আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইফ শাহজাহান

সাইফ শাহজাহান রেখাচিত্র মোমিন উদ্দীন খালেদের ছবিতা প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি পলে, নিজ অক্ষরেখার ওপর ভর করে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার ঘটনাটির মধ্যে যে অজস্র চবৎংঢ়বপঃরাব-এর উদয় এবং বিলয় ঘটছে শিল্পতৃষ্ণায় তা যদি আমরা মূর্ত করতে পারতাম তাহলে অসীমের স্পন্দন মাধুর্য উপলব্ধি করা সহজ হত। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুক্ষতার ভেতরের যে মাধুর্য, তাকে খুঁজে নিতেও প্রয়োজন শিল্পতৃষ্ণার। এক সময় আমার মনে হত, প্রতি দিন কত অজস্র কবিতার মত দৃশ্য ফ্রেম বন্দি না হয়ে হারিয়ে যাচ্ছেÑ যদি আমার একটি ক্যামেরা থাকত তবে সেগুলোর ছবি সহমর্মী মানুষদের জন্য তুলে রাখতাম। পরে যন্ত্র হিসেবে ক্যামেরার অনেক সীমাবদ্ধতায় বুঝেছি ধ্যানী-মৌনী কিংবা মুখর প্রকৃতি স্টিল ক্যামেরায় ফ্রেম বন্দি হয় কিন্তু তার কাব্যিকতটা উবে যায়। যে কোনও মাধ্যমেই অনুভূতির প্রকাশে যোগ-বিয়োগ ঘটেÑ এই যে এখন লিখছি তার ভেতরেও সেটি ঘটে চলেছে।

মুখে বললে তাও শ্রোতার শ্রবণ এবং প্রস্তুতি সাপেক্ষে যোগ-বিয়োগ ঘটতো। বিষয়টা হচ্ছে বক্তা হিসেবে, লেখক হিসেবে কিংবা আলোকচিত্রী বা চিত্রী হিসেবে কে কতটা সিস্টেম লসকে স্বীকার করে নেবÑ তার ওপরই নির্ভর করবে অপর পক্ষে দর্শকের- পাঠকের- সঙ্গে যোগাযোগের প্রকৃত মাত্রা। উপরের কথা গুলো মনে এল শিল্পী মোমিনউদ্দীন খালেদের রেখাচিত্র বইটি পড়তে গিয়ে। কবিরা যা লেখেন তা কবিতা শিল্পীরা যা আঁকেন তাকে আমি ছবিতা বলিÑ কারণ সব ছবির পেছনে একটি কবিতার বোধ সক্রিয় থাকে- শিল্পীরা ক্যানভাসে রঙের অক্ষরে সেটি লিপিবদ্ধ করেন। রঙের হরফে লেখা সেই সৃষ্টিকে আমি ছবিতা বলিÑ তার ভেতরের মাধুর্যকে উপলব্ধির জন্য।

তার পেছনের কবিতাটি পড়ে ওঠার জন্য। রেখাচিত্র শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদের ছবির বই নয় রেখাচিত্রের বই। মোমিন উদ্দীন খালেদ আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন। তার রেখাচিত্রের ওপর লিখতে বসে আমার আরেক প্রিয় শিল্পী ধ্র“ব এষ-এর একটি ঘটনার কথা মনে এল। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেটির উল্লেখ করছি।

ধ্র“ব’র বাসায় ঐ গল্পটি অসাধারণ ভাষায় বলেছিলেন আমার আরেক প্রিয়ভাজন সাংবাদিক শওকত আলী তারা। মাঝে মধ্যে ধ্র“ব খেই ধরিয়ে দিচ্ছিল তার। দেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘পিপলি বেগম’ বইটির প্রচ্ছদ আঁকার জন্য প্রকাশক আলমগীর রহমান, হুমায়ূন আহমেদ এবং ধ্র“ব বসেছিলেন প্রতীক প্রকাশনীর অফিসে। সেই বৈঠকের হঠাৎই লেখক বললেন, ধ্র“বর হাতে ফিগার আসে কেমন, একটা পিপঁড়ার ছবি আঁকতে হবে- তাকে নিয়েই বইয়ের কাহিনী। হয়তো এসবই কথা প্রসঙ্গে কথা লেখকের।

কেননা আমরা জানি শিল্পী ধ্র“ব এষকে ‘প্রচণ্ড পছন্দ’ করেন হুমায়ূন আহমেদ এবং ধ্রুবও তাকে। আমার মনে হয় ‘ভালোবাসেন’ শব্দটিও ব্যবহার করতে পারি, প্রচণ্ড পছন্দের জায়গায়। যা হোক, কথাটা ধ্র“ব’র কাছে প্রতিভাত হল অন্যমাত্রায়। মনে মনে ধ্র“ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কোন ফিগারই ও আঁকবে না পিঁপড়ার- শিল্পীর জেদ যাকে বলে। ফিগার না এঁকে পিঁপড়া পিপলি বেগম-এর প্রচ্ছদ তৈরি হবেÑ কিভাবে? যারা পিপলি বেগম বইটি পড়েছেন তারা জানেন কিভাবে পিপলি বেগমকে মূর্ত করেছে ধ্র“ব এষ।

