আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নায়কের মৃত্যু

সত্যবাদী আলম ভাই নিজের ক্যাডার পরিচয়ে বেশ গর্ব অনুভব করেন। সরকারী দলের ক্যাডার বলে সবাই একটু মান্য গন্য করে। আমার আব্বা আলম ভাইয়ের দুঃসম্পর্কের মামা হন। পারতপক্ষে তিনি আব্বুর সামনে পড়তে চান না। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আমি।

আমাকে তিনি তার জীবনের বিভিন্ন রোমহর্ষক ঘটনাবলী বর্ননা করেন এবং সময় পেলেই তিনি আব্বুর এক নলা বেলজিয়াম বন্দুকটা পরিস্কার করতে বসে যান। পরম মমতায় তিনি বন্দুকের বাঁটে তেল মাখান; নলের জং সরান; ফায়ারিং পিন আলাদা করেন। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তার কাজকর্ম দেখি। আব্বু আলম ভাইকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু মা মড়া ভাগিনাকে কড়া কিছু বলতে মনে হয় তার বাঁধত।

তবে তার আসে পাশে আমাকে ঘুর ঘুর করতে দেখলে অবধারিত ভাবে কিছু তিরস্কার জুটত। ওসবের আমি থোরাই তোয়াক্কা করতাম। আলম ভাই আমার চোখে গল্পের বই থেকে উঠে আসা মাসুদ রানার চরিত্রের মত। বন্দুক পরিষ্কার পর্ব শেষে আব্বুর কাছে আলম ভাই বেশ ভদ্র ছেলের মত গিয়ে বলতেন; মামা, একটা গুলি ফুটান দরকার; জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাবে। আব্বু বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাখি মারার ছড়রা কার্তুজ বের করে দিত আলমারি থেকে।

আমি আলম ভাইয়ের পেছন পেছন ছাঁদে যেতাম; উনার মুখ থাকত একাগ্র। -যেমনে শিখাইছিলাম, অমনে লোড কর! আমি কাপা কাপা হাতে লোড করতাম। আলম ভাই পেছন থেকে আমার কাঁধে বন্দুকের বাটটা সেট করে দিতেন। -বেশি ধাক্কা দিবনা, হালকা গুলি। ভয় পাইস না।

নল উঁচু করতাম নীল আকাশের দিকে। -সাব্বাশ বেটা, সেফটি ক্যাচ নামা। সেফটি ক্যাচ নামিয়ে ট্রিগারে আলতো করে আঙুল ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতাম। আলম ভাই ছিঃনেমার নায়কের মত কঠিন মুখভঙ্গি করে বলতেন, -ফায়ার!!!! গুলি বের হবার সাথে সাথেই আমার পিঠ চাপড়ে বলে উঠতেন, তরে আমি টাইগার বানামু। আমি মনে মনে পুলকিত বোধ করতাম।

আলম ভাইয়ের মত একটা রোমাঞ্চকর জীবন যদি পাওয়া যায়! একদিন আলম ভাইয়ের পায়ের একটা ক্ষত দেখে বেশ কৌতূহল হয়েছিল। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তিনি হাসলেন। -এইটা হইতেসে গুলির দাগ। গুলিডা পায়ের লগে ঠেকাইয়া করছিল! ভাগ্য ভালো হাড্ডিতে লাগে নাই। ঐ অবস্থায় দৌড়াইয়া পার্টি অফিসে আইছিলাম।

বাবু ভাই(ছদ্ম নাম) চিকিৎসা করাইলো। আমারে বাবু ভাই খুব আদর করে। আলম ভাইয়ের কাছে বাবু ভাই পিতৃতুল্য। বাবু ভাইয়ের প্রশংসায় উনাকে পঞ্চমুখ দেখতাম। বাবু ভাইকে তার সাম্রাজ্য সামলাবার জন্য আলম ভাইদের দরকার পড়তই।

আম্মু আলম ভাইকে মাঝে মাঝে মৃদু গালমন্দ করতেন। পড়ালেখা বাদ দিয়া এইসব গুণ্ডামি করলে জীবনে কিছু করতে পারবিনা। তা আলম ভাই সেইসব থোড়াই পাত্তা দিতেন। তার হাত তখন নিশপিশ করছে নতুন আমদানি হওয়া রকেট লাঞ্চার দিয়া একটা রকেট মারার জন্যে। আমি আলম ভাইকে জিজ্ঞ্যেস করলাম, ঐ গুলাতো যুদ্ধে ইউস করে; আপনারা কোন দেশে যুদ্ধ করতে যাইতেসেন? আলম ভাই দার্শনিকের মত মুখটা গম্ভীর করলেন, -তুই কি বুঝবি? বাবু ভাইয়েরে লাইফ থ্রেট দিসে! ঐ গুলারে এইবার উড়াইয়া দিমু! র‍্যম্বো তে দেখেছিলাম অবশ্য; কিন্তু বাস্তবে! আলম ভাইকে আমার মনে হল মূর্তিমান সিল্ভ্যাস্টার স্ট্যলোন! আমি উত্তেজিত, হাত পা একটু একটু কাঁপছে।

