আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সন্দেহ

নিশীথ রাতের বাদল ধারা সন্দেহ “মেজাজ আঁর এইচ্চা খারাপ, কিয়া আর কইতাম। জীবনডা এক্কেরে তিতা বানাইলাইছে হিতি। অ’ন আঁর বাচি থাকনেরো ইচ্ছা ন করের। গাঁড়িডা লই একখান টেরাকের নিচত ফইরলে শান্তি লাইগতো—এক্কেরে আল্লার কাছে যাইতাম গই। আঁই সারাদিন চিনজি লই এত খ্যাপ কিল্লাই মারি, কিল্লাই টেহা রোজগার করিয়ের, কিল্লাই এইচ্চা ঠাডা গরমের ভিত্তে রক্ত হানি করিয়ের—হিতির লাইয়িতো।

হিতি তো বাইচ্চা ন, ন বুজের ন, ব্যা’ক বুজি কিল্লাই হিতি এইচ্ছা কইরলো কনছেন ছাই। “ জাহাঙ্গীর মিয়া গামছায় মুখ মুছে আমার দিকে তাকাল। কি বলব তাকে ভেবে পেলাম না। রিটায়ার করার পর প্রায় প্রতিদিন বিকালে পাড়ার মোড়ের এই চায়ের দোকানে কিছুক্ষন বসি। ঢাকার একপ্রান্তে এই শহরতলীতে এখনো মফস্বলী ছোঁয়া—মানুষ ও জীবন কোনটাই অতটা যান্ত্রিক হয়ে যায়নি।

জাহাঙ্গীর মিয়াও আসে চা খেতে এই সময়ে। সেভাবেই দেখা। দেশের সাম্প্রতিক সব বিষয়ে তার ইনসাইট আমাকে হতবাক করে দেয়। নিয়ম করে ও খবরের কাগজ পড়ে রোজ। তাই বৈকালিক আড্ডার সাথি হিসাবে ওর সঙ্গ ভালই লাগে আমার।

আজকে তার এই আকস্মিক আবেগের বহির্প্রকাশ আমাকেও খানিকটা বিচলিত করে তুলল। নিশ্চয়ই দাম্পত্য কলহ আর মানাভিমান! মনে মনে হাসলেও গাম্ভীর্যের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে? বউয়ের সাথে ঝগড়া?” প্রশ্নটা করেই মনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। রীনা চলে যাবার পর আমার ঝগড়া করা হয়নি কারো সাথে আজ প্রায় ২০ বছর। এটাকে কি সৌভাগ্য আখ্যা দিব? ভাবার সময় পেলাম না, জাহাঙ্গীর দুই হাতে মুখ ঢেকে গড়গড়িয়ে তার বৃত্তান্ত বলা শুরু করে দিল। “আন্নেরে খুলি কই, আন্নে তাইলে বুইজবেন।

আইজ্যা বেয়ানে ফজর অক্তে আঁই বাইর হয়চি। গ্যারাজে যাই ছাই য্যান, আঁর চিএনজির ইঞ্জিন্নেত্তে কেইচ্চ্যা জানি ঘটর ঘটর শব্দ করের। আঁর ত মাথাত বাড়ি এক্কেরে। কতক্ষন লাইগবো কনে কইব। কালাইম্যা মেকানিকরে ডাকি আইনলাম।

হ্যাতের হাতের কাম ভালা। আধা ঘন্টার মধ্যে হ্যাতে ঠিক করি দিল। তয় যেদিন কপালে খারাবি আছে, হেদিন বিপদ চারমুইত্তুন ধাই আইয়ে। বাইর হইছি। মিয়াগো বাড়ির সামনের প্যাকের লাই গাড়ি ডাবি গেইল গই, বহুত কষ্টে হিয়ান তুন বারিত গেলাম চাইরডা ফান্তা খাইবার লাই।

আন্নেরে ত আঁই ব্যাকই কই। শরমের কথা, তবুও কইয়ে লাই। হিতিরে না দেখি কামে যাইতাম মনে ন কয়। আমি জাহাঙ্গীরের বিশাল উপক্রমনিকার পরিসমাপ্তি নিয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু পত্নী প্রেম যে আজকের বিষয় তা বুঝতে পারিনি।

