আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদা এক মধ্যাহ্ন ভোজনে

শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে সেকথা জানো না! গিয়েছিলাম এক নাটক দেখতে। সেখানে হঠাৎ তার সংগে চোখাচোখি। তার হাতের ইশারার সাড়া দিতেই বিরতির সময় উঠে পাশে গিয়ে বসলাম। বহুদিন পর আজ দেখা হলো আমাদের। তাকে আসলে আমি চিনতেও পারতাম না যদি না পাশের থেকে কেউ একজন আমাকে নামটা না বলে দিতো।

তবে আমি কাছে যাওয়ামাত্রই উজ্জ্বল হাসি দিয়ে সে বলা শুরু করলো, “আহ্, সেই প্রথম দেখার পর কত্তোদিন বাদে আপনার সংগে দেখা হলো! সময় মনে হয় আসলেই উড়ে চলে যায়! আমরাও দিনকে দিন বুড়িয়ে যাচ্ছি। মনে আছে আপনার সংগে যেদিন প্রথম দেখা হলো? আমাকে আপনি লাঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন। ” উফ্, আল্লাহ মাফ করো! মনে থাকবেনা আবার? বিশ বছর আগের কথা। আমি তখন প্যারিস থাকি। কবরস্থানের পাশে লাতিন কলোনিতে আমার ছোট্ট এক খুপরির মতো এ্যাপার্টমেন্ট।

সাধের পরাণটা শরীরে ধরে রাখার জন্য যা দরকার ততোটুকুই আমি কোনরকমে উপার্জন করছি। আমার একটা বই পড়ার পর সে আমাকে চিঠি লিখেছিলো। আমিও উত্তর দিয়েছি, ধন্যবাদ জানিয়ে। সেই সময় তার কাছ থেকে আমি আরেকটা চিঠি পেলাম। সে প্যারিসে এসেছে কিছু কাজে এবং এই ফাঁকে আমার সংগে একটু গল্প করার সুযোগ চায়।

তবে সে বেশ ব্যস্ত থাকবে আর বৃহস্পতিবার দুপুরটাতেই শুধু তার একটু সময় হবে। লুক্মেমবার্গে সে সকালটা কাটাবে আর তারপর দুপুরের দিকে আমি কি তাকে ফয়োট-এ একটা ছোটখাটো লাঞ্চ করাতে নিয়ে যেতে পারবো? ফয়োট এমন একটা রেস্টুরেন্ট যেখানে ফ্রেঞ্চ সিনেটরদের মতো সব হোমরা চোমরা লোকজন খেতে যেতেন। সামর্থ্যের ধারেকাছেও নেই বলে আমি স্বপ্নেও ভাবতাম না সেখানে কখনো যাবার কথা। কিন্তু তার চিঠিতে আমি তো গদগদ আর আমার বয়সটাও এমন ছিলো যে কোন নারীকে ‘না’ বলা তখনো শিখিনি। ( অনেক কম পুরুষই সময়মতো এটা বলতে শেখে।

) পুরো মাসের খরচ চালাতে আশি ফ্র্যাঙ্ক ছিলো আমার কাছে আর মোটামুটি একটা লাঞ্চ সারতে পনের’র বেশি লাগারই কথা না। আগামি দুই সপ্তাহ যদি আমি কফি খাওয়া বাদ দেই তাহলে খুব ভালোভাবেই চালিয়ে নিতে পারবো বাকি মাসটা। আমি চিঠিতে জানালাম যে আমার বন্ধুটির সংগে বৃহস্পতিবার সাড়ে বারোটায় ফয়োটে দেখা হবে। যতোটা কম বয়সী ভেবেছিলাম ততোটা সে ছিলো না। আকর্ষণীয় নয় বরং চেহারায় আকর্ষণ করতে চাওয়ার চেষ্টাটাই বেশি ধরা পড়ে।

