুবানি খাইয়ে ফাইনালে ৩-০ গোলে জিতেছিল ফ্রান্স । যার দুই গোলই জিদানের করা । কিন্তু ০৬ এর কথা ? বিশকাপে খেলতে পারবে কিনা সে আশঙ্কাতেই অবসর ভেঙে প্রত্যাবর্তন করেন জিদান । পরেরটুকু তো ইতিহাস । কোনোমতে গ্রুপ পর্ব পেরুনো দলটিকে নিয়ে তিনি একক দক্ষতায় পার করেছেন একে একে স্পেন , পর্তুগাল , ব্রাজিল এর মত বাধা ।

আর ফাইনালে যদি মাতেরাজ্জিকে সেই বিখ্যাত ঢুশটি না মারতেন তাহলে হয়তো শিরোপাও পেতে পারতো ফ্রান্স । কিন্তু আজকাল কিন্তু এই ওয়ান ম্যান শোর দাপট কমে গিয়েছে - যদি না হিসেবটা মেসি-রোনালদোকে সহ করেন । এর কারণ কি ? কারণ হিসেবে বলা যায় ট্যাকটিকসের পরিবর্তন । একটা উদাহরন দেই । ২০০২ সালের বিশকাপ জেতা ব্রাজিলের ফরমেশন ছিলঃ ৪-৪-২ , যেটা কিনা কার্যক্ষেত্রে ২-৪-৩-১ এর মত হয়ে যেত ।

সামনের দিকে রোনালদোর ঠিক পিছের হোলটায় খেলতেন রিভালদো , সাথে ডানে-বায়ে রোনালদিনহো-রিকারডিনহো । কাফু-কার্লোস ঠিক উইং ব্যাক ছিলেন নাকি উইঙ্গার ছিলেন, ঠিকমত বোঝাই যেতনা - এমনই ছিল তাদের ওভারল্যাপিং । সেই ব্রাজিল আজকাল খেলে ৪-২-৩-১ ফরমেশনে । যা হোক, সবাই তো আর ব্রাজিলের সাম্বা নাচের তালে "জোগো বনিতা" খেলতে পারেনা, তাই ইউরোপে চলত ল্যাটিন ফুটবলের বিপরীত ঘরানার পাওয়ার ফুটবলের চর্চা । জার্মানি আর ইংল্যান্ড এই ঘরানার সফল ধারক বাহক ।

প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বলের দখল নিন , বল উঁচু করে সামনে বাড়ান , সামনে থাকা টার্গেট ম্যানের কাছে বলটা কোনোমতে পৌছান - বাকি দায়িত্ব তার । এই ঘরানার ফুটবলের মাঝেও শৈল্পিক ফুটবলের চর্চাটা ধরে রেখেছিল স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ । ছোট ছোট পাসের সমন্বয়ে আক্রমণ গড়ে আস্তে আস্তে উপড়ে ওঠা - ল্যাতিন ফুটবলের যে বৈশিষ্ট্য - ইউরোপে তার সফল প্রয়োগ দেখিয়েছে স্পেন । আজকে যে ফুটবল রাজ্যে স্প্যানিশ দাপট , সেটা কিন্তু আচমকা কোনো বিষয় না । বহুদিন ধরে বহুল চর্চিত ফর্মুলাটি যখন সবার একইসাথে ক্লিক করা শুরু করেছে , তখনই তারা অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া শুরু করেছে ।

২০০০ সালের ইউরো । ফ্রান্স-জার্মানি-পর্তুগাল-ইতালি-স্পেন ইউরোপের সকল পাওয়ার হাউসই রীতিমত দুর্ধর্ষ খেলছে । শিরোপা কার ঘরে যাবে মোটেই বঝা যাচ্ছে না । সকলের এইরকম সাফল্যর মাঝে সেই টুর্নামেন্টে রীতিমত ধুকছিল ইংল্যান্ড । কারণটা সহজ ।

প্রতিটি দলের ছিল একজন করে টিপিক্যাল প্লেমেকার , যারা কিনা ৪-৪-২ (ডায়ামন্ড) এর ছকের দুই স্ট্রাইকারের পিছনের হোলটায় খেলছিলেন এবং গোলের সুযোগ তৈরীতে মুখ্য ভুমিকা রাখছিলেন । ইতালিতে এই রোলকে বলা হয় "ট্রেকোয়ারটিস্টা" । নিজ নিজ দলে এই ভুমিকা পালন করছিলেন জিদান,রুই কস্তা,টোট্টি,রাউল । ইংল্যান্ডে এই পজিশনের চল ছিলনা দেখে তারা এই পজিশন প্রয়োগ করতে পারেনি এবং ইউরো ২০০০ এ তারা করুণভাবে বিদায় নেয় । ২০০০ সালের দিকে এসে ট্রেকোয়ারটিস্টা রোলটি এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ ছিল নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে জুভেন্টাসে জিদানের এই রোলের সার্থক প্রয়োগ এবং পরবর্তীতে একই রোল ব্যাবহার করে ৯৮ বিশকাপে ফ্রান্সের সাফল্য ।

