আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিছক গল্প নয়

আমার বাসা রাজশাহী শহরের ভেতরে। ঘটনাটি ছিল আজ থেকে ৬ বছর আগের। তখন আমি HSC পাশ করছি মাত্র। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। পদ্মাতে প্রচুর পানি।

আমরা কয়জন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম যে একটা নৌকা ভ্রমন করবো। আমরা চারজন ছিলাম একসাথে। সবাই রাজি হল। ঠিক করলাম তারপর দিন আমরা T বাধ থেকে যাত্রা শুরু করবো সকাল ৯টায়। কোথায় যাব ঠিক নাই।

সারাদিন নৌকায় কাটাবো ঠিক করলাম। পরদিনটা ছিল রবিবার। সকাল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল। সকাল দশটায় আমি T বাধ এ পৌছালাম। কিন্তু কেউ আসেনি।

আমাদের বন্ধুদের কারও কাছে পারসোনাল মোবাইল ছিলনা শুধুমাত্র রিংকু ছাড়া। তাই আমি দোকান থেকে রিংকুকে ফোন করে T বাধএ আসতে বললাম। রিংকু আসলো প্রায় ১ ঘন্টা পর। তখন প্রায় বেলা এগারোটা। আর কেউ আসলোনা।

আমি আর রিংকু ঠিক করলাম আমরা দুজনেই ঘুরতে বের হব নৌকা নিয়ে। ঠিক তখন বৃষ্টিটা আবার জোরে শোরে এল। এ বৃষ্টি আর যেন থামতেই চায়না। তারপর যখন বৃষ্টি থামলো তখন প্রায় দুপুর ৩টা। আমরা একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করলাম।

তারপরে একটি নৌকা ভাড়া করলাম। কিন্তু আমরা আমাদের প্লানটা একটু চেন্জ করলাম। আমরা ঠিক করলাম নদীর ওপারে ভারতের বর্ডারের কাছে একটি গ্রাম আছে সেখানে যাব। তারপর আমরা রওয়ানা হলাম। গ্রামে পৌছানোর প্রায় পাচ কিলোমিটার আগে চর এর ভেতর নৌকাঘাটে নৌকা আমাদের নামিয়ে দিল।

বাকিটা পথ হেটে যেতে হবে। মাঝিকে জিঞ্গাসা করলাম যে কতরাত পযন্ত এখানে নৌকা পাওয়া যাবে?সে বলল যে আনুমানিক রাত নয়টা পযন্ত নৌকা পাওয়া যাবে। তখন আমরা সেই গ্রামের দিকে হাটা ধরলাম। গ্রামে পৌছে আমরা দুজনে এদিকে ওদিকে ঘোরাফেরা শুরু করলাম। গ্রামে কোন বিদ্যুতের লাইন নেই।

জনবসতি ও কম। যখন সন্ধা নামলো তখন চারিদিকে শেয়াল ডাকা শুরু করলো। আমরা শেয়াল ডাকার শব্দে আরও মজা পাচ্ছিলাম। রাত বাড়তে থাকলো। বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া দরকার।

দুজনে নৌকাঘাটে এসে পৌছালাম। তখন রাত ৯টা প্রায়। আমরা ঘাটে এসে একটু অবাক হলাম। একটা নৌকা ও আমরা নৌকাঘাটে দেখতে পেলাম না। পড়লাম চরম এক বিপদে।

তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। এর মধ্যে আমাদের একমাত্র ছাতাটার স্টিকগুলো বাতাসের চাপে অলরেডী ভেঙ্গে গেছে। আমরা পুরোপুরি ভিজে গেছি। এখন কি করা যায়? সেই চিন্তায় করছিলাম। এমন সময় রিংকু ওর এক বড় ভাইএর কাছে ফোন দিল।

সে বড় ভইএর বাসা T বাধের পাশেই। এমনিতেয় আবহাওয়া খারাপ,তার ভেতর চর এলাকায় নেটওয়ার্কের সমস্যা তো আছেই। কিন্তু আশ্চযজনক ভাবে প্রথম বারেই রিং হয় এবং ওপাশ ফোন রিসিভ হয়। রিংকু ওর সে বড় ভাইকে অনুরোধ করে যে একটা নৌকা ম্যানেজ করে তারাতারি T বাধ সোজা চড়ে পাঠিয়ে দিতে, নাহলে আমাদের খুব বিপদ হবে। ভাড়া ডবল চায়লে ডবল দিব।

বড় ভাইটা বলল আচ্ছা দেখছি। তারপর আমরা ওখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। চারিদিকে শেয়ালের ডাক আর টিপটিপ বৃষ্টি। আমরা ব্যাপারটা ইনজয় করছিলাম। একটু একটু ভয় ও করছিল।

এতবর একটা চর আমরা মাত্র দুইজন। শুনেছিলাম বর্ষার দিনে অনেক জেলেরা নৌকায় করে সারা রাত মাছ ধরে। দুর্ভাগ্যবসত সে রাতে একটা ও জেলে নৌকা চোখে পরলোনা। রাত যখন প্রায় ১০ তখন একটা ডিঙ্গি নৌকা দেখতে পেলাম। তখন আমরা প্রায় ভিজে চুপসে গেছি।

