আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেহেদির অজানা ভূবনেঃ

মেহেদির অজানা ভূবনেঃ প্রায় ১৫ হাজার বছর ধরে পৃথিবীবাসি তার রূপ সৌন্দর্য্যে ব্যবহার করে এসেছে প্রকৃতি প্রদত্ত নানান রঞ্জক। সকল রঞ্জকের ভিতরে মেহেদীর শ্রেষ্ঠত্ব আজ বিশ্বব্যাপি প্রতিষ্ঠিত ৫ হাজার বছর ধরে। মেহেদী শুধু নারীর অঙ্গ সৌন্দার্য্যায়নের চিরায়ত আকাঙ্খাকেই ধারণ করেনা বিশ্বব্যাপি নানা ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠিতে মেহেদীর রয়েছে বিচিত্র ব্যবহার। মেহেদির ক্রমবর্ধমান ও ক্রমপরিবর্তিত আঙ্গিকসহ পৃথিবীর সকল দেশের ট্রেডিশনাল ও মডার্ন ডিজাইন সম্পর্কে একটি সমন্বিত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো। ০১. মেহেদীর ইতিহাস : সারা পৃথিবী জুড়ে খুঁজে পাওয়া নানান ফসিল ও প্রত্নতাত্বিক গবেষণার মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানিরা নিশ্চিত হয়েছেন প্রায় ১৫০০০ বছর ধরে নর-নারীরা প্রকৃতির নানান উপাদান দিয়ে অঙ্গসজ্জ্বা করতেন।

সুই ফুটিয়ে শরীরে স্থায়ীভাবে অলংকরণ করা যাকে আমরা ট্যাটু বলি সেটি করা হতো মূলত দুটি কারণে একটি হচ্ছে অঙ্গসজ্জ্বা আরেকটি হচ্ছে তার আইডেনটিফিকেশন। সভ্যতার ইতিহাস ধরা হয় ৫০০০ বছর। কিন্তু মেহেদির ইতহাস তারও পুরনো। নিওলিথিক বা নব্যপ্রস্তর যুগ (১০০০০-৪০০০ খ্রী.পূ.) থেকে মেহেদির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে। প্রায় ৯০০০ বছর আগে মরুবাসীরা প্রচন্ড গরম থেকে বাঁচার জন্য তাদের পা মেহেদি পেস্ট দিয়ে আচ্ছাদন করে রাখতো যা গোটা শরীরকে ঠান্ডা রাখতো।

বিশেষত যোদ্ধাদের ভিতরে এর প্রচলন ছিল বেশী। তারপর যখন দেখলো শুকিয়ে গেলে চমৎকার রং ধারণ করে সেই থেকেই শুরু হয় অঙ্গসজ্জ্বায় মেহেদীর ব্যবহার। এতদ্বাঞ্চলে যে ৪টি প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল- মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও এ্যসিরিয় সভ্যতা প্রতিটি সভ্যতায় রঞ্জক হিসেবে মেহেদি ব্যবহার পাওয়া যায়। চিত্রকলার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মার্কিন অধ্যাপক Dr. Marilyn Cvitanic-এর মতে For over five thousand years henna has been a symbol of good luck, health and sensuality in the Arab world. দক্ষিণ চীনে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে প্রাচীন দেবী সংস্কৃতির সময় থেকে মেহেদী ব্যাপকভাবে প্রেমমূলক র্ধমানুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রাচীন মিশরের খুশি, আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতিক রানী নেফারতিতি (খ্রী.পূর্ব ১৩৭০-১৩৩০) ও ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সুন্দরী ও আবেদনময়ী রানী ক্লিওপেট্রা (খ্রী.পূর্ব ৬৯-৩০) নিয়মিত মেহেদী ব্যবহার করতেন।

ক্লিওপেট্রা কন্যা সেলেনা (Selene also known as Cleopatra VIII of Egypt, খ্রী.পূর্ব ৪০-০৬) মেহেদীর নানা রকমের ব্যবহার জানতেন। মিসরের পিরামিডে ফারাও সম্রাটদের মমিতে মেহেদির ব্যবহার হতো। মধ্যযুগের কিছু চিত্রকলায় দেখা যায় কিং সলোমানের সাথে রানী সেবা যখন দেখা করতে যায় তখন রানী মেহেদী ব্যবহার করতেন। ভারতের অজন্তা গুহাচিত্রেও অঙ্গসজ্জ্বায় মেহেদির ব্যবহার দেখা গেছে। উপমহাদেশে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে মেহেদীর ব্যবহার শুরু হয় ও মোগল আমলে প্রাকৃতিক প্রসাধনি হিসেবে মেহেদীর ব্যপকতা ছড়িয়ে পরে।

মোগল সম্রাট শাহজাহান পত্নি মমতাজকে মিসরের রাজা রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে মেহেদি ও মেহেদি চারা উপহার দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ০২. মেহেদির পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত কিছু তথ্য: বাংলা শব্দ মেহেদী, কোথাও মেদি, মেন্দি, কোথাও মৌকা নামে আমাদের দেশে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে নিরি মুল্লকা, মদয়ন্তিকা, গিরিমল্লিকা, নখ রঞ্জিকা, বনমল্লিকা নামে মেহেদির বেশ কিছু কাব্যিক নাম পাওয়া যায়। মেহেদি- হিন্দি ও উর্দুতে মেহেন্দি, ইংরেজীতে হেনা (Henna), মধ্য-প্রাচ্যে হেন্না, মধ্য-এশিয়ায় ‘আল-খান্না’ নামে পরিচিত যা আরবী শব্দ আল-হিন্না (Al-Hinna) থেকে এসেছে। এর ইউনানী নাম হচ্ছে হেনা, আয়ুর্বেদিক নাম মদয়ন্তিকা, বোটানিক্যাল নাম হচ্ছে লসোনিয়া ইরামিস (Lawsonia Inermis) যা লেথরেসিয়া (Lythreaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

