আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাকিয়ে দেখি কী বিস্ময়!

আমি সেই নক্ষত্রের অপেক্ষায় থাকব চিরকাল তাকিয়ে দেখি কী বিস্ময়! হাসান আজিজুল হক জন্মেছিলাম রাঢ় এলাকায়। গাঁয়ের নাম যবগ্রাম, বর্ধমান শহর থেকে ২০ মাইল উত্তর-পূর্বে আমাদের গ্রামটি—সে এক খরখরে ভূমি, শুকনোর দেশ। চারদিকে ধু ধু করেছে মাঠের পর মাঠ, গ্রামগুলো বৃক্ষশূন্য। মাঝেমধ্যে বনকুলের ঝোঁপ, তার মধ্যে মাথা খাড়া করে আছে এক বিশাল বৃক্ষ। এসবের ভিড়ে নদী কোথায়? প্রকৃত নদীকে চিনেছি বোধবুদ্ধি হওয়ারও বেশ পরে।

যখন বড় হচ্ছি, চোখভরে দেখতাম সবুজ ধানের গুচ্ছ। রাঢ় এলাকা ধানের এলাকা। তো আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে একটি নালা ছিল। পশ্চিমের ঢালু জমির পানি এবং ফসলি মাঠের পানি এই নালায় এসে জড়ো হতো। এটি আসলে ছিল একটি প্রাকৃতিক খাল।

খাল হলেও গ্রামের মানুষ আদর করে এর নাম দিয়েছিল মহানালা। রাঢ়ভূমি এমনিতে শুকনো কিন্তু বর্ষা এলেই এর মাঠ-প্রান্তর জলে টইটম্বুর হয়ে যেত। আষাঢ়-শ্রাবণের ঘনবর্ষণে প্রতিবছর মহানালার পানিও পূর্ণ হয়ে যেত কানায় কানায়। তার ওপর মাঠের পানিও যুক্ত হতো নালার সঙ্গে। স্রোত বইতো।

এমনিতে নালাটি ছিল ক্ষীণাঙ্গি কিন্তু ভরা বর্ষার মৌসুমে এর রূপ হতো অন্য রকম। বর্ষার একটানা দাপটে মাঠঘাট সবই একাকার। পানির তোড়ে তখন মাঠকে মনে হতো সমুদ্রের মতো, গেরুয়া রঙের পানির চাদর দিয়ে ঢাকা। দু-এক দিন পর মাঠের পানি কমে গেলেও মহানালার পানিতে কোনো কমতি নেই, বর্ষায় বরাবরই সে পূর্ণবতী। খুব ছোটবেলায় নদীর সঙ্গে আমার তেমন স্মৃতি নেই।

তবে ওই ছেলেবেলায়ই পানির ভেতর মাঠ ভাসানো অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা মহানালাকে নদী বলে ভাবতে ভালোবাসতাম। সেই কালে এভাবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে গিয়ে গাঁয়ের ছোট খালটি আমাদের কাছে পেয়েছিল নদীর সম্মান। সারা দিন নালার পাশে ছাগল চরানো, ওই নালায়ই মাছ ধরা, হইহুল্লোড়—নরেন, শ্রীকুমার, অমরেশ, ভণ্ডুল, হবীব, এহসান, মতি, রউফ; এদের সঙ্গে কত আনন্দেই না দিনগুলো কেটে গেছে তখন! আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধুরা অনেকেই এখন লোকান্তরিত। রাঢ়বঙ্গের নদী এপারের পদ্মা-মেঘনার মতো প্রশস্ত নয়—ক্ষীণাঙ্গি। আমাদের বাড়ি থেকে ছয় মাইল দূরের অজয় কিংবা কনুর নদীর রূপ অনেকটা এ রকম।

গ্রীষ্মকালে এগুলোর পানি কমে যেত, বর্ষায় আবার থইথই। তাই ছোট নদী যেমন, তেমনি বড় বড় নদীও বয়ে গেছে রাঢ় অঞ্চলের ওপর দিয়ে। আমাদের বসতভিটা যে মহকুমায়, সেই কাটোয়া ধরে বাঁকুড়ার দিকে গেলেই বিখ্যাত দামোদর নদ। কাটোয়ার পাশ ঘেঁষে বইছে অজয়, শেষাবধি মিলেছে ভাগীরথীর সঙ্গে। আজও চোখের কোণে অজয়ের যে চেহারা ভাসে, তা বালুময় অঞ্চলের ভেতর এক স্বচ্ছ জলধারা।

