আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাপক নীলু-৩

২৯.০৫.১১ রবিবার নীলু, আমাদের এলাকায় যে বুড়ো পোস্টম্যান ছিলেন তার বাহন দ্বিচক্রযানটা ছিলো খুব অদ্ভুত- মনে হতো এই বুঝি খুলে পড়লো তার কোন কলকব্জা! আর ঐ পোস্টম্যান দাদুও ছিলেন অন্যরকম- কেমন যেন পাগল পাগল। এলাকার সব জায়গার চিঠি বিলি করার শেষে আসতেন আমাদের বাড়িতে, প্রায়ই ঠিক মধ্যদুপুরে- যখন আমরা খেতে বসতাম। আমার মা, ঠাকুরমা, কাকীমারাও যেন জানতেন এই অত্যন্ত সহজ সরল আর ভালো মানুষটার দুপুর বেলার খাবার আমাদের বাড়িতে খাওয়া মোটামুটি নিয়মভুক্ত। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিলো না, তাই ভরসা ছিলো হলুদ খামে আটকানো কথামালা, আর আমার জ্যাঠামণি, পিসী, সেজোকাকা, বাবা সবাই বাড়ির বাইরে থাকতো বলে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি আসতো, ফলে দিনে দিনে অবচেতনে ঐ বুড়ো পোস্টম্যান দাদু আমাদের আপনজনই হয়ে ছিলেন। নাম জানা ছিলো না তার, কিন্তু দৈবাৎ তার অনুপস্থিতি লম্বা সময়ের হলে মনে হত কী যেন একটা ঘটছেনা! আমি জীবনে প্রথম চিঠি লিখি ক্লাস টু’তে পড়ার সময়।

আমার জ্যাঠামণি তখন দূরের শহরে থাকতো। ভেবে দেখ্ বাড়ির সবথেকে ছোট্ট বাবুটা সদ্য শেখা বর্ণগুলোকে কোনরকমে সাজিয়ে যদি লিখে ফেলে গোটা একটা চিঠি তবে দূরে থাকা আপনজন তা হাতে পেয়ে কেমন আনন্দ পাবে। এই সেদিন জ্যাঠামণি কাছে পেয়েছিলাম সেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। চিঠিটা জানিস কী লিখেছিলাম? শোন্ তবে- “মণি, তোমার গবেষণার খবর ভালো তো? মণি, তোমার আলুগাছ বড় হয়েছে। এক ফানা কলা খেয়েছি।

তো মার জন্য থুয়ে দিয়েছি। আমাদের পরীক্ষা ঈদের পরে। বাড়ির সবাই তোমার জন্য মাতাল। টাকার জন্য চিন্তা করোনা। গরুর দুই কেজি করে দুধ হচ্ছে।

গোয়ালঘর বেঁধেছে। তুমি ভালো আছো, ভালো থেকো। জয়গুরু দিয়ে শেষ করলাম। ” কেমন লেগেছে বল্ ? হয়তো বাড়ির বড় কেউ আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলো কথাগুলো, কিন্ত তাতে কী যায় আসে; চিঠি মানে তো শুধু কথা বা তথ্য নয়, তার সাথে জড়িয়ে থাকে স্পর্শ, খামভর্তি করে পাঠিয়ে দেয়া কিছু মুহূর্ত! আমাদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে চিঠি পড়া ছিলো প্রায় উৎসবের মত একটা উপলক্ষ্য। সন্ধ্যার পর উঠোনে মাদুর পেতে চিঠি পড়া হচ্ছে- এ যেন আমি এখনো চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই।

চিঠি যেই লিখুক না কেন সবথেকে ছোট্ট আমার জন্য ছোট আলাদা একটা চিঠি থাকতোই, যাতে সম্বোধন থাকতো আমার নামের শেষে ‘বাবু’ দিয়ে। আচ্ছা নীলু, তোর কি মনে পড়ে শেষ কবে তুই চিঠি লিখেছিস, কিংবা চিঠি পেয়েছিস! মোবাইলে sms, ফেসবুকে chatকরে হতো তথ্য জানানো যায়, কিংবা sorry আদান প্রদান করা যায়; কিন্তু বুকের মধ্যে রয়ে যায় কি তার কোন রেশ? বল্ তো কার কোন sms’র কথা তোর মনে আছে, তার চেয়ে ঢের সহজেই মনে করতে পারবি হলুদ খাম খুলে কোন কালে কবে পেয়েছিলি কার হাতের ঘ্রাণ, অথবা কার কোন কষ্টের বিলাপ, অথবা খুশির মিষ্টি সুবাস! পুরনো চিঠির বাক্স খুলে খুঁজতে খুঁজতে সেদিন একটা চিঠিতে দেখলাম আর্টকলেজ-পড়ুয়া পিসী বাড়িতে জানাচ্ছে তার ভালো কোন ব্যাগ নেই, কাছে হাত খরচের টাকা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। পিসীর এখন সংসার হয়েছে, মেয়েরা বড় হয়েছে; তবু হঠাৎ করে পিসী আমার কাছে হয়ে গেল এক অভিমানী কিশোরী যে তার অভাবী ভাইদের কাছে বিভিন্ন আবদার করছে, আর না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। হাতের মধ্যে চিঠিটা আর চোখে পবিত্র দু’এক ফোঁটা জল নিয়ে বুঝলাম কত মায়াভরা এক জগতে বাস করি আমি- আমাদের চারপাশে কত আলো! মাঝে একদিন সেই পুরনো পোষ্টম্যান দাদুর সাথে দেখা, এখন অবশ্য আর পোষ্টম্যান নন- দেখি শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে, চোখের দৃষ্টি যেতে বসেছে। নিজেকে চেনানোর পর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কত বড় হয়ে গেছো, বাবু!” তারপর আমার বাড়ির সবার খবর নিলেন একেবারে কাছের আত্মীয়ের মত করে।

বললেন তার কষ্টের কথা, জীবনে কিছু না পাওয়ার কথা। শতমানুষের হাজার খুশির বার্তা বয়ে শেষবেলায় তিনি খুব ক্লান্ত, অসহায়। নীলু, পৃথিবীতে সহজ স্বাভাবিক ভালো মানুষগুলো কিছু পায়না কেন বলতে পারিস? পুরনো জিনিস মানেই কি ফেলনা? বড্ড সেকেলে বলে চিঠি লেখার রীতিকে ছুড়ে ফেলেছিস্ জানি, তারপরও আমার কথা শুনে একবার বাড়ির পুরনো পোটলা পুটলি ঘেঁটে যতগুলো পারিস পুরনো চিঠি খুঁজে পড়ে দেখিস্। দেখিস্ কিছু না পাবিই! আর শোন্, মোবাইল করিস্ না, পারলে চিঠি দিস্। ভালোবাসা।

ইতি। তোর বন্ধু। প্রাপক নীলু-১ প্রাপক নীলু-২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.