আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্ভাবনার যুগ: রজার কোহেন



ইউরোপকে মুক্ত করেছে বার্লিন দেয়ালের পতন। কিন্তু এর ব্যাপক প্রভাব একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে এসেই কেবল স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। আমাদের লোভের ফলে আরো একটা দেয়াল যে ধসেছে তা আমরা দেখতে পাইনি। তুর্কি ও সিরিয়ার মাঝে সর্ম্পকের কথাই ধরা যাক। তুর্কি যেখানে ন্যাটোর সদস্য দেশ, সেখানে সিরিয়া তখনকার সোভিয়েত বৃত্তের একটি দেশ।

৫৪০ মাইলব্যাপী বিছানো ৬০,০০০ ল্যান্ডমাইন এই দুই দেশের সীমানা এলাকাকে একসময় অচল করে রেখেছিলো। এখন এই দুই দেশে ভিসা-মুক্ত সীমানার সুবিধা নিয়ে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চলে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতন্ত্র বা এর ওপর নির্ভরশীল দেশ, যেমন বুলগেরিয়া এবং জর্জিয়া একইভাবে তুর্কিকে তাদের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করছে। তুর্কি এখন আর পাশ্চাত্যের শেষপ্রান্ত নয়, দেশটি ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটা ইউরেশিয়ারও অন্তুর্ভুক্ত করে নিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের কালে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর লড়াইয়ের আধিপত্যের শিকার আফ্রিকাও এরই মধ্যে সেই সময়কার আদর্শগত বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে।

আফ্রিকা প্রতিবেশি দেশগুলোর _ যেমন দণি আফ্রিকা এবং মোজাম্বিকের_ নতুন পথই শুধু অনুসরণ করে থেমে থাকে নি। আফ্রিকা চীনের সাথে নিজেদের ২০০০ সালের দশ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যকে আজ ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে ফেলেছে। ২০১১ সালে আফ্রিকা আশা করছে, তা ৫.২ শতাংশ বাড়বে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়দের অনুমানের তুলনায় এ হার দ্বিগুণেরও বেশি। কোকাকোলার প্রধান নির্বাহী কোম্পানিটির সর্বোচ্চ বিনিয়োগের অন্যতম অঞ্চল হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশকেই বিবেচনা করছে। বার্লিন থেকে যে গভীরতর, ধীর গতির নতুন স্রোতের শুরু হয়েছিলো তারই অংশ এসব পরিবর্তন, বর্তমানে তা শুধু লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠেছে।

যদিও দুই দশক আগেও পশ্চিমাজগত একটা অখণ্ড ও মুক্ত ইউরোপকে স্বাগত জানিয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলো, আজকের বিশ্ব নিয়ে তাদের এই সুখে অনেকটাই ভাঁটা লেগেছে, যেখানে এই বিষয়টা সহজেই পাশ কাটানো হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধকালে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের তিক্ত-শর্ত-তালিকা বর্তমানে সীমাতিরিক্ত মুক্ত প্রস্তাবনায় রূপান্তরিত হয়েছে। পেরুভীয়-ভারতীয় সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে কী বলা যায়? আমেরিকার কেন্দ্রীয় অবস্থান ধসে গেছে; ইউরোপ রাজনৈতিকভাবে প্রান্তে চলে গেছে; আর পশ্চিমের সম্মানিত সদস্য জাপান তো একবারেই নিরাশ। আজকাল পশ্চিমা কূটনীতিকরা অভিযোগ তোলেন, “কোথায় আমাদের প্রভাবপ্রতিপত্তি ?” যেমন ইরানের কথা যদি বলি সেখানে তাদের প্রতিপত্তি তো প্রায় নেই বললে চলে। যাইহোক, এখনো উচ্ছ্বাস ঠিকই রয়েছে তবে তা আছে অন্যখানে।

ল্যাটিন আমেরিকা ইতোমধ্যেই পুরোনো প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং আবদ্ধদশা অতিক্রম করে ফেলেছে। বর্তমানে চীন এবং ভারতের সাথে লাতিন আমেরিকা বাণিজ্য করছে। আফ্রিকাতেও নতুনভাবে সুযোগ করে নিতে চাচ্ছে। তারা জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ আর অনিশ্চয়তায় ব্যতিব্যাস্ত_ এ নিয়ে লাতিন আমেরিকার মাথাব্যাথা নেই বললেই চলে। “অধিক আত্মপ্রত্যয়ী আজকের লাতিন আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংস নিয়ে কোনভাবেই চিন্তিত নয়।

” ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এর প্রেসিডেন্ট লুই আলবার্তো মোরেনো আমাকে বলেছিলেন: “আফ্রিকা বরং এখন এশিয়ার দিকেই বেশি ঝোঁকছে। আর এশিয়ার দেশগুলো আফ্রিকায় বিনিয়োগেও ব্যাপক আগ্রহী। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা ভেঙে পড়েছে। এদিকে আমেরিকার সাথে কলম্বিয়া এবং পানামার মুক্তবাণিজ্য চুক্তি অবহেলিত হচ্ছে। ” পশ্চিমাবিশ্ব এখন দুশ্চিন্তায় ডুবন্ত, হতাশ, এবং ছিটকে পড়া।

অন্যদিকে তুখোর, অনুসন্ধানী ব্রাজিল ও তুর্কির মতো সাউথ আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো এক নতুন বিশ্বের উত্থান ঘটাচ্ছে। এখনকার বৈশ্বিক বিভাজন অনিবার্যভাবেই সক্রিয় রয়েছে পশ্চিমা আর এই নতুন বিশ্বের মাঝে। সময় ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে ভেবে পশ্চিমারা এরই মধ্যে উশখুশ করছে। বিপরীতে, অনেক দেশ ভাবছে, এখনই তাদের সময়_ কিংবা এইতো নিকটে। এক নতুন দুর্ভাবনার যুগ নিয়ে পশ্চিমে আজকাল আলাচনা হলেও তারা খ্যাপামোর ভেতরেই এখনো আটকে রয়েছে।

আসলে অস্বস্তির কারণ আর কিছুই নয়, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো অর্থনীতি থেকে অনেক দূরেই পড়ে রয়েছে, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই অর্থনীতিতে ভাগ বসিয়েছে। সমস্যাটা সেখানেও। অতি-হ্রাস, ব্যাপক বেকারত্ব, বেশি বয়সে সন্তান ধারণ এবং আকস্মিক অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ_ সবগুলো সমস্যাই বেশ কঠোর। সংকটগুলোকে অনেক বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মজার অর্থকড়ি ফুরিয়ে গেছে।

কিন্তু বিদেশী রাষ্ট্রে ঘেরা অতিগরীব আর গাধার খাঁটুনীর করিডোরগুলোতে বিশ্বের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ এসবের বাইরেই পড়ে রয়েছে। কয়েক বিলিয়ন লোকের সুযোগ সংকোচনের চেয়ে বলা যায় বেশি প্রসারিতই হচ্ছে, যদিও তা হচ্ছে খুব অসমতার ভেতর দিয়েই । সব মিলিয়েই বলা যায়, যুগটা আসলেই সম্ভাবনার। নাটকীয় পরিবর্তনের এই সময়টা বিপজ্জনক। উনবিংশ শতাব্দির জার্মানির কথা ভাবুন।

ইউরোপীয় মঞ্চে একীভূত এক জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানের যে অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ ঘটেছিলো, এক শতাব্দির রক্তপাত এবং যুদ্ধ ছাড়া অন্যকিছু এই সংকটের সমাধান দিতে পারেনি। বিশ্বের সংঘাতগুলোর দিকে তাকান, দেখবেন তা বিংশ শতাব্দিতে আমেরিকার উত্থানকে যেমন নিশ্চিত করেছিলো, তেমনি ব্রিটিশ সামাজ্যের অবসানকেও ঘনিয়ে তুলেছিলো। আমি বিশ্বাস করি না, আজকের দিনে শক্তির এই রূপান্তর প্রক্রিয়া কোনদিক দিয়ে কোন অংশে কম নাটকীয়। এ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ের ভেতর চীন সুবিশাল নির্মাণ কাজে সার্বিক উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, আগামি শতাব্দির শুরুতেই এক্ষেত্রে এ দেশটি প্রাধান্য বিস্তার করবে। এর মধ্যেই চীন লক্ষ্যযোগ্য সম্পদ সৃষ্টি করে ফেলেছে।