ধ্র“ব’র এই শিল্পিত জিদের গল্পটির অসাধারণ বর্ণনা যেন শওকত আলী তারা। আমি তাকেই বলেছি সেটি লিখতে। ধ্র“বকে নিয়ে লেখালেখির ভেতর সেটি পাওয়া যাবে কোন বই মেলায়। ফটোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে ধ্র“ব এঁকেছিল পিপলি বেগমের প্রচ্ছদ। শিল্পীরা তাদের উদ্ভাবনা মূলক পদ্ধতিতে বিভিন্ন মাধ্যমকে নানা মাত্রায় যে ব্যবহার করেন সেটাও একটা বিস্ময়।

বোধ করি, এইখানটিতেই স্রষ্টার সঙ্গে শিল্পীদের সাদৃশ্যের জায়গা। ধ্র“ব এষ কে আমি দেখেছি কাগজ কেটে বিষ্টি আঁকতে। তাই আমি প্রায়ই বলি, ধ্র“ব যদি কাগজও ছেঁড়ে সেটাও শিল্প। শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ নিজেকে ব্যক্ত করেছেন রেখার বর্ণমালায়। আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন মোমিন উদ্দীন খালেদ স্বল্পভাষী, তাঁর মুখে আমি কোনদিন কোন রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শুনিনি, এ বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ লক্ষ্য করিনিÑ পরমাণু পরিমাণওÑ প্রথাগত ছাত্র হিসেবে আর্ট কলেজ থেকে বের হয়া, শিল্পের জন্য শিল্প ঘরানার মানুষ ভাবাই তাকে সঙ্গত।

আমি অবশ্য শিল্পীর চেয়ে মানুষ হিসেবেই তাঁকে বেশি পছন্দ করি। প্রচণ্ড সংবেদনশীল একজন মানুষ। পরিচিত যে কারো দুর্যোগ-দুঃসময়ে-আনন্দেÑ তার সহকর্মীরা সর্বাগ্রে তাঁকে পানÑ না, কোন এ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে নন, সহমর্মী মানুষ হিসেবে। খুব কম শিল্পীর ভেতরই এই দুর্লভ গুণটি আছে। এই কথা গুলোকে ধানভানতে শিবের গীত মনে হতে পারে হঠাৎ পাঠে কিন্তু প্রাসঙ্গিক বোধেই লিখছি।

‘রেখাচিত্র’ প্রকাশের আগে শিল্পী আমাকে তার স্কেচ খাতা গুলো দিয়েছিলেন সেগুলো দেখে কিছু লেখার জন্য। আমি তার স্কেচ সম্ভার দেখে কেবল বিস্মিত হয়েছি। আর সেই স্কেচ গুলো দেখতে দেখতে আবিষ্কার করেছিÑ আগে শিল্পীকে আমি যে ভাবতাম রাজনৈতিক বোধ শূন্য সেই ধারণাটিই আমার ভুল। ‘জগতের সব কিছুর মানদণ্ড হচ্ছে মানুষ’ এবং ‘মানুষ হচ্ছে রাজনৈতিক জীব’- পুরাতন এই প্রবচন গুলোর যথার্থতা উপলব্ধি করেছি সেই খাতাগুলো দেখে, বিষয়টি তাঁকে বলায় স্বভাব সুলভ হাসি ছাড়া কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি তিনি। শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদও একজন রাজনীতি সচেতন শিল্পী তবে সে রাজনীতি ক্ষণকালের দলীয় বিবরের নয়, সে রাজনীতি মহাকালের মানুষের।

মানুষের বুকের গভীরের যে ক্ষোভ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সেগুলোও তার রেখায় বাঙময় হয়েছে শিল্পিত ভাবে। একজন শিল্পী যে কেবলই রেখার বর্ণমালায় নিজের বক্তব্য লিখতে পারেন তা এই রেখাচিত্রের বইটি পড়লে বোঝা যাবে। এদেশের প্রতিভাবান একটি শিল্পী প্রজšে§র ‘রবিনসন ক্রু’রা নিজের নিজের মত করে টিকে থাকার ভেতর দিয়ে বিস্ময়কর, চিত্তাকর্ষক বিষয়াবলী আমাদের সামনে হাজির করছে। আমরা তাদের সেই শিল্পযাত্রায় অভিভূত হয়ে অভিবাদন জানাই। শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদের রেখার বর্ণমালায় লেখা রেখাচিত্রের পরবর্তী বইয়ের প্রতীক্ষায় রইলাম।

এবারের বইমালায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এই বইটি প্রকাশ করার জন্য দিব্য প্রকাশকে জানাই ধন্যবাদ। রেখাচিত্র মোমিন উদ্দীন খালেদ। প্রকাশক : দিব্য প্রকাশক। পৃ: ৮০, মূল্য : ১২৫ টাকা। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।