আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘ক্ষমাহীন ক্ষমা’

السلام عليكم ورحمة الله খুনের মামলায় লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা আবু তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মওকুফের ঘটনায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ রকম একজন খুনিকে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘটনা মানুষকে বেশ আহত করেছে। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে এ-সংক্রান্ত খবরের নিচে গত তিন দিনে বারো শতাধিক পাঠক নানা মন্তব্য লিখেছেন। বলেছেন কষ্ট, হতাশা, ক্ষোভের কথা। প্রতিবাদ ও নিন্দাও জানিয়েছেন।

পাঠকদের বড় একটা অংশ এটাকে ‘রাষ্ট্রের লজ্জা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের মতে, এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়, খুনির অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। তিন দিন ধরে বহু লোক প্রথম আলোর কার্যালয়ে ফোন করেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বেশির ভাগ পাঠকের মুখে নিহত নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সেই প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, ‘এই খুনির ক্ষমা হয় কীভাবে?’ একজন পাঠক লিখেছেন, ‘এটি ক্ষমাহীন ক্ষমা’। ‘খুনিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা’ শিরোনামে গত বুধবার প্রথম আলোতে শীর্ষ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ওই দিনই প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ৫১০ জন পাঠক মন্তব্য লিখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

এর আগে প্রথম আলোর কোনো একক সংবাদে এক দিনে এত বিপুলসংখ্যক পাঠক মন্তব্য করেননি। পরদিন বৃহস্পতিবার ‘নুরুল ইসলামের স্ত্রীর প্রশ্ন, রাষ্ট্রপতি কি তাঁর স্ত্রীর খুনিদের ক্ষমা করবেন?’ এবং ‘লক্ষ্মীপুরে আবার আতঙ্ক, তাহেরের তিন ছেলেই খুনের মামলার আসামি’ শিরোনামে প্রকাশিত দুটি খবরে যথাক্রমে ৩১৫ জন ও ২১৮ জন পাঠক মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া গতকাল শুক্রবার ‘বিপ্লবের নেতৃত্বে অপহরণ ও খুন’ শিরোনামের খবরে ১৭৬ জন পাঠক মন্তব্য করেছেন। তবে আরও কিছু মন্তব্য এসেছে, যেগুলো শোভন নয় বলে প্রকাশ করা হয়নি। পাঠকদের অনেকে দাবি করেছেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া যেন পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।

তাঁরা চান, তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলো সরকার জানুক। আবদুল্লাহ আল মামুন নামের রংপুরের এক পাঠক লিখেছেন, ‘হত্যা বা ফাঁসি আমাদের কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আইন অনুযায়ী রায়ে খুনির ফাঁসি হয়েছিল। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির আদেশ বাতিল হওয়ায় দেশব্যাপী বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ’ অনেক পাঠকই ‘কী চমৎকার দেখা গেল...!!’, ‘শাবাশ আওয়ামী লীগ সরকার...চালিয়ে যাও’, ‘আহা রে কী ভাগ্য, আওয়ামী লীগ করে, যত খুশি খুন করো, কোনো সমস্যা নেই, রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেবেন’, ‘ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ’, ‘ধিক’, ‘গুড নিউজ ফর প্রফেশনাল কিলারস’—এমন নানা শ্লেষাত্মক মন্তব্যের মাধ্যমে ভিন্ন রকম প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

একজন লিখেছেন, ‘সুদূর প্রবাসে বসে এই জাতীয় অবিচার দেখে লজ্জিত হই, মর্মাহত হই। সিদ্ধান্ত নিই আর দেশের কোনো পত্রিকাই পড়ব না। কিন্তু বেশি দিন পারি না। আবার মাটির টানে দেশের পত্রিকা খুলি। কেউ কি নেই যে মুক্তি দেবে?’ এক পাঠকের প্রশ্ন, ‘কী হইতেসে এই সব? জনগণের সহ্যেরও একটা সীমা আছে, এইটা কি সরকার আর সরকারের রাষ্ট্রপতি ভুলে গেছেন? তা না হলে একটা ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত আসামি কীভাবে ক্ষমা পায়।

’ কেউ কেউ এ জন্য রাষ্ট্রপতি নয়, আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন। গতকাল আবু নাসের হাসান হামিদ নামের এক পাঠক লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে যাঁরা ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করিয়েছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। ’ কেউ কেউ এটাও স্মরণ করিয়ে দেন যে ‘এসব সন্ত্রাসীর কার্যকলাপের জন্য আওয়ামী লীগের পতন হয়েছিল। তাহের, জয়নাল হাজারী, হাজি সেলিম প্রমুখের কী দাপট ছিল। তাহের পরিবারের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দেশ বিখ্যাত ছিল।