মেহেদিগাছ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ। ঘন শাখা ও পাতা বিশিষ্ট। এটি সাধারণত দুই থেকে ছয় মিটার বা প্রায় ২০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। পাতাগুলো সরল, প্রতিমুখ বা বিপরীতভাবে সাজানো থাকে, বৃন্তক দেখতে অনেকটা লেন্সের মতো এবং পাতার অগ্রভাগ সুঁচালো। পাতায় বিশেষ গন্ধ থাকে।

কান্ড ছোট এবং আংশিক কাঁটাযুক্ত। ফুল ছোট এবং গুচ্ছাকারে ফোঁটে। ফুলের রঙ হলুদাভ সাদা বা হালকা গোলাপি। বৃতি দেখতে লাটিমের মতো। ফুলের পাপড়িগুলো পুরু এবং ভাঁজবিশিষ্ট।

পুংকেশরগুলো জোড়ায় জোড়ায় সাজানো থাকে। ফল আকারে মটর দানার সমান এবং ধূসর বর্ণের। ফলের ভেতরে ছোট ছোট ৮৫-৯৫টি বীজ থাকে। শুকনো গুড়া মেহেদীতে ৯% ময়েশ্চার, ১৪.৮% এ্যাশ (ধংয) ও ১০.২% তানিন (ঞধহহরহ) থাকে । ০৩. মেহেদির বিশ্বব্যাপি ব্যবহার: মেহেদির সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহার দেখা যায় ন্যাচারাল কুলিং সিস্টেম হিসেবে আরব বিশ্বের মরু অঞ্চলে।

প্রচন্ড গরমে একটু আরামের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মরুবাসিরা পায়ে মেহেদি পেষ্ট লাগাতো। প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাজ্যে এটির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সুসজ্জ্বা ও সুরক্ষার জন্য পিরামিডের মমিদেহের হাত ও পা মেহেদি পানিতে চুবানো হতো। ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রাচীনতম কসমেটিক হিসেবে মেহেদীর ব্যবহার প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো। ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই দুনিয়াবাসীরা রঞ্জক হিসেবে মেহেদি ব্যবহার করে আসছে।

ভারতীয় আদালতে চুলের রঙ হিসেবে মেহেদির ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে যেটা প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের। ছত্রাক-রোধী হিসেবেও মেহেদি কার্যকর। কাপড় ও চামড়া সংরক্ষণেও এর ব্যবহার হয়। মেহেদি ফুল থেকে সুগন্ধী তৈরি হতো বহু প্রাচীনকাল থেকেই। পোকা দমনেও মেহেদি ব্যবহৃত হয়।

লসোন (Lawson) নামক এক প্রকার পদার্থের উপস্থিতির জন্যই মেহেদিতে রঙ হয়। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীস্টান, শিখসহ বিভিন্নধর্মে ঐতিহাসিকভাবে মেহেদী পবিত্রতা ও আধ্যাতিকতার সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীর নানা জাতি ও অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে সুস্বাস্থ্য, উর্বরতা, জ্ঞান, সুরক্ষা এবং আধ্যাতিক জ্ঞান হিসেবে প্রতিটি সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ডিজাইনের আলাদা অর্থ রয়েছে। কখনো এটি শরীরে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য ট্যাটু ও সাময়িক সজ্জ্বার জন্য মেহেদী দিয়ে ডিজাইনগুলো করা হয়। বাংলাদেশে ঈদ ও বিয়ে উপলক্ষে এর ব্যবহার অনেকটা আবশ্যিকরূপে প্রচলিত।

দুনিয়ার বহু দেশে এটি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রাক বিবাহ, বিবাহ, গর্ভাবস্থার আটমাস, সন্তান জন্মের ৪০ দিন, সন্তানের নামকরন প্রভৃতি পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আবহমানকাল থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মেহেদির বাহারি ব্যবহার হয়ে থাকে। আফ্রিকার অনেক জায়গায় আরোগ্য মুক্তি উপলক্ষ্যে এবং আরব্য সংস্কৃতির বিয়েতে মেহেদি সন্ধ্যা একটি জনপ্রিয় প্রথা যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহেও দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী ও বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক চিকিৎসায় মেহেদীর ব্যবহার হয়ে থাকে। ০৪. মেহেদীর চাষ ও বিশ্বব্যাপি মেহেদীর উৎপাদন: ৩৫-৪৫ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা মেহেদী চাষের জন্য উপযোগী।

আদ্র আবহাওয়ার তুলনায় অধিক শুষ্ক ও উষ্ণ তাপমাত্রার উম্মুক্ত স্থানে উন্নততর মেহেদী জন্মে। ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রার নীচে মেহেদি জন্মে না। মেহেদী পাতা পরিপক্ক হতে ৪-৫ বছর সময় লাগে। ২৫ বছর পর্যন্ত লাভজনক পাতা উৎপন্ন হয়। ৫০ বছর বয়সী গাছও পাতা দিতে সক্ষম।

সামান্য বৃষ্টিপাতেই এটি নতুন ডাল ও পাতা ছাড়ে। গ্রীষ্ণের শেষদিকে মূলত: মেহেদী পাতা তোলা হয় কেননা এই সময়ই মেহেদী পাতা বেশী প্রলম্বিত হয় ও বেশী লসোন (Lawson) ধারণ করে যা গাড় লাল দাগ তৈরীর উপযোগী। শীতের শুরুতে পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে ও পাতা ঝরা শুরু হয়। ক্রান্তিয় দেশসমূহতে রপ্তানিযোগ্য মেহেদীর চাষ করা হয়। মেহেদী চাষে বৃষ্টি ও সারের প্রয়োজন অনেক কম।

