আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমপত্র

হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই খুব জানতে ইচ্ছে করে আজকের ছেলে মেয়েরা কি জানে প্রিয়জনের একটা চিঠির কি মূল্য? কি ভালবাসা কি নিখাদ আবেগ লুকিয়ে ছিল আমাদের সময়ের একটা প্রিয়জনের চিঠিতে? মনে হয় জানে না। মনে আছে বিরহী যক্ষ্ম অলকানন্দীনী বিরহী যক্ষ্মীর কাছে কি আবেগ দিয়ে চিঠি লিখেছিল আর সে চিঠি সে পাঠিয়েছিল মেঘের হাত দিয়ে। মেঘের হাত দিয়ে চিঠি পাঠানোর কবি কালীদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে পাওয়া যায়।

আর যখন ডাক বিভাগের প্রচলন হয়নি তখন কিন্তু প্রেমিক চিঠি পাঠাতেন প্রেমিকের উদ্দ্যেশ্য পোষা পাখির পায়ে বেঁধে। প্রাচীন সাহিত্য এ রকম উদাহরন প্রচুর পাওয়া যায়। আলাউদ্দিনের ‘পদ্মাবতী’তে তো সেই শুকসারী ছিল ডাক পিওনের ভূমিকায়। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে চঞ্চলকুমারী তার প্রেমিক রানা রাজসিংহের কাছে মন উজার করে চিঠি লিখছিলেন তার মত প্রেমপত্র কই পাব। এই সময় এসে মনে হচ্ছে প্রেমপত্র লেখা আর পাওয়ার সেই মধুর রোমাঞ্চকর সময়টা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

কে জানে বয়সের ভারে আধুনিকতার যাতাকলে আমিও একদিন ভূলে যাব কোন এক সময় আমিও কারো চিঠি পাবার জন্য কি আকুল ভাবে অপেক্ষা করতাম। কত উৎকন্ঠা কত অধৈর্য্য বেলা যে কাটিয়েছি একটা চিঠির জন্য! এখন আর কেউ চিঠিতে প্রেম ভালবাসার কথা বলে না। আছে ফোন, আছে ই মেইল, ইন্টারনেট চ্যাটিং বিশ্ব খুব কাছে চলে এসেছে। দুনিয়া গেছে ছোট হয়ে। শরীরটাও পরস্পরের হাতের কাছে খুব দ্রুত চলে আসে, কোথাও নেই আড়াল, নেই কোন রহস্য, নেই দূরত্ব।

ভোগবাদীদের এই যুগে প্রেম যেখানে শরীরী ভাষায় কথা বলে। আমাদের সময় এক পলকে একটু দেখার জন্য প্রেয়সীর বাড়ীর সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকা ছিল খুব সাধারন ব্যাপার। কোন নারী আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেনা একটা চিঠির আর পুরুষের সময় কোথায় রাত জেগে নীল খামে চিঠি লিখবে? শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ পাপড়ি আর ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েনা চিঠি খোলার সময়। ভালবাসার আনন্দ নাকি বিচ্ছেদে এখন বিচ্ছেদের পর কোথায় তোমাকে খুজব? বিচ্ছেদের পর আমাদের দু’জনের মিলন কোথায় হবে? কোথায় তোমায় পাব? জানি পাব সুধু স্মৃতিস্বপ্নের আকাশে। যেমন পুজোর পবিত্র শুকনো ফুল অনেকদিন পরে মানুষ হঠাৎ খুঁজে পায় চিঠির পাতার ভাঁজে।

তোমার পবিত্র সুখস্মৃতির ফুল তেমনি হঠাৎ খুজে পাব আমার স্বপ্নায়নের পাতার ভাঁজে। কালগ্রাসে বিবর্ন শুষ্ক। কিন্ত পবিত্র, সংরক্ষিত। এখন আর কেউ লেখেনা- লিখতাহু তেরি নাম খুনসে ইসে সিহাহি না সমঝনা মরতা হুঁ ম্যায় তেরি ইয়াদ মে ইসে জিনা না সমঝানা মানে “রক্ত দিয়ে তোমার নাম লিখেছি, একে তুমি কালি ভেবনা। আমি মরে যাচ্ছি তোমার কথা ভেবে একে তুমি বাঁচা বলবে না”।

