আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবে মাদক ধ্বংস করছে প্যালেস্টাইন

‘আমি কখনো চিন্তা করতে পারিনি ফিরে আসতে পারবো’ আবু সালেহ বলছিলেন তার বন্ধুদের, ‘একাধারে ১৪ বছর হেরোইন, কোকেন, হাশিশ গ্রহণ ও কেনাবেচার পর আমি আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার না ছিলো কোনো চাকরি, না ছিলো বেঁচে থাকার মতো কোনো অভয়াশ্রয়; আর এসব কথা আমি আমার পরিবারকেও জানাতে পারতাম না। ’ আবু সালেহ তার জীবনের গল্প বলছিলো জেরুসালেমের একটি মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসে। কীভাবে ড্রাগ জেঁকে আসছে প্যালেস্টাইনের তরুণদের উপর মরণঘাতি হয়ে, তার এক টুকরো উদাহরণ আবু সালেহ। জেরুসালেমের এমন হাজারো আবু সালেহ আজ ধুঁকছে মাদকের ধোঁয়াশাগ্রস্ত মরণনেশায়।

জেরুসালেম ও এর আশপাশের এলাকাগুলো ক্রমেই মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অনিয়ন্ত্রিত সীমান্ত, দারিদ্র্য এবং নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা তরুণদের মারাত্মকভাবে উদ্বুদ্ধ করছে এসব মাদক গ্রহণে। নিরাপত্তাহীনতা এবং দারিদ্র্যের প্রমাণ পাওয়া যায় জেরুসালেমের আবাসিক এলাকাগুলোর দিকে তাকালেই। এলাকার যুবকদের ৭৫ ভাগই বেকার। জেরুসালেম শহরের অর্ধেক অধিবাসী; যাদের সংখ্যা প্রায় ৬২,০০০, তাদের এ শহরে ঢুকতে হলে নিজস্ব ছাড়পত্র দেখাতে হয়।

পার্শ্ববর্তী আল রাম, আবু দিস, আল আজারিয়া এলাকাগুলোতে মিশ্র প্রশাসনিক আধিপত্য চলে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি অনুযায়ী এসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলি পুলিশ। এসব এলাকার অনেক জায়গায় প্যালেস্টাইনি পুলিশদের প্রবেশ নিষেধ। এ কারণে এখানকার অধিবাসীরা সবসময় বাস করে একটা আতঙ্কের মধ্যে। পূর্বাপর ইতিহাস অনুযায়ী প্যালেস্টাইন কখনোই মাদকব্যবসার উর্বরভূমি হিসেবে বিবেচিত ছিলো না।

পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন ও মিশরের সীমান্ত অবহেলার কারণে হঠাৎ করেই জেরুসালেমকে কব্জা করে নিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ মাদকচক্র। প্যালেস্টাইনের আল কুদস বিশ্ববিদ্যলয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল পূর্ব জেরুসালেমেই ৬,০০০-এর বেশি তরুণ সরাসরি ড্রাগ এ্যাডিক্ট। অথচ দশ বছর আগেও এই সংখ্যা ছিলো ৩০০ জনেরও কম। ‘এখানে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই, নেই কোনো নিরাপত্তা কিংবা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী’Ñ বলছিলেন ‘আল মাকাদিস’ নামের একটি এনজিও কর্মকর্তা ড. আজমান আফগানি, ‘ফলে কারো বাড়িতে চুরি হওয়া কিংবা গাড়ি চুরি যাওয়া এখানে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর মাদক তো এখানে সুপার মার্কেটের মতো বিকিকিনি হয়।

’ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র ঘাসান খতিব বিষয়টির ভয়াবহতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘এলাকাটি আসলেই মাদক সমস্যায় জর্জরিত। কেননা আমরা এখানে উপয্ক্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। আর দখলদার ইসরায়েলিরা তো বিষয়টির উপর ঘৃতাহুতিই দিচ্ছে বরং। ’ ড. আফগানি ভয় পাচ্ছেন যে, খুব তাড়াতাড়িই আল রাম উপশহরটি মাদক বেচাকেনার একটি স্বর্গরাজ্যে না পরিণত হয়ে যায়। কেননা তিনি প্রতিরাতে তার বাড়ির পাশের সীমান্ত-দেয়ালের পাশে একদল ড্রাগ স্মাগলারকে দেখতে পান।

তার ভাষায়, ‘প্রতিরাতে তারা দেয়ালের ফাঁক গলে এপাশে হেরোইন পাচার করে’। প্যালেস্টাইনে অনিয়ন্ত্রিত মাদক আগ্রাসনের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম ‘ইসরায়েল’। কারণ, এ অঞ্চলে সবচে বড় মাদকবাজার ইসরায়েল। ইসরায়েলের এ্যান্টি ড্রাগ অথরিটির ভাষ্যমতে তাদের দেশে ড্রাগ এ্যাডিক্টের সংখ্যা ৩,০০,০০০ (তিন লাখ)-এর উপর। এর মধ্যে ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী।

প্রতিবছর আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলারের মাদক বেচাকেনা হয় ইসরায়েলে। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের শক্ত মাফিয়া নেটওয়ার্ক। তারা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করার জন্য টার্গেট করছে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোকে, বিশেষত জেরুসালেম। একটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অভাবে এলাকার অধিবাসীরা আল মাকাদিস এনজিওটিকেই তাদের সমস্যা উত্তরণের জিয়নকাঠি হিসেবে দেখছে। আল মাকাদিস, যদিও তাদের দক্ষ জনবল এবং পর্যাপ্ত পুনর্বাসনের অভাব রয়েছে তারপরও তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে এই সমস্যা থেকে তরুণদেরকে ফিরিয়ে আনতে।

