আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি হত্যায় সারা বিশ্বের স্বস্তি?

কি বলব

একবিংশ শতাব্দীতে কী অদ্ভুত আচরণ তথাকথিত ক্ষমতাধর ওই মানুষগুলোর? ওরা বলে, ‘একটি হত্যার ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বের স্বস্তি’। একটি মানুষের কারণে নাকি সারা বিশ্ব এতদিন অস্থির-উদ্বিগ্ন-ওলট-পালট ছিল। এখন সেই মানুষটিকে হত্যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে কথিত স্বস্তি নেমে এসেছে। তাহলে যাকে হত্যা করা হলো সে কি মানুষ, অতি মানুষ না অমানুষ-দানব? আর যারা বিচারবহির্ভূতভাবে তাকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করল, তারা কি মানুষ, অতি মানুষ নাকি অমানুষ-দানব? এর উত্তর বিশ্বের অতীত ইতিহাসে আছে। ভবিষ্যতেও এর নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যাবে।

কথিত সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন বাহিনী ঝটিকা অভিযানে হত্যা করেছে। এতে করে পত্রপত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সারা বিশ্বের একের পর এক স্বস্তি উচ্চারিত হচ্ছে। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামার উক্তি, 'ঔঁংঃরপব যধং নববহ ফড়হব'। অর্থাত্, ‘এই হত্যার মাধ্যমে ন্যায়বিচার করা হয়েছে’। এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, 'উবধঃয রিষষ নত্রহম মত্বধঃ ত্বষরবভ'. অর্থাত্, ‘এই মৃত্যু বিরাট স্বস্তি আনবে’।

ওদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ জনক মি. বুশের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, 'গড়সবহঃড়ঁং ারপঃড়ত্ু ভড়ত্ অসবত্রপধ'। অর্থাত্, ‘এটি আমেরিকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়’। এহেন মন্তব্যসমূহ স্বাভাবিক। কারণ, এরা সবাই মহাক্ষমতাধর একপক্ষ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অপর পক্ষের ক্ষীণকণ্ঠ শোনার সময় এখন নয় এবং শোনাও যায়নি বা যাচ্ছে না।

তবে, ফিলিস্তিনের হামাস গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডের মৃদু তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচ্য তা হলো, একটি বিশেষ ধর্মের নামে হত্যা ও একটি বিশেষ ধর্মের বিরোধিতায় হত্যা। বিন লাদেনের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ হলো, সে ইসলাম ধর্মের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। আর, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, ওরা বিন লাদেন নামক লোকটিকে উপলক্ষ করে মুসলিম বিশ্বের লাখ লাখ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে হত্যা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এহেন নির্মম হত্যাকাণ্ড বাছ-বিচার ছাড়াই প্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে। এখানে উভয়পক্ষ কর্তৃক ধর্মকে সহজ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছেও।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝতে খুবই অসুবিধা হয় যে, সারা বিশ্বে মানবাধিকারের একমাত্র এজেন্সীর দাবিদার যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিন লাদেন নামক একটি মানুষকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করে কীভাবে সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে? বিশ্বজুড়ে নানা রংয়ের নানা ঢংয়ের সন্ত্রাসবাদকে কী করে সমূলে উপড়ে ফেলা যাবে? বিশ্বে কীভাবে স্বস্তি নেমে আসবে? শিশু শিক্ষা থেকে ইতিহাস পর্যন্ত শিক্ষণীয় হলো, ‘একটি হত্যাকাণ্ড আরও হত্যাকে উসকে দেয়’। আর, ‘রক্তের বন্যা, রক্তের স্বাদকে বাড়িয়ে দেয়’। এখানে মানবাধিকারের বা মনুষত্বের কোনো স্থান নেই। এহেন হত্যাকাণ্ড সবই পশুত্বের বহিঃপ্রকাশ। আর এই পশুত্বের করুণ শিকার হয় বেশিরভাগ নিরপরাধ অবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

অথচ, ইদানীংকার গালভরা মানবাধিকারের দাবি হলো, অপরাধী যেই হোক তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে। বারাক হুসেইন ওবামা কিন্তু তার ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে তার দেশের জনগণের কাছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেই শপথই নিয়েছিলেন। তবে, বাস্তবতা হলো বিন লাদেন তো আর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়। গত রোববার ভোররাতে ‘অপারেশন জেরোনিমো’-এর মাধ্যমে মার্কিন নৌকমান্ডোরা লাদেনকে ঘিরে ফেলল।

