আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুমেরাং

তোমারে যা দিয়েছিনু-সে তোমারি দান,গ্রহণ করেছ যত-ঋণী তত করেছ আমায় আলট্রাসোনগ্রাফিতে যখন থেকেই ধরা পড়ল যে তার যমজ দুটি ছেলে হতে যাচ্ছে, তখন থেকেই মুরাদের মাথা ঠিক নেই। এই আনন্দ লাগে এই ভয় লাগে। স্ত্রী বীণাকে সে বলে বোঝাতে পারবে না যে, তার উপর সে কতোখানি কৃতজ্ঞ। মুরাদরা চার বোন,এক ভাই। সবারই খুব ভাল জায়গায় বিয়ে হয়েছে।

কিন্তু মাত্র একটা বোনের ঘরেই একটা ছেলে আছে। তাই স্বভাবতই মুরাদের জোড়া ছেলে অনেকটা চাঁদের হাট-এর মতন। বীণা অবশ্য স্পষ্ট বলে দিয়েছে, এই সুসংবাদ কাওকেই বলা যাবে না। নজর লাগতে পারে। আর তাছাড়া আত্মীয় স্বজনরা উপহার নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেবে।

উপহারের নামে বীণার এসব টাকার ছড়াছড়ি খুব অসহ্য। যদিও বলে খুব একটা লাভ হয়নি। মুরাদ ইতিমধ্যে যেসব কাণ্ড কারখানা শুরু করে দিয়েছে, তাতে মোটামুটি সবাই বুঝে গেছে যে, তার ছেলে হতে যাচ্ছে। একদিন বীণা মুরাদের ড্রয়ারে একটা কাগজ পেল। সেখানে লেখা-- আমি ছেলের দুই ছেলের বাবা হতে চলেছি।

আমার করনীয়ঃ (১) টিভিতে দেখেছি ছেলে হলে সব নীল রঙের হয়। তাই অন্তত আমার পুরো ঘরটা নীল রং করার জন্য বাড়িওয়ালাকে বলা। (২) না করলে প্রয়োজনে বাড়ি পরিবর্তন, ইতিমধ্যে দু এক জায়গা দেখেছি। তবে এবার এসব ওলি গলি তে থাকবো না। অভিজাত গুলশান,বনানি,ধানমণ্ডি নয়তো বারিধারা।

ছেলেরা জন্মাবার সাথে সাথেই যেন আশে পাশের বস্তি না দেখে। (৩) আমার বংশে জোড়া বাতি জ্বালাবার জন্য বীণাকে সোনার দুটি বালা দিব। (৪) ব্যবসাটার দিকে খুব মনোযোগ দিতে হবে। মুদি দোকানটায় ফোন করা যায়, মোবাইলে টাকা ভরা যায় এই অপশন তাও রাখতে হবে। আরও কি কি করা যায়, কিভাবে রোজগার বাড়ানো যায় ভাবতে হবে।

কয়েক জনের সাথে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে। (৫) ছেলেদের কোন অভাব অপূর্ণ রাখব না। একটাকে ডাক্তার একটাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাব, ইনশাল্লাহ। মুরাদের এসব পাগলামি বীণা এড়িয়ে যায়। মিটে মিটে হাসে।

এপ্রিলের তিন তারিখে দু মিনিট অন্তরে বীণা-মুরাদের যমজ ছেলে হয়। নাম রাখে রতন আর মানিক। অবশ্য তারা সত্যি সত্যি পুরনো ঘরে ফিরে আসেনি। মুরাদ ধানমণ্ডিতে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। পুরানো বাসা ভাড়ার চেয়ে তা প্রায় দ্বিগুণ! মুরাদ নিজের ব্যবসাটাকে পুরো দাঁড় করে ফেলেছে এ কয়েক মাসে।

একেই বলে পুত্র ভাগ্য! ছেলেরা যতোই বড় হয়, মুরাদের ব্যবসাও ততই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। মাঝে মাঝে দেশের বাইরেও যেতে হয় ব্যবসার কাজে। তার অনেক বড় ব্যবসা এখন। মুদি দোকান এখন আর নাই। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসা।

অনেক অনেক ব্যস্ততা। দিন রাত খাটা খাটুনি। অনেক সময় পেরিয়ে যায়। ছেলেরা খুব সুন্দর ভাবে বড় হতে থাকে। কোন কিছুর কমতি থাকে না।

শুধু মুরাদের ব্যস্ততা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বীণা মাঝে মাঝে বলে, ‘’ আর কত টাকা লাগবে তোমার। আমরা তো অনেক ভালো আছি। দৌড়াদৌড়ি একটু কমাও। ‘’ ‘’কমাবো।

আমার রতন আর মানিকের জন্য দুইটা বাড়ি করে, যাও আমি অবসর নিব। এর পর তোমারে নিয়া হজ্জ করব আর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াব। সামনের চালানটা শুধু হইয়া যাক। শুধু একটু দোয়া কর তুমি। ‘’ ‘’হুম।