তবে সবদেশে একইভাবে মেহেদি উৎপাদিত হয় না। দেশভেদে চাষের ভিন্নতা রয়েছে। আফ্রিকার দেশসমূহে মাটি কর্ষণ, সার ও পানি ভারতের তুলনায় অনেক বেশী ব্যবহৃত হয়। ভারতে যে সমস্ত এলাকায় বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৪০০ মি.মি. সেখানে মেহেদী ভালো জন্মে। কীটনাশকের ব্যবহারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না।

২০হাজার থেকে ২ লাখ গাছ হেক্টর প্রতি লাগানো যায় যা নির্ভর করে পানির প্রাপ্যতার উপর। বীজ থেকে নার্সারি করে অথবা কলম করে মেহেদীর চাষ হয়। বীজতলার জন্য হেক্টর প্রতি ৩-৫ কেজি বীজ লাগে। হেক্টর প্রতি ১০০০ থেকে ৩ হাজার কেজি পাতা উৎপন্ন হয় যা শুকনো গুড়ো করলে ১৫০০ থেকে ৪৫০০ কেজি পর্যন্ত গুড়ো মেহেদী পাওয়া যায়। মেহদী পাতা বছরে ২ থেকে তিনবার তোলা হয়।

কাচা পাতা শুষ্ক ও অন্ধকার বা কম আলোতে শুধু প্রাকৃতিক বাতাসে শুকানো হয়। শুকনো ঝরঝরে হলে একটি সেমি অটোমেটিক মেশিনে বাছাই করা হয় যাতে পাতা ছাড়া অন্য সকল কিছু যেমন পাথর, কান্ড, বীজ, আবর্জনা ইত্যাদি রিমুভ হয়। তারপর কয়েকটি প্রসেসে গুড়ো করা হয়। গুড়ো মেহেদীকে আদ্রতামুক্ত করতে আরেকটি মেশিনে প্রসেস হয়ে ল্যাবটেষ্টের পরে প্যাকেট করা হয়। সাহারা মরুভূমির দেশসমূহ, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তান-ভারতের মরু অঞ্চলে বানিজ্যিকভাবে মেহেদী চাষ হয় ও এখান থেকেই সারা পৃথিবীর মেহেদীর যোগান দেয়া হয়।

মেহেদীর উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশসমূহ হচ্ছে ঃ মরক্কো, মিশর, সুদান, ওমান, ইরাক, পাকিস্তান, ভারত এছাড়া আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য বানিজ্যকভাবে মরুতানিয়া, লিবিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরব, ইরান, ইজরাইল, ইয়েমেন, স্পেন, তুরস্ক, তিউনেশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়ায় মেহেদীর চাষ করা হয়। বাংলাদেশের মত উপক্রান্তিয় দেশসমূহে, ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহ ও দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই যুগ যুগ ধরে মেহেদী জন্মে আসছে যা প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশের অনুর্বর, শুষ্ক ও পরিত্যক্ত মাটিতে যে জায়গা সব্জিচাষের অনুপযোগী সেই মাটিতে বানিজ্যিকভাবে মেহেদীর চাষ সম্ভব। সাভারের কিছু জায়গায় ইতোমধ্যেই বানিজ্যিকভাবে মেহেদী চাষ শুরু হয়েছে। সাভারের সালামাসি গ্রামের কৃষক মোঃ কসিমুদ্দিন নামের এক কৃষক দশ বছর ধরে মেহেদী চাষ করছে।

তার দেখাদেখি এখন বেশ কিছু জমিতে এখন মেহেদী চাষ করছে সাভারের অনেক কৃষক। ০৫. বিশ্বব্যাপি মেহেদীর বাজার ও বিপনন: একাবিংশ শতাব্দিতে বিশ্বব্যাপি মেহেদির চাহিদা ও যোগান সম্পর্কিত কার্যকর কোন গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায় না। গত শতাব্দির ৮০ এর দশকের পরে বিশ্বব্যাপি সার্বজনিন সৌন্দর্য্য চর্চায় মেহেদী একটি বিপ্লব এসেছে। ন্যাচারাল হেয়ার ডাই হিসেবে এর চাহিদা খুবই ক্রমবর্ধমান। যার কারনে গত কয়েক দশকে মেহেদীর চাহিদা কয়েকশত গুন বেড়েছে।

এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাহারি প্রকারের কৃত্রিম পেস্ট মেহেদী বাজারজাত করছে। বিজ্ঞানের কল্যানে এর ব্যবহারিক গুনমান কখনো কখনো প্রাকৃতিক মেহেদীকেও ছাড়িয়ে যায়। আজকের পৃথিবীতে আজো কোটি কোটি পরিবার বাড়ির বাগানের মেহেদি গাছ থেকে পাতা উত্তোলন করে সরাসরি ব্যবহার করে আর এর পাশাপাশি নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে গুড়ো মেহেদী ও পেষ্ট মেহেদী। যার কারনে মেহেদীর সামগ্রিক চাহিদা প্রক্কলন করা জটিল গবেষণার বিষয়। ১৯ শতকে শুধু ইস্তাম্বুলের নারীরা প্রতি বছর চুলে ১৫০০০ পাউন্ড মেহেদী ব্যবহার করতো।

১৯৫৫ সালে ভারতে ২৮০০ টন মেহেদী উৎপন্ন হয়েছিল। একাবিংশ শতাব্দির প্রাক্কালে পাকিস্তানে বছরে ১৫০০০ মে.টন মেহেদী উৎপন্ন হয় যার অর্ধ্বেক তারা রপ্তানি করে। ভারত, মিশর ও সুদান ১৯৭৫-১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর মোট গড় রপ্তানি ছিল ৬০০০-৮০০০ হাজার টন। ফাও এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৮-১৯৯৩ পর্যন্ত ৪৫০০-৭৬০০ টন মেহেদী বছরে রপ্তানি করতো। ১৯৯২ সালে বিশ্ববাজারে টনপ্রতি মেহেদীর মূল্য ছিল ২৫০-৭০০ ইউ এস ডলার।

