আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওষুধের কথা

পার হয়ে যাই তালুকদারের বাড়ি প্রায় সাত-আট মাস আগের কথা, তখন আমি একটা থানা হেলথ কমপ্লেক্সে কাজ করি । একদিন সকালবেলা আউটডোরে বসে রোগী দেখছি, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সিস্টার-ইন-চার্জ, অঞ্জু দিদি । হাতে একটা ওষুধের ভায়াল । —দাদা, দেখেন তো, এইটা কি ইনজেকশন অ্যামক্সিসিলিন? একই ওষুধ বাজারে বিভিন্ন নামে পাওয়া যায় । তো সিস্টাররা মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়েন, কোন্‌টা কোন্ ওষুধ বুঝতে পারেন না; যদিও আসলে বোঝা উচিত, কারণ ওষুধের ভায়াল বা পাতার গায়ে ওষুধের মূল উপাদানটির নাম লেখা থাকে ।

ভায়ালটা হাতে নিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম । ওটার গায়ে মূল উপাদান লেখা ছিলো ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম(Vecuronium) । স্টোর-কিপারবাবু ইনজেকশন অ্যামক্সিসিলিন ভেবে ওটা সিস্টারের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে । * * * ষোল শতকের কথা । কিছু স্প্যানিশ অভিযাত্রী গিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীতীরে ।

ঘুরতে ঘুরতে অভিযাত্রীদের একজন হঠাৎ মাটিতে ঢলে পড়লো, তার হাতে একটা তীর এসে বিঁধেছে । বিষমাখা তীর । অ্যামাজন নদীর অববাহিকার রেইন ফরেস্টে কিছু কিছু গাছ-পালা জন্মায় যেগুলো থেকে এমন প্রাণঘাতী বিষ তৈরি হয় । কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম(Chondrodendron tomentosum), স্ট্রিকনোস গিয়ানেনসিস(Strychnos guianensis), স্ট্রিকনোস টক্সিফেরা(Strychnos toxifera) এরকমই কিছু গাছের নাম । এর মধ্যে কনড্রোডেনড্রন শক্ত লতা জাতীয় গাছ, অন্য গাছের গা বেয়ে বেড়ে ওঠে ।

অ্যামাজন অববাহিকার স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা এসব গাছের শেকড়, বাকল বা কাণ্ডের রস থেকে এক ধরনের বিষ তৈরি করতো যার নাম দেওয়া হয়েছিলো কুরারে(Curare) । এই বিষ তীরের মাথায় মেখে ইন্ডিয়ানরা শিকার করতো । গায়ে তীর বিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শিকার নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলত । একটা বানর তীরবিদ্ধ হওয়ার পর কয়টা গাছে লাফ দিয়ে যেতে পারবে এর উপর ভিত্তি করে বিষের ক্ষমতা মাপার একটা প্রথাও তাদের ছিলো । বিষটা যদি একটু দুর্বল হয় তাহলে হতে পারে তিন গাছ ।

এভাবে হত্যা করা শিকারের মাংস খেতে সমস্যা হতো না কারণ এই বিষ মানুষের খাদ্যনালী থেকে রক্তের মধ্যে যেতে পারে না । ১৫৯৬ সালে স্যার ওয়াল্টার রালি(Sir Walter Raleigh) তাঁর লেখায় এরকম একটা বিষের উল্লেখ করেন । কিন্তু কুরারে আসলেই কী কী দিয়ে কীভাবে তৈরি হয় অনেকদিন পর্যন্ত পশ্চিমা জগতের কাছে ছিলো অজানা । ইন্ডিয়ানরা এই বিষ প্রস্তুত করতো গোপনীয়তার সঙ্গে । অনেকদিন পরে ১৮০০ সালে আলেক্সান্দার ভন হামবোল্ট(Alexander von Humboldt) এই বিষের প্রস্তুত-প্রণালী স্বচক্ষে দেখে ইউরোপে এর বিবরণ প্রদান করেন ।

