আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিন্ধু সভ্যতাঃ এক অপার বিস্ময়-১

শিক্ষা যেখানে অসম্পূর্ণ, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, ধলাবাড়িয়া, গানেরিওয়ালাসহ ছোট বড় প্রায় হাজার খানেক নগর ও গ্রাম নিয়ে সিন্ধু সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু ও সরস্বতী (বর্তমানে বিলুপ্ত) নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা এ নগর সভ্যতাগুলোয় অনুসন্ধান করে পাওয়া গিয়েছে বিস্ময়কর সব তথ্য ও উপাদান। এযাবত পৃথিবীতে যতগুলো সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত এ সভ্যতাটির বিস্ময়কর কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। এ যাবত আবিস্কৃত সভ্যতাগুলোর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা হল সবচেয়ে সাম্যবাদী সভ্যতা।

এখানে কোন রাজগৃহ বা এ জাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি কোন রাজকবরও। প্রতিটি সভ্যতায়ই রয়েছে দুর্গ। আর্কিওলজিস্টরা ধারণা করেন যদি কোন রাজা থেকেও থাকেন তারা বাস করতেন দুর্গগুলোয়। তবে অন্য সভ্যতাগুলোর মত সে রাজারা একনায়কতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন না।

শহরের বাড়িগুলো সবই প্রায় একই মাপের। সম্ভবত নগরের আবাসন ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত ও পরিকল্পনামাফিক। মিশর ও মেসোপটেমিয় সভ্যতার রাজকবরগুলো দেখেই বোঝা যায় কতখানি অনৈতিক সুযোগসুবিধা ভোগ করত এই সভ্যতাগুলোর রাজারা। রাজাদের কবর দেয়ার সময়ে জীবিত দাস-দাসীদের রাজার সাথে কবর দেয়া হতো। বেঁচে থাকাকালীন যেসকল সুযোগসুবিধা রাজারা ভোগ করত মৃত্যুর পরে কবরেও সেসব সুযোগসুবিধা দিয়ে দেয়া হত তাদের জন্য।

সিন্ধু সভ্যতায় এরকম একটি কবরও পাওয়া যায়নি। সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলো ছিল পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা। নগরের বাড়িগুলো একই মাপের ছিল। রাস্তাগুলো ছিল সোজা এবং সাধারণত উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। ছিল ভূ-গর্ভস্থ পয়নিস্কাষণ ব্যবস্থা।

আমাদের দেশের বর্তমান নগরগুলির থেকেও উন্নত ছিল ড্রেনেজ সিস্টেম। বাড়িগুলো ছিল ইটের তৈরী দ্বিতল বাড়ি এবং সকল ইটের সাইজ একই, ১:২:৪। প্রত্যেকটি বাড়ির সাথেই প্রধান ড্রেইনের সংযোগ ছিল। প্রধান ড্রেইনটির আউটলেট ছিল নগরের বাইরে। সিন্ধু সভ্যতায় কোন গণ-উপাসনালয় পাওয়া যায় নি।

পাওয়া যায়নি কোন বড় মূর্তিও। ধারণা করা হয় এ সভ্যতায় নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা বেশ জোরালো ছিল। তবে বেশ কিছু ছোট ছোট মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত এগুলো গৃহদেবতাদের মূর্তি। ঋগ্বেদে ইন্দ্রসহ অনেক দেবতার উল্লেখ থাকলেও ঋগ্বেদ সম্ভবত পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষের দিকে ধর্মসংস্কারের ফল।

কিছু দেবতা আগেও ছিল তবে তাদের বিশেষ কোন মূর্তি ছিল না। সমুদ্র দেবতা বরুণ সম্ভবত শ্রেষ্ঠ দেবতা ছিল, পরবর্তীতে ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতায় পরিণত হয়। সিন্ধু সভ্যতায় ছিল অতি উন্নত এক নদী-নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা। ছোট-বড় অনেক নদীতে বাঁধ দিয়ে এক উন্নত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল এখানে। ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে এই নদীনিয়ন্ত্রনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছিল।

সমুদ্রদেবতা বরুণের প্রধান দেবতা হওয়ার পিছনে কারণ ছিল সম্ভবত এই কৃষি-সেচব্যবস্থাই। পরবর্তীতে এই নদীনিয়ন্ত্রনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্যই সম্ভবত ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন হয়। ইন্দ্রকে প্রধান দেবতা হিসেবে উপস্থাপন করে ধর্মসংস্কার হয়। ঋগ্বেদে আমরা ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রাসুরকে বধ করার যে কয়েকশ ঋক দেখি তা আসলে ইন্দ্রের নামে বাঁধ ধ্বংস করারই নামান্তর। বৃত্র আসলে বাঁধ বৈ আর কিছু নয়।

বৃত্রকে বধ করার পরে প্রচণ্ড বেগে জল নেমে আসার যে কয়েকশ মন্ত্র বা ঋক রয়েছে তাতে বৃত্রকে বাঁধ বৈ অন্যকিছু ভাবার কোন অবকাশই থাকে না। জড়বস্তুকে পার্সোনিফিকেশন করার ফলেই বাঁধ বৃত্র নামক অসুরের নামে রূপান্তরিত হয়। এখানে আরেকটি মজার ব্যাপার হল ঋগ্বেদের প্রথমদিককার ঋকগুলোয় অসুর বলতে শক্তিশালী বুঝানো হয়েছে। তাই ইন্দ্রকেও অসুর সম্বোধন করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে পক্ষের শক্তিকে দেবতা ও বিপক্ষের শক্তিকে অসুর বলার রীতি চালু হয়।

এ প্রসঙ্গে পারস্যগ্রন্থ আবেস্তার কথা বলতেই হয়। সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার পরাজিতরাই মাইগ্রেট করে ইরানে গিয়েছিল। আবেস্তা গ্রন্থে শুভ শক্তিকে অহুর এবং অশুভ শক্তিকে দয়েভ বলে পরিচিত করা হয়েছে। পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষের দিকে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের মধ্য দিয়েই মূলত সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস শুরু হয়। সিন্ধু সভ্যতার প্রধান অংশগুলোয় বর্তমানে মরুভূমি।

সম্ভবত তখনও এখানে খুব কম বৃষ্টিপাত হত। সেচব্যবস্থা দিয়েই কৃষিকাজ চালানো হত। মরুকরণ শুরু হলে একসময়ের আর্শীবাদ নদীনিয়ন্ত্রনব্যবস্থা কিছু অংশের জন্য জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়। যার ফলে তাদের মধ্যে এক যুদ্ধের সূচনা হয়। বৃত্রবধ/বাঁধ ধ্বংসের মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

সেচব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার ফলে কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং এই সভ্যতার মানুষগুলো ক্রমাগত অন্যদিকে মাইগ্রেট করতে থাকে। প্রায় সব সভ্যতাগুলোয়ই বাঁধের অস্তিত্ব রয়েছে। পুরো সভ্যতাটির বাঁধব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য প্রেয়োজন ছিল ধর্মসংস্কার। ইন্দ্রকে প্রধান দেবতা হিসেবে সে ধর্মসংস্কারের কাজটি খুবই ভালই করেছিল তখনকার বৈদিক সমাজ। যার ফলে একে একে সকল বাঁধই ধ্বংস হয় এবং সভ্যতাটি ক্রমে বিলুপ্তির দিকে চলে যায়।

(চলবে) পর্ব-২  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.