তারা স্কুলগুলোতে ঘুরে ঘুরে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন করছে ড্রাগের বিরুদ্ধে, মানুষের মাঝে ড্রাগের ক্ষতিকর বিষয়গুলো তুলে ধরছে এবং আসক্তদের নিয়ে তারা নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলছে তাদের মনস্তাত্বিক পুনর্বাসন। পূর্ব জেরুসালেমে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রেরও রয়েছে চরম অপ্রতুলতা। প্রাক্তন এক মাদকসেবী নিহাদ রাজাবি বলছিলেন, ‘জেরুসালেমের এই এলাকায় মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। ২০০৭ সাল থেকে চালু হওয়া কেন্দ্রটি কখনোই খালি থাকে না। মাদকাসক্তরা কখনো পরিবারের হাত ধরে, কখনোবা নিজেরাই এখানে এসে ভর্তি হয় নিজেদের নিরাময়ের জন্য।

বড়জোর ২৩ জন এখানে একসাথে পুনর্বাসিত হতে পারে। এক থেকে তিন মাস তারা এখানে থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। ’ রাজাবির নিজেরও ইচ্ছে আছে তিনি নিজেই একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলে সেখানে এ্যাডিক্টদের চিকিৎসা দেবেন। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, দক্ষ জনবলের অভাব এবং পর্যাপ্ত সাপোর্ট না থাকায় তার স্বপ্ন অনেকটাই মিইয়ে যায়। মাজেদ আলৌস ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন মাদকবিরোধী কার্যক্রমে।

এর কারণ অবশ্য খুবই বেদনাদায়ক। তার দুই ভাই মারা গিয়েছে এই মরণনেশা ড্রাগের ছোবলে। দুই ভাইয়ের কষ্টার্জিত স্মৃতি থেকেই তিনি গঠন করেন ‘সাদেক আল তালেব’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তার সংগঠনের শ্লোগান ‘টু সেইভ লাইভস’। তিনি ও তার সংগঠন মাদকবিরোধী কার্যক্রমের সাথে সাথে স্কুলগুলোতেও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন।

তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা আমাদের সমস্যাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝাতেই পারছি না। এমনকি তারা অনেক স্কুলে আমাদের যেতেও দেয় না। তারা মনে করে, কাগুজে কাজকর্ম দ্বারাই তারা মাদক সমস্যার সমাধান করে ফেলবে। ’ যদিও ২০১০ সালে ডঐঙ-এর নজরদারির পর তাদের কাজ অনেক গতি পেয়েছে। কিন্তু সেটাও নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

‘তারা কাজ করার জন্য আমাদের কিছুই দেয় না’ বলছিলেন আলৌস। সেই সাথে তিনি বিদেশি দাতা এবং এনজিওদের ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেন। ‘৪,০০০ এনজিও কাজ করছে প্যালেস্টাইনে। অথচ উন্নয়নের জন্য তারা কিছুই করছে না। তাদের কার্যক্রম খুবই হাস্যকর ধরনের।

তারা মানুষকে ফার্নিচার কেনার জন্য টাকা দেয় কিন্তু সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। তারা কেবল তাদের নথিবদ্ধ কাজ করে যায়, সমস্যাগ্রস্ত প্যালেস্টাইনকে তারা কখনোই বুঝতে চায় না, বুঝতে পারেও না। ’ আল আজারিয়া স্কুলের শিক্ষিকা হান্না ইবাদিয়া বলছিলেন তার মনের ক্ষোভের কথা, ‘বহির্বিশ্ব মনে করে, আমরা শুধুমাত্র প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্যই জীবনভর সংগ্রাম করে যাচ্ছি, আমরা একটি আন্দোলন আর দাঙ্গাপ্রিয় জাতি। কিন্তু তারা কখনো জানার আগ্রহ বোধ করে না এই মুক্তি সংগ্রাম, এই রক্তস্নাত স্বাধীনতা-বাসনার অন্তরালেও আমাদের অনেক সামাজিক সংকট নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদেরও একটা সমাজ আছে, স্বাধীনতা ছাড়াও সেখানে আরো নানাবিধ মানবিক সমস্যা আছে।

সেগুলোও আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে। উন্নত শিক্ষা নেই, সমাজে বাড়ছে বেকারত্ব, স্বাভাবিক নাগরিক অধিকারগুলোও আমাদের জুটছে না। তার উপর মাদক সমস্যা তো দিন দিন ধ্বংসাত্মক এক দৈত্যের রূপ ধারণ করছে। অথচ উন্নত বিশ্ব আমাদের জন্য ত্রাণ পাঠায় বিস্কিট কিংবা চা-কফি। ’ জেরুসালেমে মাদকের এই ভয়াবহ আগ্রাসনকে অনেক আরব গবেষকই মনে করছেন একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ।

প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামে ভৌগলিক কিংবা প্রতিরক্ষার দিক থেকে জেরুসালেমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্যালেস্টাইনের আর দশটা এলাকার মতো এখানকার তরুণদেরও দিন শুরু হয় ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের দিকে পাথর ছুড়ে। পবিত্র মসজিদ বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী হওয়ার সুবাদে তাদের আবেগটা বরং অন্যদের তুলনায় খানিকটা বেশিই গাঢ়। স্বাধীনতা-সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ এলাকার রয়েছে অদম্য রক্তাভ অতীত। তাই ধূর্ত জায়নবাদী ও মাফিয়াচক্র এই দুর্দম তরুণদের হাতগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে তাদের হাতে নুড়ি পাথরের বদলে হেরোইনের গুড়ো তুলে দিতে খুব বেশি মানবিকতার ধার ধারে না।

যখন তাদের কাজই হচ্ছে প্যালেস্টাইনের প্রতিটি মুষ্ঠিবদ্ধ হাতকে গুড়িয়ে দেয়া। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর View this link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.