মেহেদীর প্রকরণ ও মানের কারনে দামের এই তারতম্য হয়। ২০০৩-৪ এ শুধু রাজস্থানেই উৎপন্ন হয়েছে ৩৭৫৪০ টন। তন্মেধ্যে রপ্তানী করেছে ১০৫০০ টন যার মূল্য ৯১ কোটি ভারতীয় রুপি। আর আজকের ভারতে প্রচুর মেহেদি প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে যার কোন কোনটির উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার টনেরও বেশী। গুজরাটের পালি জেলার সুজাত নগরে এরুপ শতাধিক শিল্প কারখানা তৈরী হয়েছে যারা ভারতে বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মেহেদীর ৯০ ভাগের যোগান দেয়।

৮০ এর দশকে গড়ে প্রতি বছর সৌদি আরব ৩০০০ টন, ফ্রান্স ২৫০ টন, ব্রিটেন ১০০ টন, আমেরিকা ৪০০ টন মেহেদী আমদানী করেছে। পাশ্চত্য দেশগুলোতে বিগত দশ/বারো বছরে বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে। যদিও ওসব দেশে ইদানিং মেহেদী চাষ শুরু হয়েছে তবে তা একেবারেই সৌখিন পর্যায়ে। রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে ভারতই প্রধান। ভারত ছাড়াও মরক্কো, মিশর, সুদান, ওমান, ইরাক, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়া মেহেদী রপ্তানি করছে।

বিগত তিন দশকে মেহেদীর চাহিদা বেড়েছে কয়েকশত গুন। যদিও এর সিংহভাগ অংশই কৃত্রিম মেহেদীর দখলে। এর মূল কারণ প্রাকৃতিক মেহেদী দিয়ে ভালো রঙ আনতে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগে শুকনোর জন্য সেখানে কৃত্রিম পেস্ট মেহেদীতে রঙ হয় কয়েক মিনিটে। ০৬. বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেহেদির কিছু ব্যতিক্রমি কার্যকর ব্যবহার: বিশ্বব্যাপি নর-নারীরা নখ, চুল, হাত, পা সহ দেহের প্রায় সকল অংশেই মেহেদীর ব্যবহার করে। সৌন্দর্যায়ন ও ঔষধি ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কারের সাথে এটি সম্পর্কিত।

এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহুবিধ কাজে মেহেদীর বিচিত্র ব্যবহৃত রয়েছে। মেহেদীর পাতা ছাড়াও এর ফুল, বীজ, বাকল, কান্ড, ফলের খোসাও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন কাল থেকেই মেহেদী ফুল থেকে সুগন্ধি তৈরী হয়। উত্তর ভারত ও জাভায় বানিজ্যিকভাবে মেহেদী ফুল থেকে সবুজ রঙের খুবই দামী সুগন্ধি তৈরী করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে কালো রং পাওয়ার জন্য মেহেদীর সাথে Indigo (নীল) মিশ্রন করা হয়।

উল ও সিল্ক জাতীয় কাপড়ে অর্গানিক কালারের জন্য, ঘোড়ার কেশর ও লেজের চুল রঙিন করতে মেহেদীর ব্যবহার হয়। মরক্কোসহ উত্তর আফ্রিকায় এখনও চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে মেহেদি ব্যবহার করে। সানব্লক হিসেবে বিভিন্ন আদিবাসি মানুষ ছাড়াও গৃহপালিত পশুর নাকে মেহেদী পেস্ট ব্যবহার করা হয়। ০৭. মেহেদির প্রকরণ: প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মেহেদি মূলত অঙ্গসজ্জ্বা ও চুলের রং হিসেবে হাজার বছর ধরে মানুষ সরাসরি পেষ্ট করে ব্যবহার করে আসছে। মেহেদি সংরক্ষণের জন্য মেহেদী পাতা বাতাসে শুকিয়ে পউডার তৈরী করা হয়।

আজও এভাবেই বিশ্ববাসি বাজার থেকে সরাসরি মেহেদীগুড়ো সংগ্রহ করে প্রাকৃতিক মেহেদীর চাহিদা মিটায়। তবুও ফ্যাশনপ্রিয়তার প্রয়োজনীয়তার কারনে যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে মেহেদীর প্রকরণেও বৈচিত্র এসেছে। তবুও বাজারে যে প্রাকৃতিক মেহেদী পাওয়া যায় তা মূলত তিন প্রকার: ০১. ব্ল¬াক হেনা (Black Henna): আমাদের দেশে ইংরেজ আমলে নীল চাষ হতো আমরা জানি। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সূচনা কালিন সময় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমাদের দেশের নীল বা ইন্ডিগো অর্গানিক কালারের চাহিদা মিটিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কালো মেহেদী বলতে মেহেদীর সাথে ইন্ডিগোর মিশ্রণকেই বুঝায়।

চুল ও ত্বকের জন্য এই কালো মেহেদীই একসময় সবাই ব্যবহার করতো। কিন্তু প্রাকৃতিক নীল বা ইন্ডিগোর দুস্প্রাপ্যতার কারণে মেহেদীর সাথে পিপিডি বা প্যারা-ফেনিলেনডিয়ামাইন (para-phenylenediamine) নামক এক প্রকার রাসয়নিক পদার্থ সংমিশ্রন করে। সারা পৃথিবীতে কালো মেহেদী বলতে এটাকেই বুঝানো হয়। কালো মেহেদী মূলত চুলের জন্য হলেও অনেকে ত্বকের ডিজাইনে এটি ব্যবহার করে। কিন্তু যাদের এলার্জি সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটির ব্যবহার অনেক সময় ত্বকে চুলকানি বা ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে।