নৌকাটা ঘাটে এসে ভিড়লো। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলোনা। নৌকার মাথায় বৈঠা হাতে একজন মানুষ বসে ছিল। আমরা দুজনে গল্পে অনেক মুশগুল ছিলাম যে আমাদের মনে হয়েছিল যে নৌকাটা হয়তবা রিংকুর সেই বড় ভাই ই পাঠিয়েছে। তাই আমরা মাঝিকে কোন কথা না জিঙ্গাসা করে সরাসরি নৌকায় উঠে পড়লাম।

তখন মাথায় একটাই চিন্তা কাজ করছিল যে তারাতারি বাসায় যেতে হবে কারন অনেক রাত হয়ে গেছিল। এর মধ্যে রিংকু ওর বাসায় ফোন করেছিল। অনেক বার ফোন ট্রাই করার পর আন্টিকে ফোনে পেয়েছিল। আমি খালাদের বাসায় থাকতাম আর আমার বাবা মা থাকতো নাটোরে। বাসার গেটের একটা এক্সটা চাবি সবসময় আমার সাথে থাকতো আর আমি HSC পরীক্ষার পর থেকে প্রতিদিন ই একটু রাত করে বাসায় ঢুকতাম।

তাই আমি আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করছিলাম না। চিন্তা হচ্ছিল রিংকুর মা কে নিয়ে কারন আন্টি বাসায় একা থাকেন। আমরা নৌকার ওঠার পর মাঝি ও আমাদের সাথে কোন কথা বললনা, নৌকা ঘুড়িয়ে সোজা T বাধের মুখে রওয়ানা হয়। নদীতে তুমুল স্রোত। বাতাসের বেগ ও বাড়তে থাকলো।

আমি রিংকু দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে কথা বলছি। আমাদের প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছিল। নৌকায় ওঠার ৫মিনিট পর আমার চোখ গেল সেই চরের দিকে যেখানে আমরা এতক্ষন দাড়িয়ে ছিলাম। হটাত ওদিকে তাকাতেই আমার সারা শরীর অবশ হওয়ার দশা। দেখি অনেক গুলো জোড়া জোড়া চোখ আমার দিকে নিশ্চল ভাবে তাকিয়ে আছে।

চোখগুলো যেন জ্বলছে। রিংকুও দেখি ওদিকে তাকিয়ে আছে। পরে বুজলাম যে এগুলো তারা, যাদের চিতকারে আমরা এতক্ষন মজা পাচ্ছিলাম। ভাবলাম এত শেয়াল এতক্ষন আমাদের পাশে ই ছিল তারপর ও আমাদের কোন ক্ষতি করলোনা কেন?আমি রিংকু দুজনেই ব্যপারটায় একটু অবাক হলাম। হটাত আমরা খেয়াল করলাম যে আমাদের নৌকাটা নদীর প্রায় মাঝখানে আর মাঝির দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই।

নৌকাটা অস্বাভাবিক ভাবে দুলতে শুরু করলো। এ দৃশ্য দেখে আমার শরীর প্রায় অবস হওয়ার পথে। ঠিক তখনই চারিদিকে মনে হল হাজার হাজার শেয়াল ডাকা শুরু করল। যেই শেয়ালের ডাক শুনে একটু আগে আমরা মজা পাচ্ছিলাম সেই শেয়ালের ডাক শুনে আমরা সেই মুহূর্ত্বে সবচেয়ে বেশি ভয় পেলাম। ঘটনাগুলো ঘটলো মাত্র কয়এক মিনিটের মধ্যে।

অবশেষে একসময় মুর্ছা গেলাম। যখন গ্ঙান ফিরলো তখন আমি আমার বাসায়। পরে শুনলাম যে আমাদের কাদাতে লেপ্টানো অবস্থায় পরে থাকতে দেখেন রাজশাহী পঞ্চবটী এলাকায় এক রাজশাহী প্যারামেডিকেলের একজন প্রিন্সিপাল। উনি সকালের প্রাতভ্রমনে এসেছিলেন। আমাদের কে প্রিন্সিপাল সাহেব ওখানে দেখতে পান ।

তারপর আমার মানিব্যাগ থেকে আমার বাসার ঠিকানা নিয়ে কিছু লোকের সাহায্য নিয়ে আমাদেরকে আমার বাসায় পোছৈ দেন। পরে জেনেছিলাম যে রিংকুর সেই বড়ভাই একটা নৌকা পাঠিয়ে ছিল সেই রাতে তবে আমাদের কে ওপাশে না পেয়ে মাঝি নৌকা নিয়ে ফিরে এসেছিল। এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমার আমরা আজও বের করতে পারিনি। সেদিন কি হয়েছিল। আমরা দুজনেই সাতার জানতাম না ।

তাহলে আমরা কিভাবে নদী পাড় হলাম?কোনকিছুর ই আমরা দুজনে কোন সমাধানে আসতে পারিনি। তবে আমরা আজ ও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।