তার বয়স মোটামুটি চল্লিশের কোঠায় ( নি:সন্দেহে সুন্দর একটা বয়স, কিন্তু প্রথম দেখায় তারুণ্যের প্রবল চাহিদায় সুড়সুড়ি জাগানোর মতো বয়স অবশ্যই না )। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছিলো তার সবগুলো দাঁত – ঝকঝকে সাদা, বড় বড় সমান দাঁতের সারি – যে কোন জাগতিক কারণে যা থাকা দরকার তার চেয়েও যেন অনেক বেশি পরিমাণে তারা আছে। সে বেশ ভালোই বকর বকর করতে পারে তবে যেহেতু আমার ব্যাপারে কথা বলতেই তার আগ্রহ তাই মনোযোগী শ্রোতা হবার জন্য প্রস্তুতি নেয়াই ছিলো। ফয়োটের খাবারের মেনুটা দেখে আমার তো মাথায় হাত – যা আশা করছিলাম তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি দাম সবকিছুর। কিন্তু সে আমার দুর্ভাবনা কমিয়ে দিয়ে বললো, “আমি লাঞ্চে কখনোই তেমন কিছু খাই না।

” আমিও দয়ালু স্বরে বললাম, “আহা, কিছু না খেলে কি চলবে!” “আমি কখনোই একটা জিনিসের বেশি কিছু খাই না। আমার মনে হয় ইদানিং লোকজন দরকারের চেয়েও অনেক অনেক বেশি খায়। একটু মাছ খাওয়া যায়। ওদের কাছে স্যামন মাছটা আছে কি না কে জানে। ” যদিও এখন স্যামনের মওসুম না আর মেনুতেও নাম ছিলো না, তারপরেও আমি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম স্যামন আছে কি না।

আরে হ্যাঁ, আমার কি কপাল‍! আজকে একটু আগেই নাকি একটা টুকটুকে স্যামন মাছ এসেছে। মওসুমে এটাই তাদের প্রথম। আমি আমার মেহমানের জন্য আনতে বললাম সেই মাছ। ওয়েটার তাকে জিজ্ঞেস করলো মাছটা রান্না হতে হতে সে কিছু নেবে কি না। সে উত্তর দিলো, “ না, না, আমি একটা জিনিসের বেশি কখনো খাই না।

তবে ক্যাভিয়ার থাকলে অন্য কথা। ক্যাভিয়ারে আমি কখনো মানা করি না। ” আমার বুকটা একটু কেঁপে গেলো। ক্যাভিয়ারের সামর্থ্য তো আমার নেই, তবে সেই কথা আমি তাকে বলতেও পারছিলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম ক্যাভিয়ার আনতে।

আমার নিজের জন্য বেছে নিলাম মেনুর সবচেয়ে সস্তা খাবারটা – একটা ভেড়ার মাংসের কাবাব। “আমার মনে হয় না মাংস খাওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কাবাবের মতো ভারি একটা কিছু খাবার পর কাজ করা যায় না। বেশি বেশি উদরপূর্তি খাওয়া আমি একেবারেই পছন্দ করি না। ” আমার খাবারের ফরমায়েশটা শোনামাত্রই সে জ্ঞান বিতরণ শুরু করলো।

তারপরে এলো পানীয় বেছে নেয়ার পালা। সে বললো, “আমি কখনো লাঞ্চে কিছু পান করি না। ” আমি তড়িৎ সায় দিলাম, “আমিও না!” “তবে সাদা ওয়াইন হলে অন্য কথা,” সে এমনভাবে বলে চললো যেন আমি কিছুই বলিনি। “এই ফ্রেঞ্চ সাদা ওয়াইনগুলো এতো হালকা। হজমের জন্য খুব ভালো কাজ দেয়।

” আমি তখনো অতিথিপরায়ণ বটে, কিন্তু সেই উৎসাহ আর নেই। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি নেবেন?” সে আমার দিকে তার ঝকঝকে সাদা দাঁতের একটা উজ্জ্বল আর বেশ আনন্দিত ঝলক মারলো। “আমার ডাক্তার তো আমাকে শ্যাম্পেইন ছাড়া অন্য কিছু পান করতে মানা করেছে। ” মনে হলো আমি নিমেষে যেন ওর দাঁতের মতোই সাদা হয়ে গেলাম। অর্ধেক বোতল আনতে বললাম।