ও আচ্ছা, শোন, রতন-মানিকের ভর্তির কিছু ভাবচ? রতন তো ঢাকা মেডিক্যালে টিকলো, কিন্তু সোহাগ তো সরকারী কিছুতে চান্স পেল না। ‘’ ‘’কি যে কও না, তুমি! টাকা বানাইচি কি পানিতে ফেলার জন্য? সরকারীতে হয় নাই, তো প্রাইভেটে পড়বে। কোন সমস্যা নাই। প্রয়োজনে দুইটারেই বিদেশে পড়াব! তবুও আমার স্বপ্ন পূর্ণ করে ছাড়বো। একটারে ডাক্তার একটারে ইঞ্জিনিয়ার বানাব!’’ রতন-মানিক যমজ বলে নয়, দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব ভাব।

সব কিছু দুজন দুজনের সাথে শেয়ার করে। অবশেষে বাবার ইচ্ছা মতে একজন মেডিক্যাল, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হল। প্রথম বছর টা তাদের দুজনেরই চমৎকার কাটল। তাদের দুজনের নামে পৃথক দুটি বাড়ি বানাচ্ছে তাদের বাবা। কাজ প্রায় শেষের পথে।

মুরাদের বড় চালান টা সাফল্যের সাথে পরিচালনা হচ্ছে। রতন প্রায় ই রাত করে বাড়ি ফিরছে। ডাক্তারিতে অনেক পড়া, অনেক চাপ। বীণা কিংবা মুরাদ কেও ই গভীর রাতে দরজা খুলে দিতে পারে না। ভাই মানিক ই দরজা খুলে দেয়।

প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে বলে মানিকের প্রায়ই, বেশ ঘন ঘন মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। বীণা তার ছেলেদের একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। একটু ছন্দহীন,একটু রুক্ষ যেন! শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বাড়িতেও থাকছে না আর আগের মত। কি হল তার রতন-মানিক এর!! বাড়ির কাজ পুরো শেষ।

ছেলেদের পড়া শেষ হলে মুরাদ উপহার স্বরূপ তাদেরকে বাড়ির দলিল বুঝিয়ে দেবে। আর মাত্র কয়েকটা বছরই তো! কিন্তু বীণা বলছিল, ছেলেদের রেজাল্ট নাকি ইদানিং ভালো যাচ্ছে না! কেন? কোন অপূর্ণতা তো রাখে নাই সে! একটু ব্যাপারটা দেখা উচিত। রতনের মেডিক্যালে খবর নিয়ে দেখল, সে ফার্স্ট প্রফ টাই দেয় নাই, উপরন্তু রতনের বাবা শুনে কেও তার সাথে কথাই বলতে চাইল না! কিন্তু কেন? মানিকের ভার্সিটিতে গিয়ে খবর পেল, ঠিক মতো টাকা পরিশোধ করেনি দেখে তাকে গত দুটো সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি। মুরাদের মাথা ঘুরতে থাকে! বুক ফেটে যাচ্ছে! কি শুনছে সে? কিন্তু কেন? মুড অফ থাকলে সে একটা জায়গায় যায়। খুব গোপন।

তার ব্যবসায়ীক বন্ধুরাই যায় সেখানে। আজ সেখানে গিয়ে একটা ছোট জটলা দেখে। ‘’কি হইচে, হান্নান?’’ পরিচিত ডিলার কে মুরাদ জিজ্ঞেস করে। ‘’ওস্তাদ, আর কইয়েন না, দুই ভাই আসচে। মারামারি করতেছে।

বাকীতে মাল চায়! তার মধ্যে একজন রক্ত বমি কইরা ভাসাই ফেলচে এখানে! কন তো কেমন লাগে! কেমনে যে পারে সব একসাথে নিতে! কতবার কইলাম, খাইলে একটা খা। হেরা দুই ভাই সবই খায়। গাজা, ফেঞ্চি, ইয়াবা, হিরোইন! আর বাঁচব না ওস্তাদ! শেষ পর্যায়ে গেচে গা! কার ঘরের যে এরা? হুনছি, বলে বিরাট শিক্ষিত আচিল!! দূর আমগো কি? আমগো দরকার টাকা। হেরা মরুক গা !! কি কন? ’’ মুরাদ বুকে হাত দিয়ে, কাঁপা কাঁপা পায়ে ভিড় ঠেলে যায়। তার রতন-মানিককে দেখে সে! ওরা চিনতে পারে না ঠিক! বার বার ‘’মাল দে’’ বলে চেঁচিয়ে উঠছে !! হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

মাত্রাতিক্ত এবং ক্রমাগত মাদক সেবনের ফলে সাত দিনের মাথায় ই রতন-মানিক মারা যায়। কি আশ্চর্য! ঠিক জন্মের মতোই তারা দুমিনিট আগে পরে মারা যায়। মুরাদের কান্না আসে না ! পুত্র-শোক তার ঠিক শোভাও পায় না! এরকম হাজারো, লক্ষ্য বাবা তাদের ছেলে, মেয়ে, বন্ধু-পরিজন হারিয়েছে তার ব্যবসার গুনে! নিভেছে হাজারো বংশ প্রদীপ, তছনছ হয়েছে হাজারো ঘর- ভালোবাসা। এরকম তাজা প্রাণ, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হাজারো নক্ষত্রের পতন হয়েছে তার ছড়ানো ছিটানো মাদকে। সে তো তখন এতটুকু ভাবেনি, কাঁদেনি, বুঝেনি তাদের আর্তনাদ।

সে তো শুধু ধ্বংস করেছে। তাই নিজের ধ্বংসস্তূপে বসে আজ মুরাদের কান্না, শোক, মাতম শোভা পায় না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।