আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমপত্র



(১)

বিষয়টা মনে পড়তেই ঝড়ের বেগে বিছানা ত্যাগ করলো মাসুদ।

সেই কৈশোর বয়স থেকে বুকের মধ্যে করে বয়ে বেড়ানো ভালোবাসার কথাটা একই গ্রামের সমবয়সী ফুপাতো বোন মিলাকে চিঠির মাধ্যমে জানানোর জন্য গত রাতে মিলাকে সে বলে রেখেছে যে আজ সকালে সে যেন ওদের বাড়িতে একটু আসে।

কিন্তু রাতে দুশ্চিন্তার কারণে চোখে ঘুম নেমে আসতে বিলম্ব হয়েছিল। তাই সকালে উঠতে দেরী হওয়ায় মাসুদের এই তাড়াহুড়া করে বিছানা ত্যাগ করা। মিলা যদি এখনই চলে আসে! যদি মাসুদের সামান্য ভুল মিলার চোখে ধরা পড়ে এবং মিলা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়! তাছাড়া মিলা এসে যদি দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়! মিলা যশোর তার ভাইয়ের বাসায় থাকে।

ভাই ডাক্তার। যশোরের এক কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে মিলা। আজই সে যশোর যাবে। আবার কতদিন পর বাড়িতে আসবে কে জানে।

এমন সময় জানালায় ধাক্কা শুনতে পেল মাসুদ।

খুলে দেখলো মিলা। ভিতরে আসতে বলায় মিলা ঘরের ভিতরে এল। বেশভূষা দেখে মাসুদ বুঝলো যে মিলা যশোর যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েই এসেছে।

মিলা বললো, কি বলবি তাড়াতাড়ি বল।
মাসুদের শরীরের মধ্যে ভয়ের উত্তেজনা।

তাই তার মনে চিন্তা এল যে চিঠিটা পরে দিলে হয় না? কিন্তু পরে পরে করতে করতে তো কয়েকটা বছর পার হয়ে গেল। তাই সে তার এবারের সংকল্পের কথা স্মরণ করে কম্পিত হস্তে চিঠিটা বের করে মিলার হাতে দিয়ে বললো, চিঠিটা তুই একটু পড়।
চিঠিটা দেওয়ার পর বুকের ভার নেমে যাওয়ায় বুকটা হালকা লাগলো মাসুদের কাছে। সে একটু দূরে সরে গিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দৃষ্টিটা মিলার দিকে নিক্ষেপ করে মিলার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য দাঁড়িয়ে রইলো।

চিঠিটা মাসুদ এভাবে শুরু করেছেঃ
প্রিয় মিলা,
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো তার কবিতায় ব্যক্ত করে গেছেন।

যেমন বলতে পারিঃ

কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।


তাড়া থাকায় মিলা চিঠিটা পুরো না পড়েই ভাঁজ করে কামিজের মধ্যে লুকিয়ে ‘আমি যাই’ বলে চলে গেল সে প্রস্তাবে রাজী আছে কিনা সে ব্যাপারে কোন ফলাফল না জানিয়েই।

(২)

গুলিটা অল্পের জন্য লাগলো না।

সকাল বেলা বাড়ির পাশের হালটে দাঁড়িয়ে বাঁশের উপরে বসা একটা ঘুঘু-কে লক্ষ্য করে এয়ার গান দিয়ে গুলি ছোঁড়ার পর গুলিটা মিস হয়ে যাওয়ায় মাসুদ উড়ন্ত ঘুঘুটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করতে লাগলো।

হঠাৎ মিলাদের বাড়ির বিল্ডিং-এর ছাদের উপর দৃষ্টি যেতেই দেখলো যে মিলা সামনে পা বাড়িয়ে হাত দুটো হাঁটুর নীচে ধরে রেখে মাসুদের দিকে মুখ করে বসে আছে।

মনে হলো যে মিলা মাসুদকেই লক্ষ্য করছে। লজ্জায় আর ভয়ে চমকে উঠে গাছ-গাছালির আড়ালে চলে এলো মাসুদ।

ভাইয়ের বাসা থেকে দুই মাস পর কয়েকদিন পূর্বে মিলা পাবনায় গ্রামের বাড়িতে এসেছে।

সে বাড়ি এসেছে শোনার পর থেকে তাদের বাড়ির কাছাকাছি ভুলেও যায় না মাসুদ। ভয়ে ভয়ে থাকে যে চিঠির ব্যাপারটা ওদের বাড়ির সবাইকে মিলা জানিয়ে দিয়ে নালিশ করবে না তো? তা করলে তো মাসুদের বাবা-মাকেও অবহিত করা হবে।

এতে মাসুদের উপরে অভিভাবকদের কঠোর শাসন আর তিরস্কার নেমে আসবে। তাছাড়া গ্রামের সবাই জেনে গেলে তো কাউকে মুখ দেখানোর আর উপায় থাকবে না। এরূপ ভাবতেই বুকের মধ্যে ধড়াস করে ওঠে।