মুক্তি ও বিস্তারের অনুভব আজও যেন ফিরে আসে অজয়পারের স্মৃতি মনে হলে। আকাশ কত বিস্তৃত, মাটি কত বিশাল—সেটি তো জেনেছি এই অজয়ের পাশে দাঁড়িয়েই। এভাবে দিনে দিনে নদীর সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটল, আমি তখন ১০-১২ বছরের কিশোর। বর্ধমান থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরতাম ট্রেনে চেপে। খড়ি নদীর ওপর দিয়ে ট্রেন চলত।

নদীর ওপর ছোট্ট লোহার ব্রিজ। ট্রেন নদীতে, ব্রিজে উঠতেই ‘খড়ি নদীর ব্রিজ, সাবধান’ এই সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যেত আমাদের। ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলছে। আমার চোখ জানালা গলিয়ে নদীর পানি দেখার চেষ্টা করছে। মজার বিষয় হলো, নদীর পাড় এত উঁচু যে চলতি পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে পাড় টপকে পানি প্রায় দেখাই যেত না।

ওদিকে গা-হাত-পা শিরশির করছে উত্তেজনায়। নদীর দুই ধারে দেখা যাচ্ছে ঘাসের জঙ্গল, কাশবন। আর এই নদীর পাড়টি এত চিকন ও মসৃণ যে প্রথম দেখায় মনে হবে ফিতে ধরে কাটানো হয়েছে। স্বচ্ছতোয়া পানি সেই নদীর, যেন হিরে গলানো পানি। এত স্বচ্ছ যে মাটির তল পর্যন্ত দেখা যায়।

আসা-যাওয়ার পথের খড়ি নদী, বাড়ি ফেরার ছোট্ট ট্রেনটি কত না স্মৃতিকে উসকে দিচ্ছে এখন! ছেলেবেলায় দেখতাম প্রবল বৃষ্টির তোড়ে হরপা বান ডাকত নদীতে। বিভিন্ন নদীর স্রোত এক মোহানায় মিলিত হয়ে বানের সামনে ভেসে যেত সবকিছু। প্রবল পরাক্রমশালী হাতিকে ভাসিয়ে নিতে পারে বলে এই বানের নাম হরপা। হাতি থেকে হরপা। এখন কোথায় সেই বান, কোথায় সেই স্রোত।

অজয় ও কনু নদীর পানি ভাগীরথীর মোহনায় মিশে, আগেকার উন্মত্ততা নিয়ে হরপা বান এখনো কি ফুঁসে ওঠে? ১৯৫৪ সাল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পাট চুকিয়ে যবগ্রাম ছেড়ে এ দেশে চলে এলাম। তখন আমার বয়স ১৬ কি ১৭। এ দেশে আসার পর যেন জন্মান্তর ঘটে গেল আমার। সবুজ-শ্যামল মায়ায় ঘেরা দেশ।

প্রথম যৌবনেই এক নদীবহুল, জমাট বাঁধা সবুজ রঙের হিরের মতো দেশে এলাম খুলনা শহরে। আমরা থাকতাম ভৈরব নদীর পারে। সমগ্র খুলনা শহরকে আষ্টেপৃষ্ঠে আগলে রেখেছে ভৈরব। নওয়াপাড়া থেকে শুরু করে ফুলতলা, শিরমনি, দৌলতপুর, খালিশপুর এবং খুলনা শহরের বুক চিরে রূপসায় গিয়ে মিশেছে এই নদী। চোখের তারায় আজও লেগে আছে ভৈরবের সেই জোয়ার-ভাটার দৃশ্য।

বড় বড় ঢেউ আর প্রবল পানির উতরোলে নদীটি যখন পাগলা হয়ে যেত, সবকিছু উজাড় করে দিত সে। মনে আছে নদীতে সারবেঁধে নৌকা বাঁধা থাকত। কখনো বা সেই নৌকায় গিয়ে বসতাম। এই নদীপথে সেই সময় বিশাল বিশাল স্টিমার চলত। রাতেরবেলায় স্টিমারের ভোঁ ভোঁ, সার্চলাইটের নীলচে আলো—সবকিছু মিলিয়ে ঘুমের মধ্যে মাঝেমধ্যেই মনে হতো কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি, এ কি খরখরে রাঢ়ের প্রান্তর নাকি অন্য এক দেশ! স্বপ্ন-জাগরণের কাছাকাছি এ রকম অনুভূতি হতো প্রায় রাতেই।

