আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন, স্বামী বিবেকানন্দ ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ কাশ্মীর উপত্যকায় শীত এখনও যাই-যাই করে যায়নি। ঝিলাম নদীর দু’পাড়ে ছড়ানো শ্রীনগর শহরটি ধূসর কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে আছে । নিস্তব্দ ও নিঝুম ঝিলাম নদীটিও ঢেকে আছে হালকা কুয়াশায় ।

রংশূন্য আকাশের নীচে নদীপাড়ে দীর্ঘ ঋজু দেবদারু গাছের সারি । সে সব গাছের ডালে ডালে শীতার্ত কাকপাখিরাও সব নীরব ও নিথর । শিশিরে ভেজা দেবদারুর পাতাগুলিও স্থির । টপটপ টপটপ করে সে শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ে ঝিলাম নদীর জলে। তাতে মৃদু শব্দ ওঠে, তারপর বৃত্তাকার তরঙ্গ ছড়িয়ে যায় জলে ।

মাছেরা কেবল সে তরঙ্গের বিস্তার টের পায়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এক ভোর । হালকা কুয়াশায় ঢাকা নির্জন ঝিলাম নদীর ঘাটে একখানি নৌকা দেখা যায়। সে নৌকায় কালো রঙের চাদরে মুড়ি দিয়ে বসে আছে একজন মাঝবয়েসি মাঝি ।

স্পষ্টই বোঝা যায় যে মাঝিটি যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছে। মাঝির মুখ ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় একটি সাদা রঙের উলের টুপি। মাঝির কোলে একটি সাত/আট বছর মেয়ে চুপ করে বসে আছে। মেয়েটির ছোট্ট শরীরে একখানি ধূসর রঙের ময়লা চাদর জড়ানো ।

মাথায় বেগুনি রঙের উলের টুপি। নদী পাড়ের কুয়াশার ভিতর যেন পাশাপাশি দুটি আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যায় । মাঝিটি সে দিকে তাকাল। হাতে বৈঠা তুলে নেয় মাঝি । একটু পরেই দু’জন তরুণ সন্ন্যাসী কে দেখা যায়।

তারা ঘাটে নেমে নৌকার গলুইয়ের খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। সন্ন্যাসীদের পরনে হলুদ রঙের গেরুয়া বসন; মাথায় হলুদ পাগড়ী। ... মাঝির জানার কথা নয়- এ দু’জন তরুণ সন্ন্যাসী বাঙালি । এদের একজন স্বামী বিবেকানন্দ, বয়স ৩৫; অন্যজন স্বামী অক্ষদানন্দ। ইনি বয়েসে স্বামী বিবেকানন্দর চেয়ে বছরখানেক ছোটই হবেন।

এরা দু’জনই ভারতবর্ষ সফর করছেন। বেদান্ত দর্শন অধ্যয়নের পাশাপাশি মানবীয় অভিজ্ঞতার ঝুলিটি পূর্ণ করে নিচ্ছেন। এদের দুজনের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ কে মুখখানি ভাবগম্ভীর এবং দৃষ্টি অর্ধ-মুদিত ; সে কারণে তাঁকে কিছুটা অর্ন্তমুখীই মনে হয়; সেই তুলনায় স্বামী অক্ষদানন্দ যেন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত আর জড়তামুক্ত ...বাঙালি সন্ন্যাসী দু’জন বেশ কিছুকাল হল কাশ্মীরে অবস্থান করছেন। তাঁরা মেধাবী বলেই এরই মধ্যে স্থানীয় ভাষাটি মোটামুটি রপ্তও করে ফেলেছেন ... স্বামী অক্ষদানন্দ মৃদু হেসে সুমধুর কন্ঠে স্থানীয় ভাষায় মাঝিকে বললেন, আমাদের পাড় করে দাও গো মাঝি। নৌকায় উঠে আসুন হজুর।

মাঝিটি হেসে বলল। ভিনদেশির মুখে মায়ের ভাষা শুনে কার না ভালো লাগে! তাছাড়া গরীব মাঝি সে। তার উপর তার মাতৃভূমিটি দীর্ঘদিন হল ইংরেজরা দখল করে রেখেছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রায়শ উদ্বিগ্ন থাকে সে। এই ভোরে দু’জন তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে মাঝির মনের উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।