মিলাদের পাশের বাড়ির এক ছোট ভাই রুবেল একদিন বললো, মাসুদ ভাই, মিলা আপা আপনাকে দেখা করতে বলেছে।
মাসুদের গলা শুকিয়ে গেল।

উদ্বিগ্নভাবে জানতে চাইলো, কেন?
রুবেল বললো, জানি না।
মাসুদের ভয় আরো বেড়ে গেল।


মিলা কিছুদিন বাড়িতে থেকে যশোর চলে গেল। মাসুদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক, আর ভয় নেই।

এবার সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে লাগলো। সন্ধ্যার পর মিলাদের বাড়ি গেল।

মিলার ইমিডিয়েট বড় বোন নিলার সাথে গল্পের এক পর্যায়ে নিলা মাসুদের শার্টের পকেটে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বললো, মিলা এতদিন বাড়িতে থাকলো, তুই একবারও এলি না কেন? মিলা তোকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে একটা চিঠি দিয়ে গেছে।

নিলার কথার ধরণেই মাসুদ বুঝলো যে মিলা বোধহয় সম্মতিসুলভ চিঠি দিয়েছে। খুশীতে মাসুদ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নেমেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঁচু থেকে বাড়ির নীচের রাস্তার দিকে জোরে দিল এক দৌড়। ও বেমালুম ভুলে গেল যে বাড়ির সামনের রাস্তার পাশেই কাঁদা-পানিতে পূর্ণ একটা ডোবা রয়েছে। এক দৌড়ে একেবারে কাঁদার ভিতরে চলে গেল। হাঁটু পর্যন্ত পা কাঁদার ভিতরে ডুবে গেল। পরনের কাপড় ভিজে গেল।

লজ্জায় নিমজ্জিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো যে কেউ দেখে ফেলেছে কিনা। কিন্তু কাউকে চোখে না পড়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

চুপি চুপি বাড়ি গিয়ে ভেজা কাপড়েই চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরলো।

মিলা লিখেছে,
তোমার চিঠিটা পড়ে জেনেছিলাম যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। সত্যি করে বলবে, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? ভালোবাসলে তো কাছেই আসতে।

কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে অথচ কাছে না আসে তবে তার সাথে ভালোবাসা করে কি লাভ? তোমার আসলে কাউকে ভালোবাসার মত সাহসই নেই, অথচ তাকে ভালোবাসতে চাও।

সমাজে এক ধরণের ছেলে আছে যারা একজন মেয়েকে ভালোবেসে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তাকে নিয়ে দিবা-রাত্রি কল্পনা করে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। তুমিও কি তাদের মধ্যে একজন হতে যাচ্ছ?

আমার চিঠিটা পড়ে যদি বিরক্ত হও তবে তা ছিঁড়ে ফেলে দিও।

ইতি,
মিলা।


নিজের ব্যর্থতার কারণে লজ্জায় মাসুদের মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো।

শরীর প্রায় ঘেমে গেল।

মিলার বাড়ি আসার অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো মাসুদ।

(৩)

কৃষকরা আমন ধান কেটে এনেছে বেশ আগে। বাড়িতে গাদা করে রাখা সেই ধান এখন মাড়াই করে হালটে খোলা বাতাসে ঝাড়ার কাজ চলছে। বাতাস বইছে।

ধান ঝাড়া থেকে সৃষ্ট ধুলার আস্তরণ পড়েছে গাছের পাতায়। মিলা বাড়িতে এসেছে। অনেক সাধনায় সাহস অর্জন করে মিলাদের বাড়ির পাশের হালটে ধানের ধুলা থেকে গা বাঁচিয়ে মিলাদের বাড়িতে গিয়ে মিলাকে ওদের বাড়িতে আসার কথা বলে এল।

চুল ওড়াতে ওড়াতে দৃঢ় পদক্ষেপে সাড়ে এগারটার দিকে মিলা এল।

ঘরের মাটির মেঝেতে পাটির উপরে হাঁটু ভাঁজ করে বুকের প্রায় সমান্তরাল এনে দুই হাত দিয়ে পায়ের উপরে ধরে বসা মাসুদের শরীর ঘেঁষে বসে মাসুদের হাঁটুর উপরে গাল ঠেকিয়ে মিলা বললো, তুমি এতদিন দূরে দূরে রইলে কেন?
‘তুমি’ সম্বোধন শুনে মাসুদের শরীরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো।

আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। মিলার ফর্সা গালের উপরের অংশে তাকিয়ে দেখলো যে সেখানে ঘামের সৃষ্টি হচ্ছে। মিলাকে খুবই কাছের মানুষ মনে হলো।

হঠাৎ বাড়ির লোকজন দেখে ফেলবে এই ভয়ে মিলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ও চলে যাওয়ার পর মাসুদের বুকের ভিতরটা খা খা করে উঠলো।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।