আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাদের শহরে আমাদের গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ …

এই লেখাটি আম্বিয়া আপার জন্য... গত ৩৪ বছর ধরে যিনি নিরলস ভাবে ভিকারুননিসার জন্য কাজ করে গেছেন, যার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা নিয়ে কারও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তারপরও আজকে তাকে ‘‘মৌলবাদী” অপবাদ দেয়া হল। অপমান করা হল অন্যায় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন শিক্ষককে, একজন ভাল মানুষকে, একজন মাকে (তিনি আমাদের মায়ের মতই)। এভাবে আমরা আমাদের সেই প্রিয় আপাকে অপমানিত হতে দেখলাম যা কেউ কখনও ভাবিনি। কেন ছাত্রীরা জনাবা হোসনে আরা কে মানতে রাজি হলনা এটা এখন সবাই জানে।

কিন্তু সবাই কেন আম্বিয়া আপাকে চায়? হোসনে আরা পরিমল কে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। অভিযোগ পাবার পর সাত দিন পার হয়ে গেলেও তিনি পরিমলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি । কিন্তু শিক্ষক হিসেবে উনি আরও বেশি আমাদের শ্রদ্ধার অযোগ্য হয়ে গেলেন যখন আমাদের সাহসী বোন টির বিরুদ্ধে উল্টো আপত্তিকর কথা বলেন। তার ভাষায় আমাদের বোনটি ছেলেদের মত চলে...and “IT WOULD BE A MUTUAL SEX”… এই রকম কুরুচিপূর্ণ ইংগিত দেবার পর সব শিক্ষকরাই উত্তেজিত হয়ে উনাকে থামতে বলেন এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন উনাকে আর সহ্য করা হবেনা। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ভিকারুননিসায় অধ্যক্ষ হবার জন্য আম্বিয়া আপাই এখন একমাত্র যোগ্য বাক্তি।

সর্বোপরি বয়ঃজেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতেও উনিই নির্বাচিত হবেন। এখানে কোন রাজনৈতিক চাল ছিলনা। উনার নাম ঘোষণার পর ছাত্রীদের সে কি উল্লাস!!! নিজেরা চাঁদা তুলে কেক কেনে তাকে বরণ করবে বলে। এতদিনের চরম অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির আনন্দ। তাই বলে আমরা ভুলে যাইনি মিরসরাই এ দুর্ঘটনায় নিহত দের কথা।

আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি ওদের জন্য শোক পালন করা হয়, দোয়া পাঠও হয়। কিন্তু এখানেও নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢেলে দিয়েছেন রাজনীতির রং...এটা নাকি তৃতীয় শক্তির চাল। বারবার টিভি তে দেখানো হল তার একই প্রশ্ন “কেক কে পাঠাল?” সংবাদপত্রে আপাকে চিত্রিত করা হল বিএনপি-জামাত এর ধামাধরা লোকদের পদলোভী অনুসারী হিসেবে। তিনি কেমন করে ক্ষমতালোভী হবেন!!! নির্লোভ নির্মোহ মানুষটির অবসর এ যাবার কথা মাত্র তিন মাস পরেই। সবার অনুরোধ সত্তেও তিনি একদিনের জন্যও মেয়াদ বাড়াতে রাজি হন নি।

কেবল আমাদের মুখের দিকে চেয়েই উনি অধ্যক্ষ হবার জন্য সম্মতি দিলেন। ভয় তো ছিল ই ...পেনশন আটকে যাবার, সাসপেন্ড হবার। তারপর ও...শুধু আমাদের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন জানা গেল উপরমহল থেকে উনাকে মেনে নেয়া হবেনা (কারন পরিচালনা পর্ষদ এর যে ৫ জন সাক্ষর করেছেন তাদের একজন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব ছিলেন তাই বিএনপিপন্থিদের মনোনীত অধ্যক্ষ এই সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় )। তখন এই চিন্তাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায় যে আগে ভিকারুননিসাকে বাচাতে হবে।

আর চরম ত্যাগ স্বীকার করে অন্যদের সাথে তিনিও মঞ্জু আপার পক্ষে রায় দেন। “মৌলবাদী” র মিথ্যা কলংক মাথায় নিয়েই সরে দাড়ান... এই ত্যাগ শুধুই আমাদের জন্য। কলেজের প্রথম দিন তাকে দেখে বুক কাপেনি এমন মেয়ে পাওয়া কঠিন। উনি আমাদের কলেজের অঙ্কের শিক্ষক। চিরকাল একই রুপ এ দেখে এসেছি।