কিন্তু আজকের এই কট্টর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে ট্রেকোয়ারটিস্টা রোলটি প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে । সময়ের প্লেমেকারদের দেখুন । মেসি,ওজিল,ইনিয়েস্তা,সিলভা,কাকা,বোয়াটেং । এদের কেউই টিপিক্যাল ট্রেকোয়ারটিস্তা নন । মাঝখানে এসি মিলানে থাকাকালীন সময়ে কাকা এই রোলে খেলেছেন, এবং মিলান সেইসময়ে সাফল্যও পেয়েছে প্রচুর ।

এক মেসি হতে পারতেন এই যুগের সফল ট্রেকোয়ারটিস্তা । কিন্তু বার্সা তে ফলস নাইন পজিশনে খেলতে খেলতে তার আসলে তার পজিশনটা বোঝাই হয়ে গিয়েছে দুষ্কর । ২০০৪-০৫ সালের আর্সেনাল । ৪-৪-২ ছকের দুই ফরোয়ার্ডের একজন অনরি । কিন্তু তাকে বারগক্যাম্পের থেকে একটু পিছিয়ে খেলে ফরমেশনটাকে ওয়েঙ্গার বানিয়ে দিলেন ৪-৪-১-১ ।

সেদিনের সেই ৪-৪-১-১ এর বিবর্তিত রুপই আজকের ৪-২-৩-১ । ব্যাক ফোরের সাথে মধ্যমাঠে দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার , যাদের কেউ একজন হয়তো রক্ষনমনা হন । সামনে স্ট্রাইকারের পেছনে একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার । দুই প্রান্তে দুজন উইঙ্গার । বর্তমান ফুটবলে সবচে জনপ্রিয় ফরমেশনগুলোর একটি ।

এই ট্যাকটিকসের সার্থক প্রয়োগ আমরা দেখেছি জার্মানির কাছ থেকে, ২০১০ বিশকাপে । বালাকের অনুপস্থিতিতে শোয়ানস্টাইগার মধ্যমাঠে জুটি বাঁধেন খেদিরার সাথে । সামনে পোডলস্কি-ওজিল-মুলার । স্ট্রাইকার হিসেবে বর্ষীয়ান ক্লোসা । তুখোড় জার্মান মেশিন ফুটবলের সাথে কিছুটা শিল্পর মিশেল ঘটলে যে সেটি প্রতিপক্ষের জন্য কতটা ভয়ানক হতে পারে তার প্রমান সেই জার্মান দল ।

এর মাঝে স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা আবার ফুটবলের সকল ট্যাকটিকসকে কাঁচকলা দেখিয়ে অদ্ভুতুড়ে এক ট্যাকটিকসে খেলে । টোটাল ফুটবলের সাথে ল্যাটিন স্লো পাসিং ফুটবলের মিশেলে এই ঘরানার নাম "তিকিতাকা" । রাইনাস মিশেল যে টোটাল ফুটবলের উদ্ভাবক ছিলেন সেই টোটাল ফুটবলটা সবচে ভাল খেলতেন যিনি, সেই ইয়োহান ক্রুইফ একসময় বার্সেলোনাতে খেলা শুরু করলেন । কালক্রমে তিনি হয়ে গেলেন বার্সার কোচ । তাদের ইয়ুথ একাডেমী "লা মাসিয়া" এবং বয়সভিত্তিক সকল দল নিয়ে শুরু করেন টোটাল ফুটবল এর চর্চা ।

স্পেনে আগে থেকেই ল্যাটিন ঘরানার পাসিং ফুটবল চলতো । টোটাল ফুটবল এবং পাসিং ফুটবল - দুইয়ে মিলে হয়ে গেল এক অনন্য সৃষ্টি - "তিকিতাকা" । বার্সার ফরমেশনটা কাগজে কলমে ৪-৩-৩ হলেও বাস্তবে দেখা যায় এটি এতই ফ্লুইড যে কে কখন কোন পজিশনে খেলছেন বোঝাই যায়না । সাথে যোগ করুণ লিওনেল মেসির ফলস নাইন খেলা । তাদের বিপক্ষে যে আপনি আগে থেকে হোমওয়ারক করে রাখবেন ট্যাকটিকস নিয়ে সে আশায় গুড়েবালি ! পাওয়ার ফুটবলই বলুন কিংবা তিকিতাকাই বলুন, বাস্তবতা হচ্ছে ফুটবল দলীয় একটি খেলা ।

একা একজন খেলোয়াড় দলকে বিশকাপ জিতিয়ে দিবে , সেই দিন শেষ । দল হিসেবে যারা ভাল খেলছে তারাই এখন সাফল্যর মুখ দেখছে । সুতরাং শেষ পর্যন্ত যতই ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স ফুটবল অনুরাগীদের দ্বারা সমাদৃত হোক না কেন, সেই বহুল চর্চিত বাংলা প্রবাদই সকলের কানে বাজা উচিৎ - " দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ । " ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.