সন্ন্যাসী দু’জন ধীর প্রসন্ন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এলেন। মুহূর্তেই নৌকায় রজনীগন্ধার মৃদু সৌরভ যেন ছড়িয়ে পড়ল। গভীর শ্বাস ফেলে নৌকার দড়ি খুলে নদীর শীতল জলে বৈঠা নামায় মাঝি । মাঝির কোলে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটি দুজন যাত্রীর দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে। স্বামী অক্ষদানন্দ মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি নাম হে তোমার ? আমার নাম ইব্রাহীম হজুর ।

বৈঠা বাইতে বাইতে মাঝি বলল। মৃদু ছলাত শব্দ শোনা যায়। সেকালে ঝিলাম নদীর গন্ধ আজকের দিনের মতো আঁষটে হয়ে ওঠেনি সম্ভবত। আর এইটে বুঝি তোমার মেয়ে? ইব্রাহীম মাঝি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হজুর । ও আমার মেয়ে।

ওর তো মা নেই, তাই হজুর সারাদিন ও আমার সঙ্গেই থাকে। অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্বামী বিবেকানন্দ। আহ্, এই অনাথ বালিকাটির তার মাকে দেখতে পায় না। সেই দেখতে না- পাওয়ার গভীর শূন্যতা অনুভব করলেন তিনি। জগতে জীবের এই কষ্ট ... ভাবতেই সমগ্র জগতের জীবের কষ্ট যেন মুহূর্তে অনুভব করলেন ওই তরুণ যোগী।

তারপর মুহূর্তেই সচেতন হয়ে উঠলেন। ইব্রাহীম মাঝির দিকে তাকিয়ে জলদ মধুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কি নাম ওর? এতক্ষণে তরুণ মুসাফিরের ভরাট কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহীম মাঝি মুগ্ধ হয়ে গেল । মুসাফিরের ভরাট মুখটি কেমন নূরানি। সে নূরানি মুখে বড় বড় দুটি স্পষ্ট আয়ত চোখ। তরুণ মুছাফির যে সামান্য লোক নয়- মস্ত বড় কামেল দরবেশ, সেটি ইব্রাহীম মাঝি তার নির্মল হৃদয়ের বিবেচনায় ঠিকই উপলব্দি করতে পারে ।

আর, তরুণ দরবেশ শীতে মোটেও কাহিল নয় দেখেও বিস্মিত হল সে । ইব্রাহীম মাঝি ভক্তিভরে বলল, ওর নাম সাবিহা হজুর। সাবিহা? বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো । বলে গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন আয়ত চোখে সাবিহার মুখখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন স্বামী বিবেকানন্দ। সাবিহার ফরসা মুখটি ঈষৎ লম্বাটে।

গালে হালকা লালের ছোঁয়া। বেগুনি রঙের উলের টুপি ছাপিয়ে সোনালি রঙের কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে পড়েছে। সাবিহার চোখ দুটি বড় বড়; ভারি নিষ্পাপ আর নীলাভ । মুখটি যেন এর আগে কোথাও দেখেছি .... হাজার বছর আগে যেন ... যখন বিগত জন্মে বেঁচে ছিলাম সুপ্রাচীন শ্রাবস্তী নগরে ... তার রোদজলের ভিতর ... তার বৃষ্টির ভিতর ... তার অন্ধকারের ভিতর ... রূপশালী অন্নের ভিতর ... অশ্বক্ষুরধ্বণির ভিতর ... গোধূমের গন্ধের ভিতর ... দেবালয়েরর আবছায়ার ভিতর ... ধূপের গন্ধের ভিতর ... সন্ধ্যালগ্নে ... তখন ... তখন এই কুমারী বালিকাটি কি আমায় স্নেহময়ী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি? আশ্বিনের ভোরে আমাকে কি নদীপাড়ের উদ্যান থেকে একখানি জবা ফুল ছিঁড়ে দেয়নি পূজার উদ্দেশ্যে? সহসা তরুণ সন্ন্যাসীর কেমন ঘোর লাগে। তিনি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকেন।