০২. লাল মেহেদী (Red Henna): লাল মেহেদী হচ্ছে সবুজ রঙের পাউডার যা থেকে খড়ের মত গন্ধ আসে যা মূলত লসোনিয়া ইনারমিস (Lawsonia Inermis) বিশ্বব্যপি যা হেনা নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক মেহেদীর ভিতরে এই লসোন নামক পদার্থটি মূলতো গাঢ় লাল বর্ণ তৈরী করে। এই লাল মেহদী ত্বক ও চুলের জন্য খুবই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। চুলের জন্য এটি সর্বোত্তম কন্ডিশনার। ত্বক ও চুলের ধরণের উপর রঙের সেড নির্ভর করে।

এটিই মূলত ন্যাচারাল হেনা। ০৩. হোয়াইট হেনা (Neutral Henna) : নিউট্রাল হেনা এক প্রকারের সবুজ পাউডার যা থেকে কাটা কাঁচা ঘাসের মত গন্ধ আসে। এটি চুলে কোন রঙ তৈরী করে না। নিউট্রাল হেনা আসলে কোন হেনা নয় এটি সেনা ইটালিকা (Senna italica) নামক গাছের গুড়ো যাকে ক্যাসিয়া ওবোভাটা ও (Cassia Obovata) বলে। এর ভিতরে এক প্রকারের প্রাকৃতিক এসিড রয়েছে যা এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল যা চুলকে লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে।

এটি চুল পড়াও রোধ করে। এটি চুলে কোন রং তৈরী করে না কিন্তু চুলে কিছুটা সোনালী রং আনে। এটি মিশরীয় এলাকায় পাওয়া যায়। মেহেদীর সাথে দারুচিনির মিশ্রণ করেও প্রায় নিউট্রাল হেনা বলে বিক্রি করে। প্রাকৃতিক এই মেহেদিগুলো ছাড়াও বাজারে নানা প্রকারের টিউব ও কোনে নানা রঙের পেস্ট মেহেদী পাওয়া যায় বডি ডিজাইনের জন্য।

প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রকৃত রং আসতে অনেক সময় লাগে এবং রঙের বৈচিত্রও খুব সীমাবদ্ধ বিধায় প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রাপ্ত উপাদান বিশ্লেষণ করে কৃত্রিমভাবে তৈরী মেহেদীর চাহিদা সবচেয়ে বেশী। রঙিণ মেহেদী, গ্লিটার মেহেদী পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরী। চুল ও ত্বকের জন্য বাজারে হাজার রকমের মেহেদী পাওয়া যায় তবে আমাদের দেশে মেহেদীর মান নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কোম্পানির পন্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ০৮. বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মেহেদি ডিজাইনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য: আফ্রিকান ডিজাইন: আফ্রিকান ডিজাইনে তাদের লোকজ, বিচিত্র, বন্য-সাহসী সংস্কৃতির প্রতিরূপ ফুটে উঠে। তাদের অধিকাংশ ডিজাইনগুলো জ্যামিতিক আকারে মোটা দাগে করা।

আদিবাসী সংস্কৃতিতে তাদের কিছু পবিত্র প্রাণী, দেবতা ও অদ্ভুত কিছু প্রতিক সম্বলিত যা স্থান ও সময়ের বিভিন্নতায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ স্বাভাবিক দর্শনে তা অন্যের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে। হাত-পা ছাড়াও মুখমন্ডলসহ শরীরের যে কোন স্থানে তারা ডিজাইন করে। কিছু কিছু ডিজাইন বিশেষ সামাজিক স্বীকৃতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে নির্দিষ্ট জনের জন্য নির্ধারিত থাকে। এরাবিয়ান ডিজাইন: এরাবিয়ানরা সংক্ষিপ্ত সরল ডিজাইন পছন্দ করে। মুসলিমরা অনেকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আরবী ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইন পছন্দ করে।

মেয়েরা লতাপাতাসহ ফ্লোরাল ডিজাইন খুব পছন্দ করে। গোটা হাত কিংবা শরীরে ভরাট ও বড় আকৃতির ডিজাইনের প্রচলন কম। এবস্ট্রাক্ট লাইন ডিজাইনের প্রচলন রয়েছে। ইন্ডিয়ান ডিজাইন: ভারত উপমহাদেশে মেয়েরা ভরাট, দীর্ঘ, কারুকার্যময় জটিল ডিজাইন পছন্দ করে বিশেষ করে বিয়েতে কন্যার বাহুর গোড়া থেকে আঙুলের নখ পর্যন্ত ধারাবাহিক গল্পের মত ডিজাইন করে। নানা রঙের মেহেদীর সাথে গ্লিটার ও ষ্টোনের ব্যবহার লক্ষনীয়।

নানা রকম কালার শেড ও ডট ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। নন মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানীয়প্রানী যেসন মাছ, ময়ুর, হাতি, পাখি ইত্যাদির ডিজাইন দেখা যায়। পশ্চিম ভারতের লোকজ সংস্কৃতিতে সূর্যের বিচিত্র ডিজাইন লক্ষনীয়। সনাতন ধর্মের বেশ কিছু প্রতিক ও আদিবাসীরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কিছু পবিত্র প্রতিক মেহেদীর ডিজাইনে ফুটিয়ে তোলে। পাকিস্তানের ট্রাডিশনাল ডিজাইনে ফ্লোরাল ডিজাইনের পাশপাশি চাঁদ-তারার ব্যবহার দেখা যায়।

ইদানিং উপমহাদেশের ডিজাইনে সাধারণ, হাল্কা ও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। ০৯. মেহেদির পেস্ট বানানোর পদ্ধতি: বাজারের পেষ্ট মেহেদী এখন খুবই সহজলভ্য। টিউব কিংবা কোনাকৃতির এই মেহেদীগুলো কৃত্রিম উপায়ে বানানো হয় বলে সকল কোম্পানির পণ্যের গুণগতমানের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। বাজারে অবশ্য আমদানীকৃত গুড়ো মেহেদীও পাওয়া যায় তবে তার মানও প্রশ্নাতীত নয়। তবে সবচেয়ে উত্তম হাতে বানানো মেহেদী।