তখন ঢাকায় যাওয়া-আসা চলত নদীপথে। খুলনা থেকে ঝালকাঠি, বরিশাল হয়ে স্টিমার ভিড়ত সদরঘাটে। প্রমত্তা নদীর বড় বড় ঢেউ আর বিচিত্র ধরনের মানুষের সঙ্গে মাখামাখি করে সেই সব যাত্রার স্মৃতি ভোলা যাবে না কখনো। ভরা নদীতে স্টিমার পানি কেটে চলছে। পানির ওপর রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে ঢেউ।

স্টিমারে খুলনা থেকে ঢাকা পৌঁছাতে তখন একদিন একরাত সময় লাগত। সম্ভবত ’৬১ সালের দিকে আমি রাজশাহীতে আসি। এখানে আসার পর পদ্মা নদী কাছ থেকে দেখলাম। তবে পদ্মার সঙ্গে আমার কখনো তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। পদ্মার পাড় ধরে বন্ধুবান্ধবসহ হাঁটা, বাদাম খাওয়া—ওই পর্যন্তই।

আসলে নির্জনে উপভোগ করার মতো বাস্তবতা পদ্মায় আমি সেভাবে পাইনি। মনে আছে, পদ্মার পাড়ে ঘোরাঘুরি শেষে ঠাকুরের দোকানের সন্দেশ খেতাম আমরা। সে কী অপূর্ব স্বাদ! আবার এমন হয়েছে যে সারা রাত প্রাণের বন্ধু আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে গল্পগুজব শেষে এক্কেবারে সকালে পদ্মাস্নান সেরে ফিরেছি। সে সময় এমনই বাতিক ছিল আমাদের। এসবই ’৬০ সালের ঘটনা।

আমি তখন সবে সিটি কলেজে ঢুকেছি। নিয়মিত আড্ডা-আনন্দে পার হয়ে যাচ্ছে দিনগুলো। এর মধ্যে নদী, নদীর ভয়ংকর সুন্দর রূপকে আবার নতুন করে চিনলাম দক্ষিণ বাংলার বলেশ্বর নদের মুখোমুখি হয়ে। ’৬৩ সালে সেবার বরিশালের ওই অঞ্চলে প্রচণ্ড ঝড় হলো। আমরা ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেলাম দুর্গত অঞ্চলে।

চকচকে কালো বড় বড় ঢেউ ভেঙে বলেশ্বর নদের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। এই নদটি খুবই প্রশস্ত, রাইন্দা, মোরেলগঞ্জ, তাফালবাড়ি, বগি হয়ে একেবারে সমুদ্রে মিশেছে। ছোট্ট একটি ডিঙিনৌকায় পানি চিরে চিরে চলেছি। মনে হয় কলার খোসার মতো ভেসে চলেছি। একসময় পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যস্থল বগিতে।

চারদিকে তাকিয়ে দেখি, কী বিস্ময়! যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। লম্বা একটা তালগাছের মাথায় আটকে আছে নৌকা। ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু ঝড়ের বীভৎসতার মধ্যেও বলেশ্বরের কালো স্রোত আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আর এই নদীপথে চলতে-ফিরতে গিয়েই সুন্দরবনকে আরও নিবিড়ভাবে জেনেছিলাম আমি।

ওই যে তাফালবাড়ি ও বগি, এরপর সমুদ্রের যেখানে শুরু—এসবের মধ্যেই রয়েছে সুন্দরবনের শাল-গজারি ও গোলপাতা। মূলত ত্রাণ সাহায্যের জন্য বলেশ্বর হয়ে সেই প্রত্যন্ত দুর্গত গ্রাম বগিতে যাওয়ার ফলেই আমি পেয়ে যাই ‘মা-মেয়ের সংসার’ গল্পের পটভূমি। যেন বা নদী এখানে অনেক বেশি আদিম। তাই নদীর গল্প বলতে গেলে স্মৃতি ফুঁড়ে বলেশ্বরের উথাল-পাথাল স্রোত আজও জেগে ওঠে। যে নদীকে নিজের বলে দাবি করা যায়, এ রকম কোনো নদীর সঙ্গে হয়তো আমার পরিচয় ছিল না।

তবে দিনে দিনে বিভিন্ন নদীর সঙ্গে নানা রকম চেনা-জানার কারণে এখন নদী আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। শুকনো রাঢ়ের প্রান্তর যেভাবে আমার অস্তিমজ্জায় মিলেমিশে আছে, একইভাবে এ দেশের অসংখ্য নদীর স্রোতও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ অক্টোবর, ২০১০ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.