-আমারে দেখাইবেন একটু। -ঐসব পিচ্চি পুলাপানের জিনিস না। বড় হ আগে। তরে তো টাইগার বানামু কইছি না! আমি আফসোসে মরে গেলাম, কবে যে বড় হব! অবশ্য আমাদের সিল্ভ্যাস্টার স্ট্যলোন কে একেবারে প্রথম পাতায় দেখা গেল কোন এক ভোরের “ভোরের কাগজে”। কোমড়ে দড়ি বাধা, ক্যপশনে লেখা, অস্ত্র সহ সরকারী দলের সন্ত্রাসী গ্রেফতার।

আব্বু আম্মুকে ডেকে বলল, অস্ত্র মামলায় ধরা খাইসে, সহজে বাইর হইতে পারবেনা। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। আলম ভাইয়ের চেহারাটা আর তেমন নায়কোচিত লাগছে না। কেমন যেন কাঁচুমাচু হয়ে আছে ছবিতে। পিতৃতুল্য বাবু ভাই চোখ উল্টালেন।

এইগুলা সব বিরোধী দলের চক্রান্ত বলে বিবৃতি আসলো খবরের কাগজে। আমরা ভাবলাম আলম ভাইয়ের চ্যপ্টার ক্লোজ হয়ে গেল। কিন্তু কাহিনী তখনও বেশ বাকি। দু’মাসের মাথায় আলম ভাই বাসায় আসলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাচলাম, আমার নায়করে লোহার কারাগার আটকিয়ে রাখতে পারে নাই।

খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশ আসাদুজ্জামান নূর ভাব এসেছে। আব্বুকে সালাম করে বললেন, বাবু ভাই ফিটিং কইরা ছাড়াইয়া আনছে মামা। ফেরেশতার মত মানুষ। আব্বু মুখ শক্ত করে বললেন, এই বাসায় আর কখনও আসবিনা। আলম ভাই মাথা নিচু করে বসে থাকলেন।

আম্মু খাবার বেড়ে আমাকে আর আলম ভাইকে খেতে ডাকল। আলম ভাই খেতে বসলেন -তোর মামা বাসায় না থাকলে আসিস, সমস্যা নাই। -জী মামী -এইসব বাদ দে। -জী মামী -বিয়া কর, একটা ব্যবসাপাতি কর। -কি যে কন মামী, এখন বিয়া করুম কি।

বাবু ভাইরে নেক্সট ইলেকশনে জিতাইয়া তারপর। -চুপ থাক বেয়াদ্দপ! -জী মামী তা আলম ভাই আম্মুর সম্মানেই বোধ হয় বিয়ে করবার জন্য একজনকে খুঁজতে লেগে গেলেন। এবং সত্যি সত্যি একদিন শ্যামলা একজন মায়াবতীকে নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। এটা সেটা কথা বার্তার পরে আম্মুকে ডেকে আলম ভাই বললেন, মামী, বিয়া করতে বলছিলেন না; এরেই বিয়া করবো! তা ঐ সময়টায় মুরুব্বীদের কাছে প্রেম বিষয়ক ব্যপার সেপার সরাসরি এইভাবে বলাটা বেশ বেয়াদবি ছিল! আলম ভাই অবশ্য ডাইরেক্ট একশনে বিশ্বাসী। আম্মু কিছুক্ষণ ভেবে বলল আচ্ছা ঠিক আছে, তবে ঐ মেয়েটার সাথে আমি একা কিছুক্ষণ কথা বলব।

তা আম্মু সেদিন কি বলেছিল তা আমি জানিনা। কিন্তু ঐ রুদ্ধদ্বার মিটিঙের কারণেই সম্ভবত আমি আমার সিল্ভ্যাস্টার স্ট্যলোনকে হারালাম! আমার স্বপ্ন সব গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি ভেজিটেবলের মত ঘর বাঁধলেন গাজীপুরে। রেন্ট-এ-কারের ব্যাবসা খুললেন জমিয়ে। এই আলম ভাইকে আমার অসহ্য লাগল। বাবু ভাইয়ের উপরেও রাগ লাগল, আলম ভাইয়ের মত একটা রত্নকে একটা মেয়ে এইভাবে নষ্ট করে ফেলল আর উনি কিছুই বললেন না কেন? আলম ভাইকে জিগ্যেস কড়ায় তিনি বললেন, বাবু ভাই ফেরেশতার মত মানুষ, আমারে ছাড়া উনার অনেক কষ্ট হবে কিন্তু আমি নতুন বিয়া করছি দেইখা উনি বেশি কিছু বলেন নাই।

তা এরপর থেকে আমি আলম ভাইয়ের উপর থেকে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু আব্বু আম্মু দেখলাম মহা খুশি। একজন নায়কের পতনে এত খুশি হবার কি আছে, আজীব!!! বিঃদ্রঃ সকল চরিত্র কাল্পনিক, (আমি, আলম ভাই, ভাবি, আব্বু এবং আম্মু ছাড়া ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।