বাড়ীতে মেহেদী গাছ না থাকলেও কাচা বাজারে ডালসমেত মেহেদীপাতা পাওয়া যায়। কাচা পাতা থেকে মেহেদী বানানোর পদ্ধতি হচ্ছে: ১. পরিষ্কার কাঁচা পাতা মিহি করে বেঁটে নিতে হবে। ২. মিহি করে বাটা কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে একটু লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন। ৩. কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে চা বা কফির কড়া লিকার মেশাতে পারেন। এতে মেহেদির রং গাঢ় হয়।

৪. কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে সামান্য পান খাওয়ার খয়ের মেশাতে পারেন। এতেও রং গাঢ় হবে। ৫. মেহেদি পাতার শুকনো গুঁড়ো হলে তা পেস্টে পরিণত করার জন্যে একটু গরম পানিতে মিশিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তাহলেই পেস্ট ব্যবহারের উপযোগী হবে। ৬. গুঁড়ো পেস্টের সাথেও লেবুর রস, চা বা কফির লিকার বা খয়ের মেশাতে পারেন।

৭. পেস্টের ঘনত্ব ঠিক করার জন্যে প্রয়োজনমতো লেবুর রস ও একটু চিনি গোলানো পানি পেস্টের সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন। ৮. মেহেদীর রং কালো করতে চাইলে মেহেদীর গড়োর সাথে প্রাকৃতিক নীল (Indigo) মেশাতে হবে। এই পদ্ধতি মূলত বডি ডিজাইনের জন্য। বাড়ির মেহেদী হলে চুলেও লাগাতে পারেন সেক্ষেত্রে খয়ের ও চিনি পানি মিশাবেন না। তবে বাজার থেকে গুড়ো মেহেদী কিনলে অবশ্যই ব্যবহার বিধিটি ভালোভাবে বুঝতে হবে।

প্যাকেটের গায়ে ব্যবহার বিধি ও পণ্যের মেয়াদ দেখে কিনতে হবে। বাজার থেকে কেনা হেয়ার ডাই দিয়ে ত্বকে ডিজাইন করবেন না। প্রাকৃতিক এই মেহেদিগুলো ছাড়াও বাজারে নানা প্রকারের টিউব ও কোনে নানা রঙের পেস্ট মেহেদী পাওয়া যায় বডি ডিজাইনের জন্য। প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রকৃত রং আসতে অনেক সময় লাগে এবং রঙের বৈচিত্রও খুব সীমাবদ্ধ বিধায় প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রাপ্ত উপাদান বিশ্লেষণ করে কৃত্রিমভাবে তৈরী মেহেদীর চাহিদা সবচেয়ে বেশী। রঙিণ মেহেদী, গ্লিটার মেহেদী পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরী।

চুল ও ত্বকের জন্য বাজারে হাজার রকমের মেহেদী পাওয়া যায় তবে আমাদের দেশে মেহেদীর মান নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কোম্পানির পন্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ১০. মেহেদির ব্যবহার বিধি: বডি ডিজাইনের জন্য মেহেদী লাগানোর নানা রকমের পদ্ধতি রয়েছে। আগে প্রায় সর্বত্রই কাঠি বা টুথপিক দিয়ে মেহেদি লাগানো হতো। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে কোন পদ্ধতি। ফয়েল পেপার, সিলোফেন বা পিভিসি বা ওয়াটার প্র“ফ পেপার দিয়ে এই কোনগুলো হাতে বানানো যায়।

বাজারে অবশ্য বিভিন্ন দেশে কোনকৃত পেষ্ট মেহেদী পাওয়া যায়। এছাড়া জ্যাকার্ড বোতল, ক্যারোট ব্যাগ ও ব্যবহৃত হয়। মরক্কোতে সিরিঞ্জ পদ্ধতি খুব জনপ্রিয়। যে পদ্ধতিতেই মেহেদী লাগান না কেন মেহেদী ব্যবহারের সময় আরো কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিৎ। ১. মেহেদি লাগানোর আগে হাত ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।

ময়েশ্চারাইজার বা লোশন-জাতীয় কিছু লাগানো যাবে না। ২. মেহেদি রাতে দিলে সকালে এর রংটা বেশি ভালো লাগবে। ঈদের মেহেদী তাই চাঁদ রাতে লাগানোর রীতি রয়েছে। ৩. টিউব মেহেদি দেয়ার আগে হাতে একটু লাগিয়ে দেখুন অ্যালার্জি হয় কি না। সব টিউব মেহেদী গুণগতমান সম্পন্ন নয়।

৪. মেহেদি লাগানোর পর যদি দেখেন উঠে যেতে চায় তাহলে লেবুর রস ও চিনি গোলা পানি ভিন্ন পাত্রে নিয়ে তুলোতে ভিজিয়ে মেহেদির প্রলেপের ওপর আস্তে আস্তে চেপে চেপে দেবেন। এতে পেস্ট ঝরে পড়বে না। ৫. দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত মেহেদি হাতে রাখা উচিত। পুরো মেহেদি শুকিয়ে যাবার পর ভোঁতা ছুরি কিংবা চামচ দিয়ে তুলে ফেলবেন। ৬. মেহেদি ওঠানোর পরে হাতে একটু চিনির সিরাপ লাগিয়ে নিলে রঙ ভালো হয়।

তারপর ৪/৫ মিনিট আগুনে হাত সেঁকে নিন। ৭. পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে হাতে সরিষার তের মেখে নিন। সম্ভব হলে পরবর্তী ছয় ঘণ্টা পানি লাগাবেন না। সাবান পানি থেকে হাত যতটা সম্ভব দূরে রাখুন। ৮. চুলের জন্য চুল ভালোভাবে শ্যাম্পু করে শুকিয়ে নিতে হবে।