সাদামাটা ধর্মভীরু সহজ সরল একজন মানুষ। কিন্তু কি প্রচন্ড তার ব্যক্তিত্ব, কি সাহসী তার উচ্চারণ...দরকার পড়লে প্রিন্সিপাল আপাকেও ছেড়ে কথা বলেন না। কিন্তু তারপরও উনি আমাদের সবার ভালবাসা, শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। ক্লাস এ প্রথম দিন কিভাবে আমরা ডানা মেলে ক্লাস ফাকি দিব আপার সে অভিনয় তো আজো ভুলিনি। আমাদের ডিবেটিং ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব, এনভায়রনমেন্ট ক্লাব সবগুলো কো-কারিকুলার এর সাথেই তিনি সম্পৃক্তা।

উনি থাকা মানেই আমরা নিশ্চিন্ত যে সব কিছু একটা নিয়ম এর ভিতর থাকবে, টাকা পয়সার হিসাব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবেনা, উলটো কাজ এ দেরি হয়ে গেলে আপারা আমাদের সাথে থাকবেন। ভুল হলে বকা তো আছেই...কিন্তু তারপরও কেউ তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি। তার প্রজ্ঞা, স্পষ্টবাদিতা এমনকি কৌতুকস্পৃহা অন্যসব শিক্ষকদের থেকে তাকে আলাদা করেছে। মেধা আর মননের এক অপূর্ব মিশেল যাকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে... আপা ছোট বেলা থেকেই উনি ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নন। প্রচুর পড়াশোনা করেন এবং অন্যদের যুক্তিকেও সাদরে গ্রহণ করেন।

আমার একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধু যখন অন্য ধর্মের আরেকজনকে বিয়ে করে তার মা এই আম্বিয়া আপার কাছেই ফোন করে তার কথা শেয়ার করেছিলেন। কতটা উদারপন্থি ধার্মিক হলে এরকম ঘটে? অথচ এটাই এখন তার অপরাধ হয়ে গেল! হিজাব করাই যদি মৌলবাদীর লক্ষণ হয় তাহলে আমাদের পি.এম কেও মাথায় কাপড় দেয়ার জন্য মৌলবাদী বলব? আজ যখন কতিপয় লোক তার ধর্মভীরুতা কে পুজি করে পোষ্টার লাগিয়েছে সে জামাতপন্থি - সে কথা মুখ বুজে সহ্য করাও আরেকটি অন্যায়। বছর দুএক আগে যখন জামাত বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হয়েছিল , ভিকারুন নিসার থেকে প্রথম স্বাক্ষর টি ছিল আপার । মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যার প্রমান এখনও আছে। ধর্ম আর নোংরা রাজনীতির শিকার আমরা।

“হিযাব মানেই জামাতি”-টিপিকাল স্টেরিও টাইপ এর শিকার আম্বিয়া আপা। সব কিছুর শেষে যখন দেখা হল উনি আগের মতই স্থিতধী। মজা করে বললেন “ ১+আম্বিয়া=১-আম্বিয়া। কাজেই আম্বিয়া কিছুই না ০। কিন্তু ভিকারুননিসা বেচে গেল...যারা আমাকে মৌলবাদী বলেছেন তাদের জন্য আল্লার কাছে বলি ওদের জন্য সবকিছু সহজ করে দাও...”।

নিজের অপমান ভুলে সতীর্থদের ধন্যবাদ দিলেন। মঞ্জু আপাকে চেয়ার এ বসালেন। সব হয়ত আবার আগের মত হবে...আমরা ফিরে পাব আগের পরিবেশ...এই স্বপ্নের সারথি হয়ে মাথা পেতে নিলেন অন্যদের সব অভিযোগ। হয়ত বাড়ি ফিরে গল্প করবেন অসুস্থ আঙ্কেল এর সাথে...প্রতিবন্ধি ছেলের সাথে (উনার একমাত্র ছেলেটি কিন্তু দত্তক সন্তান) (শেষের লাইন টি লিখতে চাইনি একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় বলে...কিন্তু না বলেও থাকতে পারলাম না) ভিকারুন নিসা প্রতিষ্ঠান টির দিকে সবার বরাবরই নজর। কোচিং , ভর্তি বাণিজ্য , জমি দখল এরকম নানা ঝামেলা লেগেই আছে।

সাথে এখন নতুন ইস্যু। গভর্নিং বডির সদস্য হতে পারলেই কোটিপতি...তাদের আখের গোছাতে, তাদের স্বার্থ সিদ্ধি তে, তাদের লোভের আগুনে আমরা পুড়েছি এতদিন। সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরাই...প্রতিবাদ করতে হয়েছে আমাদের ই...আমাদের অধিকার আমাদেরই আদায় করতে হয়েছে। আর উত্তাল সেই দিন গুলিতে সবসময় কাছে পেয়েছি আমাদের দুইজন অসাধারণ মানুষ কে। আম্বিয়া আপা আর রোকসানা আপা।

আমাদের জাহাজের দুই কাণ্ডারি...মানুষ যত যাই বলুক...আমরা এই সহজ সত্যটা জানি...... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.