ভেবেছি আজকে পত্নীবিরাগই আলোচনার বিষয়। কিন্তু স্ত্রীর কথা বলার সময় তার মুখে যে দীপ্তি খেলে গেল তার অজান্তে, সেই মায়ায় আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইলাম নির্বাক ওর দিকে। রীনাকে কি আমি অতটা ভালবাসতাম? চরম কথা কাটাকাটির মূহুর্তে ওর চোখে চোখ পড়লে আমার শানিত সব যুক্তি কি ভোঁতা হয়ে যেত? মনে পড়ল না। বয়স হচ্ছে। রীনার মুখটাও ভাল করে মনে পড়ে না।

শুধু ওর হাসি, নয়ন, শ্রবণ আর হৃদয় তিনই জুড়ানো সেই হাসি ভুলবার নয়। জাহাঙ্গীরও মনে হয় তার স্ত্রীর কথা ভাবছে, তাই নিচের দিকে তাকিয়ে সেও চুপ করে বসে রইল। একটা মাছি ভন ভন করে চায়ের কাপে বসছে উড়ছে, আবার ঘুরে ফিরে আসছে। মাছির নাকি কয়েক হাজার চোখ, অক্ষিপুঞ্জ না কি যেন পড়েছিলাম সেই কোন বালক বেলায়। মাছিও বোধহয় জাহাঙ্গীরের অনর্গল কথাপুঞ্জের হঠাৎ বিরামে বিরক্ত হয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল।

মাছির গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, মাছি কয় দিন বাঁচে? মাছি জীবনপঞ্জি পড়েছি কিনা মনে করতে পারছি না। নিজের চিন্তার বিক্ষিপ্ততা নিয়ে একটু বিরক্ত লাগছে নিজের প্রতি। বয়স হচ্ছে, নাকি রীনার নির্ঝরিনীতূল্যা হাসি মনে পড়েছে বলে চিন্তাপ্রবাহ খানিক সংযোগহীন? টোকন মিয়া আরো দুইটা চায়ের কাপ ঠকাশ করে টেবিলে দিয়ে গেল। সেই শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে জাহাঙ্গীর আবার বলা শুরু করল। মনোযোগ দিলাম ওর কথায়।

“স্যার বারিত যাই ছাই ফারভিনে রিয়াইজ্যার লগে কথা কর। রিয়াইজ্যা আঁর দোস্ত কিন্তু হ্যাতের স্বভাব চরিত্র ভালা ন। হ্যাতের নজরও ভালা ন। ফারভিনের মত সুন্দরী মাইয়া হ্যাতে জীবনে দেইখছে নি। হিতি ছা নাস্তা দিছে ঠিক আছে কিন্তু ফান-হুফারি দেওনের কি দরকার আছিল? আর এত হাইসবার কি দরকার।

শরমের কথা তয় হিতি হাইসলে হিতির গালে টোল হরে, হিতি ন জানে হিতির হাসি আঁর কেইচ্যা ভালা লাগে। রিয়াইজ্যা আঁরে দেই এক্কেরে চোরের লান ফলাই গেল। তাইর মানে হ্যাতের কোন কাম আছিল না, হ্যাতে ফারভিনের লগে কথা কইতে আইছিল। আই হিতিরে জিজ্ঞাইলাম হ্যাতে মদ্যে মদ্যে আইয়েনে। হিতি মাথা নাড়ি কইল কেওল আইজ্যাই আইছে।

আঁর সন্দ না যায়। এই রিয়াইজ্যা আঁর জীবন গরত করিয়ে না দিব লাগের। আঁই হিতিরে কইলাম, তুঁই কোন ব্যাটা মানুষের লগে কথা ন কইও। ওমা, হিতি কি বুঝি ছ্যাত করি কইল, আন্নের বন্দুরে আন্নে আইতে মানা করি দ্যান। আই কি আইবার লাই কইছি নি।

আন্নের এইচ্যা কথা আঁর সজ্য ন হয়। আঁরও মাথাত রক্ত উডি গেইল গই। হিতিরে গালি গালাজ করি না খাই চলি আইছি। অন খুব খারাপ লাগের। হিতি মাইয়া ভালা।