চিরুনি ও ব্রাশ দিয়ে ৯. মেহেদি কেনার আগে অবশ্যই ভালো কোম্পানি দেখে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেখে নিবেন। ইন্সট্যান্ট মেহেদীর দাগ উঠানো সম্ভব নয়। ন্যাচারাল প্রসেসে নখ কিংবা ত্বকের পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই মেহেদীর দাগ দুরভিত হয়। এবং সেটাই উত্তম। সাধারনত ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত দাগ থাকে।

তবে চাইলে এ সময়টি কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রচুর পানি দিয়ে বার বার ঘষতে হবে। ক্লোরিন ব্যবহারে দাগ হাল্কা হয়। ব্রাশে টুথপেষ্ট মিশিয়ে নিয়মিতভাবে ঘষলে উপকার পাওয়া যায়। Alpha-Hydroxy Acid or Beta Hydroxy acid দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে দাগ হাল্কা হবে।

যে কোন ফার্মেসীতে এটি পাওয়া যায়। তবে কোনভাবেই ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা উচিৎ নয় কেননা এটি ত্বকের ক্ষতি করে। ১১. শিল্পে মেহেদির ব্যবহার: মেহেদী বা হেনা সুপ্রাচীন কাল থেকে চামড়া ও কাপড় ডাইংয়ে ব্যবহার হতো। শিল্প বিপ্লবের পরে এর ব্যবহার বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরে। সুদান, মরক্কো, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, চীন ও অষ্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে বানিজ্যকভাবে হেনা উৎপন্ন হতে থাকে অর্গানিক ডায়িংয়ের জন্য।

ভারতবর্ষের কৃষকদের এই সময় ইংরেজরা জোড়পূর্বক নীল চাষে বাধ্য করেছিল শিল্পে ইন্ডিগোর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের জন্য। সিল্ক ও উল জাতীয় কাপড়ে কালচে গাঢ় লাল রংয়ের জন্য হেনা ব্যবহৃত হয়। পার্শিয়ান কার্পেটেও এর ব্যবহার হয়। চামড়ার সাথে লৌহ ও লবনের সংমিশ্রনে dark-blue or greenish-black রঙ তৈরী হয়। হেনাসহ যেকোন প্রাকৃতিক তানিন পশুর চামড়ারকে ফ্লাক্সিবল ও ষ্ট্রং করে।

চামড়ার রেসিন্ট্যান্স বাড়ায়। পরবর্তিতে কৃত্রিমভাবে তানিন আবিস্কৃত হবার পর এর চাহিদা খুবই কমে যায়। কিন্তু একাবিংশ শতাব্দিতে এসে উন্নত বিশ্বে অর্গানিক পন্যের নতুন চাহিদা তৈরী হয়। জাপানসহ পৃথিবীর উন্নতদেশের এক্সক্লুসিভ অনেক বায়াররা এখন অর্গানিক পন্যের দিকে ঝুকে পড়েছে বিধায় শিল্পে মেহেদীর নতুন করে চাহিদার তৈরী হয়েছে। পোষাক ও চামড়া শিল্প ছাড়াও অন্যান্য শিল্পেও মেহেদীর তানিন ব্যবহার হচ্ছে।

১২. মেহেদি গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার তুলে ধরবো: মেহেদীর পাতা, ফল ও ফুল ছাড়াও এর কাঠ ও বাকলের রয়েছে বহুবিধ ঔষধিগুণ। এর বাইরেও নানা প্রকারের ব্যবহারিক জিনস তৈরী মেহেদীর কাঠ ও বাকল দিয়ে। মেহেদীর কাঠের ফাইবার খুবই সুন্দর শক্ত প্রকৃতির। ভারতে এ কাঠ দিয়ে তাবুর ক্লিপ ও নানা প্রকার টুলসের হাতল তৈরী হয়। ইন্দোনেশিয়ায় মেহেদীর ডাল দিয়ে বানানো হয় টুথব্রাশ।

মেহেদী গাছের বাকল দিয়ে কেনিয়ায় সুদৃশ্য বাস্কেট তৈরী হয়। তবে উৎকৃষ্টমানের জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। মেহেদি গাছের বিভিন্ন অংশের ঔষধিগুণঃ শিকড় : লেপরোসি (Leprosy), স্কিন ডিজিজ, অ্যামের্নোহা (amenorrhoea), ডাইসমের্নোহা (dysmenorrhoea), প্রিমেচিউর গ্রেয়িং হেয়ার. পাতা : বানিং সেনশন, ডাইরিয়া, ডিসেন্টিরি, লেপরোসি (leprosy), বয়েলস (boils), লিওকডেরমা (leucoderma), স্ক্যাবিস, এনেমিয়া(anemia), হেমোরহাগস ( hemorrhages), হেয়ার, হেয়ার গ্রেনেস, আমের্নোহা (amenorrhoea), এ্যান্ড জন্ডিস (jaundice). ফুল : বানিং সেনশন, কারডেওপ্যাথি (cardiopathy), এমেনিয়া (amentia), ইনসোনিয়া (insomnia), এ্যান্ড ফিভার (fever). ফল : ইন্টেলেক্ট প্রোমটিং (Intellect promoting), কন্সটিপেটিং (constipating), ইন্টারমিটেন্ট ফিভারস (intermittent fevers), ইন্সানিটি (insanity), এমেনিয়া (amentia), ডাইরিয়া, ডিসেন্টিরি, এ্যান্ড গ্যাস্ট্রোপ্যাথি (gastropathy). ১৩. মেহেদির ঔষধি গুণঃ মেহেদী মানব সমাজের জন্য প্রকৃতির এক অনবদ্য দান। এর রয়েছে এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল, এন্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি-ইনফ্লেমেটরী, কুলিং, হিলিং ও সিডেটিভসহ অনেক গুনাগুণ যা মানব দেহ ও মনের বিভিন্ন রোগ প্রশমনকারী। তাই হাজার হাজার বছর ধরে মানব জাতি পাথ্য হিসেবে মেহেদী গাছের বিভিন্ন অংশ নানা কারনে ব্যবহার করে আসছে।

