আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনুপ চেটিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।

মূল লেখক: আতাউস সামাদ প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম প্রদেশের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম বা সংক্ষেপে উলফার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ১৯৯৭ সালে। তখন থেকে তিনি বাংলাদেশের জেলে আছেন। অবৈধভাবে এ দেশে প্রবেশ করা এবং অননুমোদিতভাবে একটা স্যাটেলাইট ফোন সঙ্গে রাখার দায়ে তার কারাদণ্ড হয়েছিল। তাও মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশের জেলেই আটক আছেন। ভারত সরকার বারবার তাকে হাতে পেতে চেয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাকে হস্তান্তর করেনি।

অনুপ চেটিয়ার পক্ষ থেকে তাকে ভারতে না পাঠানোর জন্য একটি রিট আবেদন এখনও অমীমাংসিত আছে বলে জানা গেছে (সূত্র : আমার দেশ)। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছেন অনুপ চেটিয়াকে তার সরকারের হাতে তুলে দিতে এবং তা আগামী মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রস্তাবিত ঢাকা সফরের আগেই করতে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, সরকার অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে দিয়ে দেবে এবং সে জন্য আইন যাচাই-বাছাই হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে উলফা নেতাকে হস্তান্তর না করতে। কারণ ভারত সরকার তাকে প্রাণদণ্ড দিতে পারে।

আমরাও মনে করি ভারত সরকারের কাছ থেকে অনুপ চেটিয়ার জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে তবেই যেন তাকে ভারতে পাঠানো হয়, না হলে নয়। বাংলাদেশকে এ প্রসঙ্গে অন্তত চারটি বিষয় বিবেচনায় নিতেই হবে। প্রথমত, আসামে উলফার স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং অনুপ চেটিয়াকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তার ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাকে যে কোন পলাতক অপরাধী অথবা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখা চলে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তৃতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য বহু জায়গার মতো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ বদলাচ্ছে। সেদিক থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবেশ কী, মূলত যে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ আছে সেখানে সেগুলো কী অবস্থায় আছে, বিদ্রোহীরা বাংলাদেশের ব্যাপারে কী দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে এবং ভারতের ওই সীমান্তে তার অন্য দুই প্রতিবেশী চীন ও মিয়ানমার ভূ-রাজনৈতিক কোন কৌশল নিচ্ছে- সেসব খবর জেনে এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন আমরা কারও শত্র"তা ডেকে না আনি। চতুর্থত, মানবাধিকার এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া বাংলাদেশের প্রতিশ্র"তি রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের একটু ব্যাখ্যা দেই। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সেনাশাসক চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইসলামাবাদে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন।

বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল। তাই আইয়ুব খান আওয়ামী লীগকেও ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। এ দলের সভাপতি তখন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন 'আগরতলা যড়যন্ত্র মামলার' আসামিদের বিচার চলছিল ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে। শেখ মুজিবুর রহমান এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রধান আসামি।

আওয়ামী লীগের নেতারা সিদ্ধান্ত জানালেন, তাদের দল গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবে আর দলের প্রতিনিধিদের নেতা হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তিনি যাবেন কেবলমাত্র মুক্ত মানুষ হিসেবে, বন্দি হিসেবে নয়। এ প্রস্তাবে আইয়ুব খান টালবাহানা করতে থাকেন কিন্তু এরই মাঝে গণবিস্ফোরণের ফলে পাকিস্তান সরকার শেখ সাহেবকে ও মামলার অন্য আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিনই শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসমুদ্রে ছাত্রনেতাদের দ্বারা 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন। আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মুক্ত মানব হিসেবে।

সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ও ঘটনাপ্রবাহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পর বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে ভারত সরকারকে বলা যে, অনুপ চেটিয়াকে তারা একজন মুক্ত মানুষ ও নেতার মর্যাদা দিতে রাজি থাকলে বাংলাদেশ তাকে ভারতে যেতে অনুরোধ করবে। বাংলাদেশ সরকার একই সঙ্গে এ কথাও বলতে পারে, যেহেতু ভারত সরকার উলফা নেতাদের একাংশের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেছে, তাই অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে মুক্ত মানুষ হিসেবে কথা বলতে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। তাছাড়া অনুপ চেটিয়া নিজে কী চান, বাংলাদেশ সরকারের উচিত তার কাছ থেকে তাও জেনে নিয়ে তবেই ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলা। বাংলাদেশ সরকার জানে কিনা অথবা জানলেও বোঝে কিনা তা বলতে পারব না কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে তাদের ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন অনেক মানুষও এখন সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছেন, এ দেশে, মূলত সরকারে, ভারতের প্রভাব মাত্রাতিরিক্ত রকম বেড়ে গেছে। তারা মনে করেন, ভারত বাংলাদেশের কাছে যা চাইছে তাই পাচ্ছে।

ভারতকে স্থলপথে অবাধে ট্রানজিট তথা করিডোর সুবিধা দেয়ার পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রকৃত অর্থে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা এমন প্রশ্নও তাদের মনে দোলা দিচ্ছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার যে ভারতের প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা প্রমাণ করার একটা বড় উপলক্ষ হতে পারে অনুপ চেটিয়ার বিষয়ে কোন হুড়োহুড়ি না করে ধীরে সুস্থে এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো। জনগণ যেন এও দেখতে পায় যে, বাংলাদেশ সরকার অনুপ চেটিয়ার মানবাধিকার ও আইনি অধিকার নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে এও বুঝতে হবে, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভালো নয়। তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বলে যেসব পরিবর্তন এনেছেন সেগুলোর বেশ কটি খুবই বিতর্কিত।

সরকার এখন স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে জনতার কাঠগড়ায়। এর মধ্যে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে সংবিধান অবমাননার মামলায় এক সিদ্ধান্তে (মূল অভিযোগের ওপর শুনানি এখনও শুরু হয়নি) বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে ফেলায় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের এজলাসেই বিক্ষোভ প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে যেসব গ্রেফতার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চলছে তার উত্তাপ এখন সুপ্রিমকোর্টের বাইরেও চলে এসেছে। বিরোধী দল বিএনপি এখন দুই বিচারপতির বিরুদ্ধে খোলাখুলি অভিযোগ তুলেছে, তারা প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বক্তব্য তথা ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এখন আদালত যদি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেন তাহলে বিরোধটি আদালত ভবন ছড়িয়ে সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে। আর যারা মনে করছেন, বেগম খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমকে আদালতের মুখ দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করাতে পেরে তারা খুব জিতেছেন, তারা ভুল করছেন।

আমাদের দেশের ইতিহাস বলে, কার দেশপ্রেম আছে বা নেই জনগণের সে সিদ্ধান্ত জনগণ নেয়। কোন আদালত মানুষের মনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দিতে পারে না। 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার' পরিণতি আমাদের মতের একটি বড় প্রমাণ। অন্যদিকে রমজানের আগেই দেশে যে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে তাতে জনগণ খুবই অসন্তুষ্ট। তদুপরি বিদ্যুৎ, গ্যাস, সুপেয় পানি ও যানবাহন সংকট মানুষকে ক্ষুব্ধ করে রেখেছে।

আর তা এতটাই যে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে এ দাবি সত্ত্বেও একজন সরকারদলীয় সদস্য সংসদীয় কমিটিতে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। আইন-শৃংখলা ক্ষেত্রেও নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারকে ভেবেচিন্তেই কাজ করতে হবে। আগুনে যেন ঘৃতাহুতি না হয় তা দেখতে হবে সরকারকেই। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.