আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল আমদানি করে নাকি এদশের চাল ভারতে পাচার হয়? (সরকারি হিসাবেই এদেশে উদ্বৃত্ত চালের পরিমাণ দেড় কোটি টন!)

সামুতে কিছু ভারতের দালাল রয়েছে কথায় কথায় বলে আপনি আজ কোন দেশের চালের ভাত খেয়েছেন জানেন? “ভারতের”! সত্যিই কি আমরা ভারতের চালের ভাত খাই? ভারতের চালের ভাত ছাড়া কি আমরা না খেয়ে থাকবো? আমরা আমদানি নির্ভর? প্রতি বছর আমরা শুনি খাদ্যের বাম্পার ফলন! বাম্পার ফলন! কিন্তু এতো বাম্পার ফলন যায় কোথায়? খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এবার ২০০৯-১০ অর্থ বছরে খাদ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা যাবে’। পরে আবার বললেন, ‘আমরা এবার খাদ্য রফতানি করতে পারবো না’। কিন্তু কেন পারবেন না তার জবাব দেননি। বরং এরপরে আরো উল্টো বলেছেন।

অর্থাৎ খাদ্য রফতানির পরিবর্তে আমদানির কথা বলেছেন এবং করেছেন ও করছেন। প্রকৃত সত্য হলো- এদেশে যে চাল উৎপাদন হয় তাতে দেশের চাহিদা মিটেও অনেক উদ্বৃত্ত থাকে; যা আসলেই রফতানি করা যায়। কিন্তু রফতানির পরিবর্তে এখন যা হয় তা হল অবৈধভাবে পাচার হয়। এর সাথে যুক্ত দুর্নীতিবাজ সরকারি ও বেসরকারি শক্তিশালী চক্র। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সাম্প্রতিক রিপোর্টেও বিষয়টি প্রকাশিত হচ্ছে।

পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে- * বাগেরহাটে ওএমএসের চাল পাচারকালে একটি কার্গো জাহাজ আটক। * লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় পাচার কালে রিলিফের ৮ বস্তা চাল আটক করেছে জনতা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। * মোরেলগঞ্জে কালোবাজারে বিক্রির জন্য পাচারকালে ৯ বস্তা ওএমএসের চাল উদ্ধারের ঘটনার ৩ দিন পর অবশেষে ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে থানায় মামলা হয়েছে। * গত জুন মাসে চট্টগ্রাম নগরীর এক গুদাম থেকে একশ মেট্রিক টন রপ্তানি নিষিদ্ধ চাল জব্দ করা হয়েছে। * চট্টগ্রামের গোল্ডেন কন্টেইনার ডিপো থেকে এর আগেও দুটি কন্টেইনারে করে চাল পাচার হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

পাচারকারীরা এমনই চতুর যে, মাঝেমধ্যে দু’একটি চালান ধরা পড়লেও তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রায় সাত মাস আগে এ রকম আরো একটি চালান আটকানো হয়েছিল। সে চালানটি রফতানি করতে যাচ্ছিল ঢাকার ফারিয়া এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সেবার দুটি কন্টেনার আটক করা হয়। কিন্তু সেখানে ঘোষণায় ৩০ টন ফিরনি মিক্সড উল্লেখ থাকলেও পাওয়া যায় ৯ টন চাল।

শুল্ক ও গোয়েন্দা শাখার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে অসৎ কিছু ব্যবসায়ী বিবিধ রফতানি পণ্যের আড়ালে চালই পাচার করছে না ঘোষণার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকার থেকে ক্যাশ ইনসেনটিভও আদায় করে নিচ্ছে। অর্থাৎ পাচার হচ্ছে চাল কিন্তু এর কাগজপত্রে থাকছে অপ্রচলিত পণ্যের নাম, যার বিপরীতে সরকার ইনসেনটিভ দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, চাল পাচারের এসব টুকরো খবরের আড়ালে প্রকৃত সত্য হল ওএমএস-এর চাল থেকে আরম্ভ করে দেশের সব ধরনের চালই লাখ লাখ টন পাচার হয় এবং দেশের সব সীমান্ত থেকেই সব উপায়েই পাচার হয়। বিবিএস পরিচালিত Household Income & Expenditure Survey, ২০০৫ মোতাবেক মাথাপিছু খাদ্যশস্যের চাহিদা নির্ধারিত ছিল ৪৬৯ দশমিক ২ গ্রাম, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ছিল ৪৩৯ দশমিক ৬ গ্রাম। আর কৃষি মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মাথাপিছু দৈনিক ৫০০ গ্রাম চাহিদার ভিত্তিতে বার্ষিক খাদ্যশস্যের চাহিদা ১৮২ দশমিক ৫ কেজির এ হিসেবে দেশের মোট জনসংখ্যার জন্য বার্ষিক কী পরিমাণ খাদ্যশস্যের দরকার তা বের করা যায়।

সর্বশেষ আদমশুমারির সংখ্যা জানা যায় ১৪ কোটি ২৩ লাখ। মাথাপিছু বার্ষিক ১৮২.৫ কেজি হিসাবে ১৪ কোটি ২৩ লাখ জনসংখ্যার জন্য ২ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্যের দরকার হয়। চূড়ান্ত গণনায় জনসংখ্যা ১৫ কোটিতে দাঁড়ালে খাদ্যশস্য প্রয়োজন হবে ২ কোটি ৭৪ লাখ টন। এ থেকে বছরে ৪০ লাখ টন গমের চাহিদা বাদ দিলে ১৫ কোটি জনসংখ্যার জন্য চালের চাহিদা দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৪ লাখ টনে। একই পদ্ধতিতে পঞ্চম আদমশুমারির প্রাথমিক ফলে পাওয়া ১৪ কোটি ২৩ লাখ জনসংখ্যার জন্য চালের চাহিদা ১০ লাখ টন কমে দাঁড়াবে ২ কোটি ২৪ লাখ টনে।

অপরদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষকদের মাঝে স্বল্পমূল্যে সার, বীজ ও সেচ সুবিধা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রে রোগ-ব্যাধি কম হওয়ায় ২০১০-১১ অর্থবছরে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। চালের উৎপাদন ১ কোটি ৮৭ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। বোরো উৎপাদনের চূড়ান্ত হিসাব না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ধরে হিসাব করলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৬ লাখ টন। গমসহ মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৬ লাখ টন। মোট উৎপাদন থেকে সরকারি ফর্মুলা মোতাবেক ১২ শতাংশ বীজ, পশুখাদ্য ও অপচয় হিসেবে ৪১ লাখ ৫২ হাজার টন বাদ দিলে মানুষের খাওয়ার জন্য পাওয়া নিট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৮ হাজার টন।

এর থেকে ৯ লাখ ৭০ হাজার টন গম বাদ দিলে শুধু চালের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৪ লাখ ৭৮ হাজার টন। অর্থাৎ পঞ্চম আদমশুমারির প্রাথমিক ফলে পাওয়া ১৪ কোটি ২৩ লাখ জনসংখ্যার জন্য ২ কোটি ২৪ লাখ টন চালের চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্তি দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৪ লাখ ৭৮ হাজার টন। সেক্ষেত্রে ২০১০-১১ অর্থবছরে উৎপাদিত চালের উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০ লাখ ৭৮ হাজার টন। অপরদিকে ত্রিশ লাখ টন চাল আমদানির সাথে যোগ দিলে উদ্বৃত্তের পরিমাণ হয় এক কোটি টনেরও বেশি। আর বিশ লাখ ঊর্ধ্ব জনসংখ্যা রয়েছে যাদের বয়স ছয় মাসের নিচে এবং যারা দানাদার খাদ্যশস্য গ্রহণ করে না।

সেক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত চালের পরিমাণ আরো বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৫ লাখ টন। এছাড়া বিবিএসের হিসেবেই দেশে এখনো ২০ শতাংশ ঊর্ধ্ব লোক অতি দরিদ্র। যারা তিনবেলা খাবার খেতে পারে না। অর্থাৎ দেশের ৩ কোটি লোক প্রতিদিন ৫০০ গ্রাম করে খাবার খায় না। তাতে যদি ২৫০ গ্রাম করেও ধরা হয় তাহলে চালের উদ্বৃত্ত বাড়বে প্রায় আরো প্রায় দশ লাখ টন।

অর্থাৎ সরকারি হিসেবেই দেশে উদ্বৃত্ত বা রফতানিযোগ্য চালের পরিমাণ হচ্ছে দেড় কোটি টন। অন্যদিকে চূড়ান্ত গণনায় ১৫ কোটি জনসংখ্যা ধরে ২ কোটি ৩৪ লাখ টন চালের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত চালের উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লাখ ৭৮ হাজার টন। আর ১৬ কোটি উর্ধ্ব জনসংখ্যা ধরেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব ধরেই দেশে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭০ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো বেশি। কারণ শুধু বোরোই ২ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে না অন্যান্য ধানের পরিমাণও মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চেয়ে বেশি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঊদ্বৃত্ত চাল যাচ্ছে কোথায়? অথবা চালের দেশের লোক উচ্চ মূল্যে চাল কিনছে কেন? ভাতের দেশের লোক কেন হাভাতে হয়ে আছে? এর সোজা সাপ্টা জবাব হচ্ছে দেদার চাল পাচার হচ্ছে সীমান্ত দেশ ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। উল্লেখ্য, অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি হলে দাম বাড়ার কথা নয়, কমার কথা। সেক্ষেত্রে দেশে সরবরাহের চেয়ে প্রায় দেড় কোটি টন চাল বেশি থাকায় চালের দাম আক্ষরিক অর্থেই দশ টাকায় থাকার কথা। প্রসঙ্গত, এবারের নির্বাচন দশ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের। বলাবাহুল্য, এ প্রতিশ্রুতি প্রকৃতপক্ষে পর্যালোচনার ভিত্তিতেই এসেছিল।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে যে দেড় কোটি টন ঊর্ধ্ব চাল দেশ থেকে পাচার হচ্ছে তা বন্ধ করা হচ্ছে না। অথচ চালের দেশে তথা ভাতের দেশে ভেতো বাঙালি হাভাতে হয়ে বেঁচে আছে। সবচেয়ে বড় কথা হাভাতে বাঙালি যে নিজেরা না খেয়ে ভারত, ইউরোপে নিজের হক্বের চাল পাচার করতে দিচ্ছে সে নির্মম সত্য থেকেও তারা অজ্ঞ হয়ে আছে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি শোষকদের কাছেও তারা নিজেদের অবলা করে রেখেছে। হাভাতে বাঙালি নিজের ভাতের অধিকার ছেড়ে দিয়ে মজলুম থাকবে আর কতকাল? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.