এর ঔষধি গুণাগুণের ব্যাপকতা এত বিশাল যে দু একটি পর্বে তা সম্পর্কে সাম্যক কোন ধারণা দেয়া সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করবো পরবর্তি প্রতিটি পর্বে কয়েকটি রোগ নিয়ে কথা বলতে। জন্ডিস, শ্বেতপ্রদহ ও শুক্রমেহ রোগে মহেদী গাছের ব্যবহার: ১. জন্ডিস : আঙুলের মতো মোটা মেহেদি গাছের মূল (কচি হলে ভালো) অর্ধভাঙা আতপ চাল ধোয়া পানি দিয়ে ঘষে (চন্দন পাটায় ঘষলে ভালো হয়) দুই চা চামচ পরিমাণ নিয়ে ৮-১০ চামচ ওই চাল ধোয়া পানি মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে দুই বার খেতে হবে। এভাবে চার-পাঁচ দিন খেলে আরোগ্য হয়। এ সময় ডাবের পানি বা আখের রস খেলে কাজ হবে না।

২. শ্বেতপ্রদহ (Leucorrhoea) : ২৫ গ্রাম মেহেদিপাতা সিদ্ধ করে সেই পানিতে উত্তর বস্তি (ডুস দেয়া) দিলে সাদাস্রাব ও অভ্যন্তরে চুলকানি (Itching) প্রশমিত হয়। স্থানভ্রষ্ট জরায়ুর ক্ষেত্রেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অসুবিধা কমে যায়। ৩. শুক্রমেহ রোগ : মেহেদী পাতার রস এক চা চামচ দিনে দুই বার পানি বা দুধের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে উপকার পাওয়া যায়। ১৪. মেহেদির ঔষধি গুণঃ মাথা ও চুলের বিভিন্ন রোগে মহেদী গাছের ব্যবহার : ইউনানি চিকিৎসকদের মতে চুল উঠে যাওয়া বা পাকায় একটি হরীতকী ও ১০-১২ গ্রাম মেহেদিপাতা একটু থেতো করে ২৫০ মিলি পানিতে সিদ্ধ করে ৬০-৭০ মিলি থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা হলে মাথায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া খুশকি দূর করতেও এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

প্রাকৃতিক মেহেদীর ভিতরে এক প্রকারের প্রাকৃতিক এসিড রয়েছে যা এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল যা চুলকে লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে। এটি চুল পড়াও রোধ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ মেহেদীকে বলেছেন পৃথিবীর সেরা কন্ডিশনার। প্রাকৃতিক মেহেদী পেস্ট মাথা ঠান্ডা রাখে ও মাথা ব্যাথা দূর করে। ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল একটি পাত্রে সিদ্ধ করার সময় ৬০ গ্রাম হেনা পাতা ক্রমান্বয়ে যোগ করা হয়; তারপর একটি কাপড় দিয়ে ছেঁকে বোতলে সংরক্ষণ করা হয়।

এটি নিয়মিত মাখলে চুলের স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এটি মাথার টাকের চিকিৎসারও সহায়ক। ১৫.মেহেদির ঔষধি গুণঃ স্কীন ও ওরাল ডিজিজ : অত্যান্ত উপকারি ভেষজ হেনার পাতা ও ফুল হতে আহরিত তেল অনেক চর্ম-মলম তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চামড়ায় ক্ষত, পোড়া ও চামড়ার ফ্যাকাসে হলুদ দাগ চিকিৎসায় অত্যান্ত কার্যকরী ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হয়। স্কেবিস, চর্মের চুলকানি জাতীয় ও নখের ফাটার চিকিৎসায় হেনা পেস্ট ব্যবহার হয়।

ত্বকের বিভিন্ন রোগ যেমন- একজিমা, খোসপাঁচড়া, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন, ঘা, কুষ্ঠু, শ্বেতী ইত্যাদি রোগে মেহেদিপাতার রস উপকারী। পাতার রস দিনে দুই বার আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এ ছাড়া যাদের গায়ের বা মুখের চামড়া কুঁচকে ঢিলে হয়ে বা ঝুলে গেছে, তারা এই পাতার রস দিয়ে তৈরি তেল মাখলে অনেকটা স্বাভাবিক হবে। গরমকালে যাদের শরীওে ঘাম বেশি হয়ে দুর্গন্ধ হয় তারা বেনামূল (Vetiveria zizanioides) মেহেদিপাতা সিদ্ধ পানিতে গোসল করলে উপকার পাবেন। দেহ হতে পানি হ্রাস প্রতিরোধ করে; আবার ময়েশ্চার ধারণের ফলে কোন অঙ্গ স্ফিতীর রোধে এক প্রকার ডিসল্ভিং ফ্যাক্টর গঠনে কাজে লাগে।

হাত-পা জ্বালায় পাতার পেস্ট পুরু করে লাগিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। কারণ মেহেদিতে আছে শীতলকারক উপাদান। গর্ভবতী মায়ের ৮ মাসের সময় তার নাভীসহ গোটা তলপেটে মেহেদীর ভরাট ডিজাইন করলে গর্ভজনিত কারণে চামড়ার ফাঁটা ও দাগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পাঁচ-সাত গ্রাম পাতা জ্বাল দিয়ে সেই গরম পানি দিয়ে দিনে তিন-চারবার গড়গড়া করলে মুখ ও গলার ক্ষত সেরে যায়। দীর্ঘস্থায়ী কাঁশি সারতে ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এ চিকিৎসা কার্যকর।

মেহেদী পাতার সাথে অল্প খ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।