আঁই জানি হিতিও আইজ্যা কিছু খাইতো ন। বাইত যাইতাম মনে কর, আবার শরমো লাগের। “ কথা শেষ করে লাজুক লাজুক হাসি হেসে জাহাঙ্গীর মিয়া চায়ে আয়েশ করে লম্বা চুমুক দিল। ও জানলই না আমার মনের কোথায় দোলা দিল ওর গল্প। রীনার কাছে কে যেন চিঠি লিখত।

রীনা আমাকে বার বার বলেছে ও চিনে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস হত না। একদিন অফিস থেকে আগে বেরিয়েছি ওকে সারপ্রাইস দেব বলে। বাড়ি গিয়ে দেখি রীনা গান শুনছে, এলো চুলে উপর হয়ে শুয়ে পা দুলিয়ে তাল দিতে দিতে সেই সহস্র চিঠির একটি মন দিয়ে পড়ছে। শাড়ি সরে গিয়ে ওর নিটোল ফর্সা পায়ের রুপালী নুপুর দেখা যাচ্ছে।

সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে চিঠি। উড়ছে ফ্যানের বাতাসে। আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল এ কোন স্বৈরিণী—এ আমার স্ত্রী হতেই পারে না। আমার ঘর, আমার ভালবাসাকে পঙ্কিলতায় নামিয়ে এনেছে এই মেয়ে।

কি যে রাগ হল হঠাৎ। ওকে হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে দরজার কাছে নিয়ে বল্লাম, “গেট আউট। আই কান্ট লিভ উইথ আ স্লাট হু স্প্রেডস হার লেগস ফর মেন। বেড়িয়ে যাও, আমি চাইনা তোমাকে আর। ইউ বিচ!“ রীনা ঘটনার আকস্মিকতায় বোধহয় হতভম্ব হয়ে গেছিল।

মিনিট দুয়েক আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে সেই যে বেড়িয়ে গেল আর কোনদিন ফিরে আসেনি। আমি গেছিলাম তাকে আনতে তার পিত্রালয়ে কিন্তু সে আমার সাথে দেখাও করেনি। এক মাসের মাথায় আমাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার চন্ডাল রাগ বলেছিল, আমাকে তালাক দিয়ে সেই ছেলেকে বিয়ে করবে। কিন্তু বছরখানেক পরে কি কাগজ খুঁজতে গিয়ে রীনার সেই প্রেমপত্রগুলো খুঁজে পাই।

বাসার পরিচারিকা বোধহয় সেগুলি কুড়িয়ে গুছিয়ে রেখেছিল। সারারাত জেগে জেগে আমি পড়েছিলাম, জেনেছিলাম এক তরফা সেই প্রেমের কথা। আমি আবার হন্যে গেছিলাম ওর কাছে কিন্তু ও তত দিনে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ওর বাসার লোক আমাকে কিছুতেই ওর ঠিকানা দিল না। হারিয়ে গেল ও একেবারে আমার জীবন থেকে। দেরী হয়ে গেছিল আমার—অনেক দেরী।

জাহাঙ্গীরের দিকে তাকালাম। চা শেষ তার। ইতস্তত একটা ভাব মুখে। মানিব্যাগটা বের করে পেনশনের হাজার দুয়েক টাকা তার হাতে দিয়ে বল্লাম “বঊয়ের জন্য ফুল আর শাড়ি কিনে বাড়ি যাও জাহাঙ্গীর, দেরী করো না, একদম দেরী করো না। “ ।

ও প্রতিবাদ করা আগেই বেড়িয়ে পড়লাম দোকান থেকে। মনটা খুব উদাস হয়ে গেল আজ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি “মেঘের পরে মেঘ জমেছে”... -- আমি খুব লজ্জিত আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্য। জীবন, জীবিকা, ঘটনা দূর্ঘটনার বেড়াজালে আটকে গেছিলাম। অনেক গল্প শুরু করে এক লাইন, এক পাতা লিখে আর লেখা আগায়নি।

কমেন্টের উত্তর দেবার ন্যূনতম ভদ্রতাও রক্ষা করতে পারিনি। অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী সবার কাছে। ভাল থাকুন সবাই। আমার খুব প্রিয় একটি গান শুনে এই গল্প লেখা। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে।

তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি পরাণ আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।