আমার জানতে ইচ্ছে করে এই রকম ভালবাসা প্রকাশ করে কেউ কি এখন আর চিঠি লিখে? বঙ্কিমের বিষবৃক্ষের নায়িকা কুন্দের কথা মনে আছে? আত্মহত্যা করার আগে নিজ প্রেমিক আর সূর্যমুখীর স্বামীকে ধিক্কার দিয়ে যে চিঠি লিখছিলো কি বলবেন তাকে? স্বীকারোক্তি নাকি প্রেমপত্র? আমি কিন্তু একে ভালবাসার এক চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ বলব। তলস্তয় আর সোফিয়া পঞ্চাশ বছর সংসার করার পর পরস্পর যখন অসহ্য হয়ে ওঠে বিচ্ছেদ হয়, তারপর সোফিয়া যে চিঠি তলস্তয় কে দিয়েছিল সে চিঠি আজো কিন্তু অমর হয়ে আছে। একি সম্ভব হত আধুনিক ইন্টারনেটে বা চ্যাট মেসেজে? কি ছিল সেই চিঠি, যে চিঠি তলস্তয় ও পারে নি অস্বীকার করতে? কি ছিল সেই চিঠিতে? ‘মাই ডিয়ার ওয়ান, মাই ডারলিং, রিটার্ন হোম- লেভোচকা, মাই লাইফ লং ফ্রেন্ড, আই উইল ডু এভরিথিং, এভরিথিং দ্যাট ইউ উইশ! আই উইল কাস্ট অ্যাসাইড অল লাকসারি, ইউর ফ্রেন্ডস শ্যাল বি মাইন, আই উইল আন্ডার গো আকিওর, অ্যান্ড উইল বি মাইন। টেন্ডার, কাইন্ড। ডু কাম ব্যাক টু মি…………।

ভাবুন তো একবার এই রকম আর্তি কি মোবাইলের মেসেজে সম্ভব? আর তলস্তয়? ভাবুন তো কি করছিলো এই রকম আর্তির পর? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রীয় দেবীর সেই অমর কাব্য যুগল কি পড়েছেন? না পড়লে পড়ে ফেলুন লা নুই বেঙ্গলী আর ন হন্যেতে। চিঠির কিছু ধারনা পাবেন। প্রমথ চৌধুরী ইন্দিরা দেবীকে যে চিঠি দিয়েছিলেন তা কি পড়েছেন? “আমার ওপর তুমি কি সত্যিই রাগ কর? না কখনই না, ও শুধু কপট রোষ, কি বল তাইনা? তবু আমি ভয় পাই, তোমার কাছে তো ভালবেসেই অপরাধী হয়ে আছি। ভালোবাসা কি অভিশপ্ত বস্তু হে ঈশ্বর তুমি সৃস্টি করেছো। অন্যায় না করেও সর্বদা অপরাধী সেজে বসে থাকতে হয়।

সত্যি ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়…………” আর না ইচ্ছে হলে নিজে পড়ে নিবেন। শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন পরিনত বয়সে। কবিতার ভাষায় নিমন্ত্রনের চিঠি যাবে লাবন্যর কাছে চিঠির ভাষা হবে, চুমিয়া যেয় তুমি আমার বনভূমি/ দখিনা সাগর সমীরন/ যে শুভক্ষনে মম/ আসিবে প্রিয়তম/ ডাকিবে নাম ধরে অকারন। উত্তরে লাবন্য আমিতের নোট বইতে লিখেছিল,” মিতা, ত্বমসি মম ভূষণং, ত্বমসি মম জীবনং, তমসি মম ভবজলধিরত্নং। তাকে আমি দেখছিলাম এক বিবাহের অনুষ্ঠানে আমি তখন সদ্য কৈশোর উর্ত্তীন যুবক সে ছিল কিশোরী।

শুরু করছিলাম “কি নাম দেব” বলে এক পর্যায়ে তাকে জটিলেশ্বরের বিখ্যাত সেই গানটি লিখে পাঠিয়েছিলাম কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস, আমি বলি আমার সর্বনাশ । কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস, আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস। কেউ বলে নদী কেউ তটিনী, কেউ বা দিয়েছে নাম তরঙ্গিনী – আমিতো তারে কোনা নামে ডাকিনি – সে যে আমার চোখের জলোচ্ছাস। জোনাকীর নাম নাকি আঁধার মাণিক, আমি তো দেখি আগুন জ্বলে ধিকি ধিক্‌ - খর বৈশাখে প্রথম যেদিন, মেঘের মিছিলে ঐ আকাশ রঙ্গীন ... তৃষিত হৃদয়ে বাজে আনন্দ বীণ, আমি শুনি ঝড়ের পূর্বাভাস। (গান টা এখন আর আমি শুনি না কিছুদিন আগে আমার খুব প্রিয় একজন ব্লগার সিরাজ সাঁই ভাই আমাকে কি কথায় যেন লিরিক টা দিয়েছিল) সে আমাকে তার শেষ চিঠি দিয়েছিল হাসপাতালের শুভ্র সাদা বেড কভারের ওপর বসে, অনেক বড় চিঠি সে চিঠি একান্ত আমার।

শুধু কয়েক টি লাইন এ রকম ছিল “তোমাকে আমি এপাশ থেকে পেলুম না, কিন্তু আমি যখন আকাশের তারা হয়ে যাব অনেক দূরে, আমি জানি তুমি এপাশে সংসার করবে নিত্য আনন্দে কিন্তু যেনে রাখ আমি এক বিন্দু রাগ করব না কারন তোমার আনন্দ আমার আনন্দ, তোমার আনন্দে আমি মিশে আছি”। সে অনেক আগে আকাশের তারা হয়ে গেছে এক মরনব্যাধীতে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।