তাত্ক্ষণিকভাবে মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করে ওবামাকে জানানো হলো ঊকওঅ (ঊহবসু করষষবফ রহ অপঃরড়হ)। অর্থাত্, ‘শত্রু যুদ্ধে নিহত’। হোয়াইট হাউজের অত্যাধুনিক সিচুয়েশন রুম থেকে বিশ্বের মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামা সাঙ্গপাঙ্গসহ প্রত্যক্ষ করলেন একবিংশ শতাব্দীর একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তখন বলা হয়েছিল, ‘লাদেন সশস্ত্র প্রতিরোধ করেছিল। ’ এজন্য তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

এখন ওরাই বলছে, ‘লাদেন নিরস্ত্র ছিল’। তাহলে অর্থ দাঁড়াল, নিরস্ত্র একটি মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন? নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। মৃত লাদেন নাকি জীবিত লাদেনের চেয়ে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই, লাদেনকে ফেলে দেয়া হয়েছে মার্কিন রণতরী কার্ল ভিনসেন থেকে উত্তর আরব সাগরে অজানার উদ্দেশ্যে।

এখন দেখার বিষয় যে, মৃত লাদেন জীবিত লাদেনের চেয়ে কত শক্তিশালী? আসলে, পশ্চিমা শক্তির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন উক্তি ও কর্মকাণ্ড আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং বিশ্ববাসীর কাছেও অজানা নয়। ক্ষমতা ও সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারার খপ্পরে কেউ কেউ বা কোনো কোনো দেশ অস্পষ্ট ভাষায় হয়তো কিছু বলছে অথবা নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করছে। লাদেনের বিরুদ্ধে টুইন টাওয়ার ধ্বংসসহ যুক্তরাষ্ট্রে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে বিগত প্রায় দশ বছর হলো। অথচ, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ডজন ডজন গবেষক বিজ্ঞানী আজও প্রমাণ উপস্থাপন করছেন যে, ওইসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অপকর্ম শুধু আফগানিস্তান নামক মুসলিম দেশটি আক্রমণের অজুহাতে। এর প্রমাণ তো ইরাক আক্রমণের কারণ থেকেই স্পষ্ট।

বলা হয়েছিল, সাদ্দাম কর্তৃক ইরাকে ডবধঢ়ড়হং ড়ভ গধংং উবংঃত্ঁপঃরড়হ (ডগউ) লুক্কায়িত আছে। কিন্তু, কই ইরাক আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও সেই ডগউ নামক ভয়ঙ্কর বস্তুগুলোর টিকিটি এখনও মিলছে না কেন? বুশ, ব্লেয়ার, কন্ডোলিসা রাইস ও জেনারেল কলিন পাওয়েলরা এহেন বিষয়ে শুধুই ভুল হয়েছে বলেই খালাস ও এখন পর্দার আন্তরালে। আর, সব দোষ এখন সিআইএ ও এমআই-৬ এর। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র পৃথিবী এখন নানাভাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় উপনীত। তবে, এও সত্য যে, যে দেশ দুটি বস্তুত সিআইএ ও এমআই ৬ শাসিত তাদের কর্মকাণ্ড এর চেয়ে ভালো কি কিছু হতে পারে? এর চেয়ে ভালো আচরণ ওরা প্রদর্শন করতে পারে না।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সার্বিক আচরণ যেমন এক নয়, তেমনি ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ জনগণও কিন্তু এক নয়। ইসলামসহ পৃথিবীর সব ধর্মই শান্তির প্রবক্তা। যে কোনো ধর্মেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একেবারেই অগ্রহণীয় ও জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। কোরআনের ভাষায় তাই বলা হয়েছে, ‘যে কেউ একজন নিরপরাধ (বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে) মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল। আর যে কেউ একজন নিরপরাধ মানুষকে রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করল।

’ এখানে মানবাধিকারের এজেন্সিপ্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাব কী হতে পারে তা বিবেচনার ভার বিজ্ঞ পাঠকদের উপরই রইল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.