আর বললাম আমার ডাক্তার আমাকে যে কোন অবস্থাতেই শ্যাম্পেইন খেতে একদম নিষেধ করেছে। “আপনি তাহলে কি খাবেন?” “পানি। ” সে ক্যাভিয়ার খেলো, স্যামন খেলো। হালকা গলায় শিল্প, সাহিত্য আর সংগীত নিয়ে আলাপ করলো। কিন্তু আমার মাথায় শুধু ঘুরছে কখন খাবারের বিল আসবে।

ভেড়ার কাবাবটা আসার পর সে যেন একদম আমাকে পেয়ে বসলো। “আপনার তো লাঞ্চে খুব ভারি খাবার অভ্যাস দেখছি। একদম ভুল কাজ করছেন। আপনি আমার মতো কেন শুধু একটা জিনিস খান না? আমার মতো খেলে শরীর অনেক ভাল্লাগবে আপনার। ” “আমি তো একটা জিনিসই খাচ্ছি!” বলতে বলতেই দেখলাম ওয়েটার খাবারের বিলটা নিয়ে আসছে।

কিন্তু সে ওয়েটারকে যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। “নাহ্, আমি কখনো লাঞ্চে তেমন কিছুই খাই না। শুধু একটু হালকা কিছু, তার বেশি একদম না। আর তা-ও কথা বলতে গেলে একটু খেতে হয় বলে খাওয়া। এর বেশি আর কিচ্ছু আমি খেতেই পারবো না – তবে ওদের কাছে যদি বড় বড় এ্যাসপারাগাসগুলো থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।

প্যারিসে এসে ওগুলো না খেয়ে গেলে আফসোস রয়ে যাবে। ” আমার বুকটা একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বিভিন্ন দোকানে আমি দেখেছি এগুলো আর আমি এ-ও জানি যে তারা অনেক অনেক দামী। এই সুস্বাদু সবজিগুলো দেখে জিবে পানি আসলেও সংবরণ করতে হয়েছে সবসময়। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাডাম জানতে চাইছেন আপনাদের কাছে বড় আকারের এ্যাসপারাগাস হবে কি না।

” আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চাইছিলাম যেন সে উত্তরে না বলে। কোথায় কি! বরং তার উদার, সাধু মার্কা চেহারায় বিশাল এক হাসি ফুটে উঠলো। সায় জানিয়ে বললো যে তাদের কাছে এতো বড়, এতো সুন্দর নরম এ্যাসপারাগাস আছে যে সে জিনিস দেখতে পাওয়াটাই একটা আশ্চর্যের বিষয়। আমার অতিথি জানালো, “আমার একেবারেই খিদে নেই। তবে আপনি জোর করছেন বলেই আমি এ্যাসপারাগাসে আর মানা করবো না।

” আমি আনতে বললাম ওর জন্য। “আপনি খাবেন না?” “নাহ্, আমি কখনো এ্যাসপারাগাস খাই না। ” “কিছু লোক যে এসব খায় না আমি জানতাম। তবে আসলে কি, আপনি এতো এতো মাংস খেয়ে আপনার রুচি নষ্ট করে ফেলেছেন। ” এ্যাসপারাগাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভয়ে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো।

সারা মাস চলার মতো টাকা আমার কাছে থাকবে কি না সেই চিন্তা করার সময়টাও পার হয়ে গেছে ততোক্ষণে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম খাবার বিল দেবার মতো যথেষ্ট টাকা আমার কাছে আছে কি না। যদি দশ-পনের ফ্র্যাঙ্কের জন্য আমার অতিথির কাছে হাত পাততে হয় তাহলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে। শেষ পর্যন্ত উপায় না থাকলে হয়তো আমার ঘড়িটা বন্ধক রেখে যেতে হবে। বলবো পরে এসে দিয়ে যাবো টাকা।

এ্যাসপারাগাস চলে এসেছে। বিশাল আকারের তারা, জিবে পানি চলে আসার মতো চেহারা। গলিত মাখনের গন্ধ যেন আমার নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছিলো। আমার সামনে বসে মহিলাটি গোগ্রাসে সেগুলো তার পেটে চালান করলো আর আমি সেই আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে দেখতে বল্কান অঞ্চলের নাটক নিয়ে আলাপ করলাম। শেষ পর্যন্ত খাওয়া শেষ হলো তার।

