আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিহত ওসামা বিন লাদেন ও বিশ্বশান্তির ভবিষ্যৎ পথরেখা



নিহত ওসামা বিন লাদেন ও বিশ্বশান্তির ভবিষ্যৎ পথরেখা ফকির ইলিয়াস ========================================= ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। ১ মে ২০১১ রোববারের সন্ধ্যাটি যুক্তরাষ্ট্রবাসীর জীবনে এমন একটি বহুল প্রত্যাশিত সংবাদ নিয়ে এসেছিল। রাত পৌনে এগারোটার দিকে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ করেই থেমে গেল প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানমালা। বিজ্ঞাপন বিরতি।

এর ক'মিনিট পরই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল বড় বড় অক্ষরে 'ওসামা বিন লাদেন ইজ ডেড'। ঠিক দেখছি তো? টিভির চ্যানেল পাল্টাই। হ্যাঁ, সব চ্যানেলেই সমান শিরোনাম। সরগরম হয়ে উঠেছে হোয়াইট হাউস ততক্ষণে। মিডিয়ার বিশেষজ্ঞ আর সমাজ বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন চ্যানেলে তাদের মতামত দিতে শুরু করেছেন।

ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। টিভি চ্যানেলগুলো জানাল, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ক'মিনিটের মধ্যেই। রুদ্ধশ্বাস নিয়ে টিভি দেখছি। রাত ১১টা ৩৬ মিনিটে প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসের প্রেসরুমের লাল গালিচায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি সম্মানিত আমেরিকান ও বিশ্ববাসীর কাছে রিপোর্ট করতে এসেছি।

কিছু ভূমিকা টেনে প্রেসিডেন্ট বললেন, একটি 'ফায়ার ফাইট'-এর মাধ্যমে পাকিস্তানে ইসলামাবাদের কাছাকাছি 'অ্যাবটাবাদ' নামক স্থানে একটি সুরক্ষিত কম্পাউন্ড ভবনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে মার্কিনি বিশেষ কমান্ডো বাহিনী। প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে বলেন, গত ১০ বছর থেকেই আমরা তাকে খুঁজে আসছিলাম। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১-এর হত্যাযজ্ঞের হোতা এই বিন লাদেন ছিলেন একজন চরম সন্ত্রাসী। অবশেষে আমরা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সমর্থ হই। গত আগস্ট মাস থেকেই আমরা সেই গোপন কম্পাউন্ডটিকে ঘনিষ্ঠ নজরদারিতে রাখি।

গেল একমাস থেকে আমরা নিশ্চিত ছিলাম লাদেন এখানেই আছেন। অবশেষে গত সপ্তাহে আমি 'কমান্ডার ইন চিফ' হিসেবে অর্ডার দিই যেন অপারেশন সাকসেসফুল করা হয়। প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা বিনা রক্তপাতে, কোন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি না ঘটিয়ে সেই অপারেশন সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, চৌকষ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টিম হেলিকপ্টারযোগে সেই কম্পাউন্ডে নেমে অপারেশন সম্পন্ন করেছে। প্রেসিডেন্ট বলেন, একটি ফায়ার-ফাইটে বিন লাদেন নিহত হয়েছেন এবং তার মরদেহ মার্কিন বাহিনী বুঝে নিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এই ভাষণের পরপরই গোটা বিশ্বের মিডিয়াগুলো তা প্রচার করতে থাকে বারবার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। 'জাস্টিস হ্যাজ বিন ডান' শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে বিভিন্ন এলাকা। বড় বড় শহরগুলোতে তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। প্রেসিডেন্টের ভাষণটি শেষ করার পরপরই বিভিন্ন মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা টকশোতে অংশ নেন।

কী হচ্ছে, কী হতে পারে তা-ই ছিল আলোচনার বিষয়। সন্দেহ নেই, বিন লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। বিশেষ করে এগারো সেপ্টেম্বর ২০০১-এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞের পর লাদেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থারা তাকে কাছে পেয়েও ধরতে কিংবা হত্যা করতে পারেনি বলেও কথিত আছে। ৫৪ বছর বয়স্ক এ কট্টরপন্থি মৌলবাদী নেতা দুনিয়া কাঁপানো আল কায়দার প্রধান ছিলেন।

তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়েও তার সখ্যতা ছিল বলে অনেকেরই ধারণা। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, গেল একবছর থেকেই বিভিন্ন শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিল লাদেনের সেই ভবনটি। ১২ থেকে ১৮ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপরে ছিল কঠিন লৌহ তারের বেষ্টনী। এই ভিলাটি ছিল আশপাশের বাড়িগুলোর চেয়ে প্রায় আট গুণ বড়। যার মূল্য হতে পারে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার।

গোয়েন্দারা শুরু থেকেই এই বাড়িটিকে সন্দেহ করে আসছিলেন। ভেতরের তিন তলা একটি ভবন ছিল মূল টার্গেট। দুটি 'কাস্টম বিল্ট' গেইট ছিল বাড়িতে। গত সপ্তাহে বাড়িটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বাড়িতে কোন ফোন সংযোগ কিংবা ইন্টারনেট কানেকশন ছিল না।

ওই বাড়ির বাসিন্দারা তাদের বর্জ্য পদার্থ (গার্বেজ) বাইরে ফেলতেন না বা গার্বেজ সংগ্রহও করতে দেয়া হতো না। তারা তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যের বর্জ্য নিজেরাই পুড়িয়ে ফেলতেন। ওই বাড়িটির মালিক ছিলেন দুই ভাই। পাকিস্তানি নাগরিক এবং সেপ্টেম্বর ইলেভেনের আরেক রূপকার খালেদ শেখ মোহাম্মদ এদের নেপথ্যে একজন। ১ মে রোববার মধ্যরাতে মার্কিন কমান্ডোর একটি বাহিনী দুটি হেলিকপ্টারযোগে কম্পাউন্ডের ভেতরে অবতরণ করে।

