আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কামালের দিনলিপি ........................ ১৭/০৩/২০১৩

.. (রাজশাহীর ঐতিহ্য ঢপকল) তিন দিনের সরকারী ছুটির তৃতীয় দিন যাচ্ছে। অনেকটা সময় পরিবারের সাথে কাটালাম আর বাকীটা সময় নিজেকে দিলাম। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে যেয়ে ফেলে আসা দিন গুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রকৃত পক্ষে আমি যতটুকু চেয়েছি তার চেয়ে বেশী পেয়েছি বলে মনে হয়, তবে আমি বিশ্বাস করি মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নাই। এবারের ছুটিতে তেমন কোথাও বের হওয়া হয় নাই, তাই নিজেকে দিতে পেরেছি অনেকটা সময়।

প্রথম যে ভাবনাটা আসলো জীবনের কতটা পথ পড়ি দিলাম? যদি আমার জীবন কাল ৫৫/ ৬০ বছর হয় তবে বলা যায় বেশীর ভাগ পথ ইতি মধ্যে পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। ক্লাশ সিক্স এর প্রথম তিন মাস পর্যন্ত রংপুর জিলা স্কুলে লিখা পড়া করেছি। সেই সময় প্রিয় বন্ধুরা ছিল কনক, সোহেল, মিজান। এখন কনক ব্যাংকে, সোহেল দেশের একটি বড় আই.টি ফার্মে, মিজান রংপুরে তার নিজের ক্লিনিক পরিচালনা করছে। আব্বার চাকুরির কারনে বদলী হয়ে রাজশাহীতে গেলেন।

আমাদের ও রংপুরের পাট চুকিয়ে রাজশাহীতে চলে আসতে হলো। রাজশাহীতে আসার পর দীর্ঘ্য সময় পর্যন্ত রাতে ঘুমের মাঝে রংপুরের স্বপ্ন দেখতাম। আমার বন্ধু আর খেলার সাথীদের খুব মিস করতাম। কেমন যেন একটা অনুভুতি হতো বুকের মাঝে। বুঝলাম এটা আমার বাল্য বন্ধুদের প্রতি ভালবাসা।

রাজশাহীতে থাকতাম লক্ষীপুর নামক এলাকায়। শিক্ষা বোর্ড এর পিছন দিকে কাঁচা বাজার সংলগ্ন রোডে। লক্ষীপুর থেকে হেঁটে ’হেতম খাঁ’ এলাকার মুসলিম হাই স্কুলে যেতাম। রাজশাহীতে ছেলেদের জন্য দুটো অভিজাত স্কুল আছে, গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এবং কলেজিয়েট স্কুল। আমার আম্মার চাচা ছিলেন মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষক।

তার আগ্রহে আম্মা আমাকে আর ছোট ভাই কে মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি করালেন। আমরা বাসায় তাকে রহমত নানা বলে ডাকলেও স্কুলে রহমত স্যার ছাত্রদের জন্য আতঙ্ক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি লিখা পড়ার তুলনায় খেলাধুলায় ছিল ব্যাপক সুনাম। স্কুলে প্রথম দিন যেয়ে বুঝলাম এটা সেই অর্থে অভিজাত শ্রেনীর মাঝে কেন পরে নাই। স্কুলের বেশীভাগ ছাত্র ছিল নিম্ম বিত্ত ঘর যথা রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, পিয়ন, দোকানদার এমন পরিবারের সন্তান।

বিষয়টি আমার জন্য এটা কোন সমস্যা ছিল না তবে আব্বার অফিসের কলিগ বা অন্য পরিচিত জন স্কুলের নাম শুনলে ’ ও আচ্ছা’ টাইপের মন্তব্য করতেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমার সহপাঠিদের মাঝে বন্ধুত্ব তৈরী হলো। বিশেষ করে আমরা যারা এক সাথে হেঁটে স্কুলে আসতাম। মাসুম, ওর ভাই ওবায়দুল, সুফিয়ান, তরিকুল, ইয়াসিন, রতন, কামরুজ্জামান, উজ্জ্বল। আমরা কিছু দিনের মাঝে প্রানের বন্ধু হয়ে গেলাম।

আমি যে সময় রাজশাহীতে গিয়েছিলাম সেই সময় রাজশাহী শহরে অনেক পুকুর ছিল। শহরে সাপ্লাই পানির ব্যবস্থাও ছিল। ঢোপ কল নামের কল যুক্ত জলাধার এখনো মনে হয় শহরের কোন কোন যায়গায় আছে। তবে মানুষ ট্যাপের পানির চাইতে পুকুরে গোসল করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো, তার একটা কারন ছিল ট্যাপের পানিতে গোসল করলে চুলে এমন আঠা হতো যে চুল আচড়াতে সমস্যা হতো। যখন ক্লাশ সেভেন এ পড়ি, মাসটা হয়তো মে/ জুন হবে বছরের মাঝামাঝি সময়, আমাদের ক্লাসে পেলাম এক নতুন মেহমান! ফর্সা, সুন্দর, লম্বাটে চেহারার এক ছেলে বসে আছে প্রথম বেঞ্চে।