“কফি?” উত্তর দিলো সে, “হ্যাঁ, কফি আর একটু আইস-ক্রীম। আর তেমন কিছু না। ” ততোক্ষণে আমি এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করারও উর্ধ্বে চলে গেছি যেন। নির্বিকার চেহারায় নিজের জন্য কফি আর ওর জন্য আইস-ক্রীম এবং কফি আনতে বললাম। “আপনি জানেন, একটা ব্যাপারে আমি খুব বিশ্বাস করি,” আইস-ক্রীম খেতে খেতে বলছিলো সে।

“সবসময় পেটে কিছু খিদে বাকি রেখে খাওয়া শেষ করা উচিত। ” আমি ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কি এখনো খিদে আছে?” “আরে না, আমার কথা বলছি না তো। দেখছেন না, আমি তো একদম লাঞ্চ করি না। সকালে এক কাপ কফি খাই, তারপর রাতের খাবার। কিন্তু দুপুরে আমি একটা জিনিসের বেশি কিছু খাই-ই না।

আমি তো আপনার কথা বলছিলাম। আপনি এত্তোগুলো মাংস খেলেন, আপনার পেটে আর জায়গা বাকি থাকার কথাই না। ” “ওহ্, আচ্ছা। ” তারপরই একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেলো। কফির জন্য যখন বসে আছি, তখন ম্যানেজারটি চলে এলেন তার নকল মুখে একটা চকচকে হাসি ঝুলিয়ে।

হাতে একটা ঝুড়ি ভর্তি এত্তো বড় বড় পীচ। কিশোরীর গালের মতো টুকটুকে রঙ তাদের। কিন্তু এখন তো পীচের মওসুম চলছে না! আল্লাহ একমাত্র জানেন তাদের কেমন দাম! বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না অবশ্য। দামটা আমিও জেনে গেলাম, একটু পরেই – আমার অতিথি কথা বলতে বলতে একটা উঠিয়ে নিলো ঝুড়ি থেকে। “দেখেন তো, আপনি কতোগুলো মাংস খেয়ে আপনার পেট একদম ভরে ফেলেছেন” – আহারে আমার বেচারা কাবাবটা – “আর আপনি এখন কিছুই খেতে পারছেন না।

কিন্তু আমি তো মাত্র হালকা নাস্তা করেছি। এখন একটা পীচ খেয়ে ফেলাও আমার জন্য কোন ব্যাপারই না। ” বিল শোধ করার পর দেখা গেলো ওয়েটারের টিপ দেবার জন্য মাত্র কয়টা টাকাই অবশিষ্ট আছে। আমার রাখা তিনটা ফ্র্যাঙ্কের ওপর আমার অতিথির চোখ কয়েক মুহুর্তের জন্য একটু থমকে গেলো। সে হয়তো আমাকে বেশ অভদ্রও ভাবছে।

কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হলাম তখন আমার পকেটে আর একটা পয়সাও বাকি নেই। অথচ সামনে সারাটা মাস তখনো বাকি। বিদায় নিতে নিতে সে আমাকে বললো, “আমার মতো খাবেন এখন থেকে। দুপুরের খাবারে কখনো একটার বেশি কিছু খাবেন না। ” উত্তর দিলাম, “বরং তার চেয়েও ভালো কাজ করবো।

আমি আজকে রাতে কিছু খাবোই না!” হাসতে হাসতে সে বললো, “আহা, মজা করছেন! আপনি ভালোই মজা করতে পারেন!” তারপর একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার প্রতিশোধ আমি পেয়েছি। আমি নিজে যে খুব প্রতিশোধপরায়ন মানুষ তা না। তবে যখন শোধ নেয়ার ব্যাপারটা ওপরওয়ালা নিজের হাতেই তুলে নেন তখন নির্মল তৃপ্তির সংগে সেটা উপভোগ করাতে দোষের তো কিছু নেই। আজকে তার ওজন ২৯৪ পাউন্ড।

মানে ১৩৩ কেজির কিছু বেশি। Original : The Luncheon by Somerset Maugham ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।