তারপর তারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। মার্কিন সেনাসূত্রের বরাতে প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী এ 'ফায়ার ফাইটে' বিন লাদেন কমান্ডোদের উদ্দেশে গুলি ছুড়েন। পাল্টা গুলিতে তিনি মাথায় ও মুখমন্ডলে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং দেহত্যাগ করেন। এ ফায়ার ফাইটে লাদেনের ছেলে এবং আরও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নিহত হন। মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত একজন মহিলা লাদেনকে বাঁচাতে গিয়েও নিহত হন।

দুই বিশ্ববাসী ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, বিন লাদেনের মরদেহ আফগানিস্তানে পাঠানো হয়। সেখানে তার শেষকৃত্যের প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ শেষ করে দেহটি সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন বলেছে, তারা চায় না লাদেনের কবরকে ঘিরে কোন সমস্যা সৃষ্টি হোক। কোন কোন মিডিয়ায় মৃত লাদেনের মুখমন্ডলের ছবি দেখানো হয়েছে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছেন ঐ ছবি ফটোশপে বানানো।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্যমতে, অপারেশনে অংশগ্রহণকারী কমান্ডোরা শক্তিশালী হ্যালমেট রেকর্ডার ব্যবহার করেছেন, যাতে পুরো দৃশ্য রেকর্ড করা হয়েছে । তা মার্কিন প্রশাসন জনসমক্ষে প্রকাশ করবে কি না তা সময়ের বাঁকবদলই বলতে পারবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মধ্যদিয়ে এটা নিশ্চিত যে, বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে। একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, বিন লাদেনকে এমন একটি সময় হত্যা করা হয়েছে যখন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১২-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি তার প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানদের সমালোচনায় এতটাই বিরক্ত যে গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক সফরকালে তিনি মিডিয়ার কাছে তার বার্থ সার্টিফিকেটের ফটোকপি দিয়ে দিয়েছেন।

কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছেন না-কি কেনিয়ায় জন্ম নিয়েছেন তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলে আসছিল। তা নিরসনে তিনি বার্থ সার্টিফিকেট 'পাবলিকলি' ছেড়ে দিয়েছেন। প্রিন্ট মিডিয়া তা প্রকাশও করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওবামা 'হাওয়াই' অঙ্গরাজ্যে জন্মেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না বারাক ওবামার জনপ্রিয়তায় ব্যাপকভাবে ধস নেমেছে।

বিশেষ করে হেলথ কেয়ার ইস্যু, গ্যাস ও তেলের মূল্যের তীব্র ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মন্দা ওবামার জনপ্রিয়তায় আঘাত হেনেছে। তিনি তা থেকে উত্তরণের নানা পথ খুঁজছিলেন। ঠিক এমন সময়েই বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে রাতারাতিই ওবামা তার জনপ্রিয়তা ফিরে পাবেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিন লাদেনকে কি গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল? হত্যার জন্য মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করা হচ্ছিল- এমন প্রশ্নও আসছে। কারণ মার্কিনি টপ গোয়েন্দারা যে ১০ বছরেও লাদেনের নিশানা চিহ্নিত করতে পারেনি তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বারাক ওবামা তার দেয়া ভাষণে বলেছেন, ইসলাম ধর্ম কোন হত্যাযজ্ঞ, সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না। তার কথাটি অবশ্যই সত্য। 'মানব বোমা' তৈরির মাধ্যমে বিন লাদেন গোটা বিশ্বে যে সন্ত্রাসের গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন, এমন তত্ত্বকে তো ইসলাম ধর্ম কখনই স্বীকৃতি দেয়নি। তারপরও লাদেন ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রজন্মের সঙ্গে প্রতারণার পথ বেছে নিয়েছিলেন। লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বশান্তির পথ কতটা প্রশস্ত হবে তা বলা খুবই কঠিন কাজ।

তবে তাকে হত্যার মাধ্যমে বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে একটি ম্যাসেজ দেয়া গেছে, তা খুবই সত্য। ২০১২-এর নির্বাচনে বারাক ওবামা জয়ী হতে পারবেন কি-না, তাও এ মুহূর্তে বলা যাবে না। কারণ মার্কিনিরা খুবই বিচক্ষণ জাতি। তারা ভোটের রায় দেয়ার সময় নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। তবে তারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক এটা চান মনে-প্রাণে।

সেই শান্তির পথে এগিয়ে যেতে বিশ্বের নেতারা কতটা ইতিবাচকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন, তা-ও দেখার বিষয়। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন নিউইয়র্কজুড়ে বিরাজ করছে কড়া নিরাপত্তা অ্যালার্ট। দৈনন্দিন কাজ-কর্ম চলছে ঠিকমতোই। না, বিন লাদেনকে নিয়ে মানুষের অতি-আগ্রহ নেই। কিছু কিছু সদর রাস্তায় মানুষের তাৎক্ষণিক উল্লাস হলেও তা ছিল খুব কম সময়ের জন্য।

আমেরিকানরা নিজেদের রুটি-রুজির ধান্দা নিয়েই ব্যস্ত। শান্তিপূর্ণভাবে নিজের জীবন বাঁচাতে হবে, সেটাই তাদের প্রত্যয়। নিউইয়র্ক , ৩ মে ২০১১ -------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা/ ৬ মে ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- ভ্লাদিন্সাভ প্লাডিমিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.