তাঁর ভরাট গম্ভীর মুখে ফুঠে উঠতে থাকে প্রবল ভক্তির চিহ্ন । তিনি হাত জোড় করে সাবিহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। যেন কোনও মাতৃসমা মহাদেবীকে প্রণাম করছেন এক নতজানু ভক্ত। ওই দিব্য দৃশ্যটি দেখে স্বামী অক্ষদানন্দ প্রগাঢ় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এতকাল একসঙ্গে রয়েছি, কই, এর আগে এ রকম তো কিছু চোখে পড়েনি।

স্বামী অক্ষদানন্দ মনে মনে ভাবলেন । ইব্রাহীম মাঝিও কম বিস্মিত হয়নি। তরুণ দরবেশ তার কন্যা সাবিহাকে প্রণাম করছে বলে তার হৃদয়ে সে গভীর এক আনন্দের অনুভূতি টের পায় । এই মা মরা মেয়েটিই ইব্রাহীম মাঝির সব। আল্লাহ যেন মেয়েটির উপর অশেষ রহমত বর্ষন করেন- নামাজ আদায় করে এই দোয়াই সে করে ।

ইব্রাহীম মাঝির চোখের কোণটি জলে ভিজে উঠে। কুমারী সাবিহার প্রতি প্রণামের ভঙ্গিতে আচ্ছন্ন ও স্থির হয়ে রইলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সম্পূর্ন আত্ববিস্মৃত হয়ে কুমারী সাবিহাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতে থাকেন । সহসা তরুণ যোগীর কন্ঠ থেকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হয় : সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তন্বং কৃণুষে দৃশে কম্ ... স্বামী অক্ষদানন্দ জানেন শ্লোকটি ঋগ্বেদের ১/১২৩/১১ নং সূক্ত। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়: ... যেন মায়ের নিজের হাতে সাজিয়ে দেওয়া সুরূপা কন্যাটি মানুষের দৃষ্টি সামনে নিজের তনু প্রকাশ করছে।

নৌকার বাতাসে রজনীগন্ধার সৌরভ ঘন হয়ে উঠতে থাকে । আর সময় যেন থমকে গেছে - এরকমই বোধ হয় স্বামী অক্ষদানন্দের । তাঁর চোখের কোণে চিকচিক করছে দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু । জাতপাতের ভেদাভেদ সম্বন্ধে আজ তাঁর এক পরম অভিজ্ঞান হল: যা তাঁর ভবিষ্যতের দীর্ঘ মানবিক ও কল্যাণকর যাত্রাপথে দান করবে গভীর প্রত্যয় । এই শীত শেষের ভোরে ঝিলাম নদীর জল নিস্তরঙ্গ হয়ে রয়েছে।

সেই তরঙ্গশূন্য জলে মনের আনন্দে বৈঠা বায় ইব্রাহীম মাঝি । নৌকায় একজন নিষ্পাপ কাশ্মিরী কুমারী বালিকার উদ্দেশ্যে মাতৃজ্ঞানে অর্চনারত এক বাঙালি যোগী গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ... যখন নদী ও নদীপাড়ের হালকা কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছিল অনাবিল সূর্যের আলো ... উৎসর্গ: কবি শিরীষ এবং নষ্টকবি ... তথ্যসূত্র: (১) ড. আর. এম দেবনাথ তাঁর ‘সিন্দু থেকে হিন্দু’ বইতে লিখেছেন: “রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে একটি সাত-আট বছরের মুসলমান মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন। (কৃষ্ণ কুমার দাস:প্রবন্ধ: কুমারী যখন দেবী: সংবাদ প্রতিদিন: কলকাতা: ২৬.৯.৯৮)। এই নিষ্পাপ ও পবিত্র মেয়েটি ছিল মাঝির কন্যা। ” (পৃষ্ঠা, ৯০) (২) সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তন্বং কৃণুষে দৃশে কম্ ... ঋগ্বেদের এই মন্ত্রটি (১/১২৩/১১) রয়েছে সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’ (পৃষ্ঠা ২৫) বইতে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.