১৯৩৫ সালে কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম গাছের মূল বিষাক্ত উপাদান টিউবোকুরারিন(Tubocurarine) পৃথক করা হয় । ১৯৪০ সালের দিকে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার কাজে টিউবোকুরারিন-এর ব্যবহার শুরু হয় । ওষুধ তৈরির ইতিহাসে এটা ছিলো একটা মাইলস্টোন । * * * জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ায় প্রথমেই রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় । সাধারণত যে ইনজেকশনটা দিয়ে অজ্ঞান করা হয় ওটা দিয়ে অজ্ঞান হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ।

রোগীকে নাম জিজ্ঞাসা করলে ওই নাম বলতে বলতেই রোগী অজ্ঞান—অর্জন করার মতো একটা অভিজ্ঞতা । অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর শরীরের সব মাংসপেশী প্যারালাইজড করার জন্য আরো দুইটা ইনজেকশন দেওয়া হয় যাদের একটা হলো ভিকুরোনিয়াম । শরীরের সব মাংসপেশী প্যারালাইজড মানে হলো হাত পা বুকের মাংস মুখের মাংস সব । জিভ নড়তে পারবে না, এমন কী চোখের পাতাও নড়তে পারবে না কারণ ওগুলো নড়তে হলেও মাংসপেশীকে কাজ করতে হবে । শ্বাস নিতে পারবে না কারণ শ্বাস নিতে গেলেও বুকের মাংস এবং বুকের নিচের দিকে মাংস দিয়ে তৈরি ডায়াফ্রাম নামে একটা পর্দা নড়তে হবে ।

ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম দেওয়ার পর মাংসপেশীগুলোর প্যারালাইসিস হতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই মিনিট । রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস কৃত্রিমভাবে চালানোর জন্য শ্বাসনালীর ভেতরে একটা নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়োজনীয় বাতাস ওই নল দিয়ে রোগীর ফুসফুসে ঢোকে এবং ফুসফুসের ভেতরের বাতাস বেরিয়ে আসে । রোগী প্যারালাইজড হওয়ার দেড় দুই মিনিটের মধ্যেই নল ঢুকানোর কাজটি সেরে ফেলতে হয় । রোগীকে প্যারালাইজড করা হয় অপারেশনের সুবিধার জন্য, যাতে কোনো নড়াচড়া না হয় বা মাংসপেশীগুলো যেন শক্ত হয়ে না থাকে(অজ্ঞান মানুষেরও হাত পা কিন্তু নড়তে পারে!) । কোনো সজ্ঞান মানুষকে যদি ইনজেকশন ভিকুরোনিয়াম দেওয়া হয়? দেড় থেকে দুই মিনিটের মধ্যে তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে; নড়াচড়া করার ক্ষমতা, কথা বলার ক্ষমতা এমন কী চোখের পাতা নড়ানোর ক্ষমতাও থাকবে না; অথচ সে ভেতরে থাকবে সম্পূর্ণ সজ্ঞান! এই ওষুধের কার্যকাল বিশ মিনিটের মতো ।

এই ভিকুরোনিয়াম নামের ওষুধটা তৈরি হয়েছে টিউবোকুরারিন থেকে, যে টিউবোকুরারিন ছিলো কনড্রোডেনড্রন টোমেন্টোসাম নামক গাছটির মূল উপাদান । * * * আট-নয় বছর আগের কথা, স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র ভিকুরোনিয়াম দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো । করেছিলো অজ্ঞান না হয়েই । * * * আমি একটা মৃত্যুর ঘটনা জানি, যেখানে রোগীর মৃত্যু হয়েছিলো—আমাদের সন্দেহমূলক ধারণা এই-ই ছিলো—ভুলক্রমে ভিকুরোনিয়াম দিয়ে ফেলার কারণে । * * * কেন এসব ওষুধ থানা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছিলো, যেখানে এর ব্যবহার পর্যন্ত নেই? ওষুধটার দামও তো খুব একটা কম নয় ।

জিজ্ঞাসা করে জানলাম সদর হাসপাতালে এটা অতিরিক্ত জমে গেছে এজন্য থানা হেলথ কমপ্লেক্সে দেওয়া হয়েছে । —তো ফেরত দেন । —ওরা ফেরত নেবে না । কারণ ওদেরকে খরচ দেখাতে হবে... —তাহলে ভাঙেন । এই বিপদ রাখার দরকার নাই ।

এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর কী মানে । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।