ছেলে মানুষের এমন রুপ! ক্লাশ রুমে মনে হয় ২০০ ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আমাদের সাথে সে বড় বেমানান। আমি দ্বিতীয় সারিতে বসে তার সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। প্রথম প্রিয়ড পার হওয়ার পর দ্বিতীয় ক্লাসের বিরতীতে ব্যাগ থেকে বের করলো সেবা প্রকাশনীর ’তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের সদ্য প্রকাশিত একটি বই। আমি সেই সময় ছিলাম এই সিরিজের দারুন ভক্ত।

এই বইটা আমার পড়া হয় নাই, আর বসে থাকতে পারলাম না, উঠে গিয়ে যেচে পরে তার সাথে পরিচিত হলাম। ওর নাম দিপু। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা বই এর দারুন ভক্ত। শুধু ভক্ত না তার কাছে আছে গল্পের বই এর বিশাল কালেকশন। ওর বাসা স্কুলের কাছেই লিচু বাগানে।

নতুন বইটা ক্লাশের ফাঁকে পড়ে শেষ করে আমাকে আজই পড়ার জন্য দিবে। শুধু তাই না, ক্লাশ শেষে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে, ওর বই এর সংগ্রহ দেখানর জন্য। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমরা দুই জন ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে গেলাম। আমাদের কথা কখনো শেষ হতো না। একদিন দেখা না হলে আমরা অস্থির হয়ে পরতাম।

বিভিন্ন এডভেঞ্চারের জন্য দিনের সময় আমাদের জন্য কম হয়ে গেল। কিছু দিনের মধ্যে আমরা স্কুল ফাঁকি দেওয়া শিখে গেলাম। রাজশাহী শহরের একবারে কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। নদীর বাধ সংলগ্ন জায়গা জুড়ে আছে বাবলা বন। তখন এতোটাই ঘন আর নিরিবিলি ছিল যে মনে হতো সত্যি শহর ছেড়ে দুরে কোথাও চলে এসেছি।

রাজশাহী এমনিতেই অনেক শান্তি পূর্ণ শহর, আর এই ঘন বনে বন্ধুরা সহ যখন আসতাম মনে হতো এটা আমাদের নিজেদের কোন রাজ্য। আমরা প্রথম সিগারেট খাওয়া ধরেছি এই নদীর ধারে। রাতুলের চাচা বিদেশ থেকে ’মোর’ সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে এসছে, সেখান থেকে কয়েক প্যকেট নিজে করে নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য। সেই সময় ওয়াক ম্যান নামের খুব ছোট ক্যাসেট প্লেয়ারের চল ছিল। দুটি পেন্সিল ব্যাটারীতে বাজতো আর হেড ফোনে শুনতে হতো।

ওয়াক ম্যান ছিল সেই সময় কিশোরদের বিনোদনের আধুনিক যন্ত্র। অযান্ত্রিক বিনোদনের মাঝে ছিল সুফিয়ানের সংগ্রহের এক ধরনের পাতলা বই। সেই সময়ে আমাদের বন্ধুদের মাঝে ছিল নিঃস্বার্থ ভালবাসা। কপট অভিমান, অকানের হাসি, দুরন্তপনা, সব কিছুতেই মজা আর এডভেঞ্চার খোঁজা। সংসার কিনবা জীবিকার কারনে অনেক সহপাঠিকে এস.এস.সি পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে ঝরে যেতে দেখেছি।

সাহেব বাজারে অনেককে কর্মচারীর কাজ করতে দেখেছি। আজকের এই বড় অবসরে তাদের কথা খুব মনে পরছে। আজ যতদুর এসেছি স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া ভালবাসার ও এতে অবদান আছে। আমি ১৯৯২ সালে মুসলিম হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি। সে সময় আমরাই প্রথম ৫০% নৈব্যক্তিক পরীক্ষা দেই।

চারিদিকে স্টার মার্কস এর ছড়াছড়ি। আমাদের স্কুল থেকে ৩ জন ছাত্র স্টার মাকর্স পেয়েছিল। আমার মাকর্স ছিল সর্বচ্চ। স্যারদের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশী মার্কস পেয়েছিলাম বলে দুই জন শিক্ষক বাসায় এসে আমাকে দোয়া করে গেছেন। আজ লিখলাম স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে কিছু টুকরো স্মৃতি, অন্যদিন লিখবো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এর বন্ধুদের নিয়ে।

আজ বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেক কথা মনে পড়ছে, তবে সাজিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে না। স্মৃতি গুলো ব্রেনের কোথায় এতোদিন ছিল বুঝতে পারছি না, আজ মনে হচ্ছে সব এক সাথে ধরা দিতে চাচ্ছে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.