আবার এসব কার্যক্রমই হয়তো আওয়ামী লীগের পতন ডেকে আনবে। খুনের মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ক্ষমা পেলে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকে না। ’ জাওয়াদ নামের এক পাঠক লিখেছেন, ‘বিপ্লব যাঁকে খুন করেছিল, তিনি কারও পিতা, স্বামী, সন্তান কিংবা ভাই ছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কেউ ছিলেন না। এই ক্ষমার পর রাষ্ট্রপতি কি গ্রেনেড হামলায় নিহত তাঁর স্ত্রী হত্যার বিচার পাওয়ার নৈতিক অধিকার হারালেন না?’ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমলে লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসের ‘গডফাদার’ হিসেবে সারা দেশে আলোচিত ছিল আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ও তাঁর ছেলেরা।

এর মধ্যে তাহেরের ছেলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অসংখ্য অভিযোগ ছিল। তখন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতেও ভয় পেত মানুষ। এরপর ১০ বছর বিপ্লব ফেরারি ছিলেন। এর মধ্যে বিপ্লব তিনটি হত্যা মামলায় আদালতের রায়ে দোষী প্রমাণিত হন। গত ৬ এপ্রিল তিনি আত্মসমর্পণ করেন।

বর্তমানে কারাবন্দী এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর মৃত্যুদণ্ড সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি বিশেষ অধিকারবলে ক্ষমা করেছেন। এটাকে ‘ক্ষমাহীন ক্ষমা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের একজন পাঠক। শুধু তা-ই নয়, ক্ষুব্ধ কিছু পাঠক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পদত্যাগ চেয়েও মন্তব্য লিখেছেন। একজন লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি নৈতিকভাবে দেশের সর্বোচ্চ পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।

’ লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লব নুরুল ইসলাম হত্যা ছাড়াও আরও দুটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। এই দুটি মামলায়ও বিপ্লবের সাজা মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। বিপ্লবের ভাই সালাহউদ্দিন টিপু বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর কাছে এ কথা স্বীকার করেছেন। এর মধ্যে একটি মামলার যাবজ্জীবন দণ্ড মওকুফ হয়েছে বলেও টিপু দাবি করেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।

বিচারিক আদালতেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো কাগজ জমা পড়েনি। এদিকে বিপ্লবের ক্ষমার খবর জানার পর নিজের ও সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নিহত নুরুল ইসলামের স্ত্রী রাশিদা ইসলাম। রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘রাষ্ট্রপতি, আপনি কি আপনার স্ত্রীর খুনিদের ক্ষমা করবেন?’ বৃহস্পতিবার খবরটি অনলাইন সংস্করণে পড়ে বেশ কিছু পাঠক মন্তব্য লিখেছেন, এই প্রশ্ন তাঁদেরও। একজন লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি তো একজন খুনিকে ক্ষমা করেন নাই, করেছেন তাঁর দলের একজন কর্মীকে, তাই স্ত্রীর খুনিকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। আমরা চাই, রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর খুনিরও বিচার হোক।

আমরা কোনো খুনিরই ক্ষমা চাই না...। ’ কোনো কোনো পাঠক যদি সুযোগ থাকে বিপ্লবকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধও করেছেন। এক পাঠক লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ যে রাস্তা দেখাচ্ছে আল্লাহ জানেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসে আবার কী করবে। ’ কেউ কেউ এটাও স্মারণ করিয়ে দেন যে বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও সুইডেন-প্রবাসী মহিউদ্দিন আহমেদ জিন্টু নামে বিএনপির এক নেতার মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করেছিলেন। ঢাকায় এক জোড়া খুন মামলায় এরশাদ সরকারের আমলে সামরিক আদালতে জিন্টুর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।

প্রথম আলোর অনলাইনে করা মন্তব্যে কয়েকজন পাঠক বিপ্লবের আগে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যে নাটোরের গামা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২১ জনকে ক্ষমা করেছিলেন, সেটাও স্মরণ করিয়ে দেন। এসব পাঠকের মতে, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা করার বিশেষ অধিকারের অপব্যবহার বা দলীয় বিবেচনায় প্রয়োগ হচ্ছে। কেউ কেউ এই অধিকার অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় আইন করার কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ এই বিশেষ অধিকার রহিত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন। পাঠকের মন্তব্য ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।