আমি গত শরতে এরিক ডি রথচাইল্ডের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি বর্দো মদের খুবই সফল এক প্রতিষ্ঠান চাটু লেফাইট রথ চাইল্ড-এর পরিচালক। ‘আমি জানি যেসব চীনা লোকজন ১৯৮২-এর মদের বক্স কিনতে চাইতো এবং পান করার জন্য দিনের পর দিন মুখিয়ে থাকতো,’ তিনি বললেন, ‘ এখন তাদের প্রশংসা না করে পারি না, সেই চীনা লোকজনই এই মদের দাম শোধ করার সামর্থ্য ইতোমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছে, তারা এখন একটা করে নির্মিয়মান অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে ব্যাকুল। ” বৈশ্বিক আলোড়নের কথা ভাবুন: নতুন সম্পদ পুরোনো সম্পদের জায়গা দখল করছে। কিন্তু আলোড়ন অবশ্যই অস্থিরতা তুমুলভাবে বাড়ায়।

আমেরিকা এবং ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন এখন দেখতে পাচ্ছে দ্রতবিকশমান চাকরিগুলো গোয়াঙজো এবং বাঙ্গালোরে চলে যাচ্ছে; দেখতে পাচ্ছে যেসমস্ত বাড়ির জন্য তারা বিশাল অংকের টাকা ধার করেছে, তার মূল্য একেবারেই পড়ে যাচ্ছে; জীবনধারণের মান ধরে রাখতে তারা এমনকি অধিক সময় ধরে কাজ করছে, এবং প্রযুক্তি-প্রিয় আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছে; তারা টের পাচ্ছে অসমতা বাড়ছেই, আর ধনীরাই আরো ধনী হচ্ছে; তারা স্বাস্থ্যসেবা, অবসর ভাতা ইত্যাদির মতো সামাজিক সুবিধাগুলো বজায় থাকবে কিনা ভেবে বরং এখন বিস্মিত হচ্ছে। তারা ছিলো অতি-ক্ষমতাধর, এবং এখন তা অপ্রয়োজনীয়ই ঠেকছে তাদের কাছে। এক কথায়, এডমুন্ড মুঙকে’র “চিত্কার” ছবির সাথে তারা দিনকে দিন একাকার হয়ে পড়ছে। কে হবে বলির পাঁঠা এরই মধ্যে তোড়জোরে তা খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। যে সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলন এই বলির পাঁঠার খোজখবর দেয়, সেসব আন্দোলনও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

টি পার্টির উত্থান আমেরিকার এমনই একটা আন্দোলন। এমনকি জার্ট উয়াইল্ডার্সের ইউরোপেও তা এর মধ্যে জোরেসোরে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরও, চিন্তিত নই আমি। এক গুচ্ছ নতুন এবং স্বতন্ত্র উপাদান নিয়ে একবিংশ শতাব্দির সূচনা হয়েছে, তা আশা জাগানিয়া বলে মনে করি আমি। আমার মনে হয়, সন্ত্রাসী তত্পরতার ফলে যে বিপুল বিপর্যয়ের ভেতর আমরা পড়েছি তা এড়িয়ে যেতে পারবো আমরা।

প্রথম উপাদানটা, সামাজিক নেটওয়ার্কের ওয়েব। সারাবিশ্বেই তা ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ধ বিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা গড়ে তুলছে। এসব দায়গ্রহীতার চাহিদা অনুসারে এ সুরক্ষা খুবই কম মনে হতে পারে, কিন্তু একে উপক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব। এর সাথে যুক্ত থাকায় তাদের ভাবনা-চর্চায় বহুদিক দিয়ে জাতি-সীমা মুছে যেতে থাকে, ফলে বড়ো ধরনের সীমানাবিরোধ বাধানো দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়টা, এশিয়ায় আমেরিকার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি, দ্রুত পরিবর্তনশীল এলাকাগুলোতে। এ উপস্থিতি চীনের উত্থানের ফলে ক্ষমতার যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে তা হ্রাস করে, এবং অন্যান্য দেশকে নিশ্চিন্ত রাখে। পেক্স আমেরিকানা জোট অকেজো হয়ে পড়েনি এখনো। তৃতীয়টি, ৯/১১ এর পর থেকে আমেরিকার যুদ্ধাবস্থা প্রায় এক দশক অতিক্রম করলো। এর ফলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার ব্যয়সংকোচনের যে পক্রিয়া চালু করলেন তা আরো কিছুটা সময় নেবে।

চুতর্থ উপাদানটি, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নিয়ে চীনের মাথা ঘামানো। বেইজিংয়ে বাত্সরিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অপরিহার্য শর্তের ভেতর এই ঘটনার দেখা মেলে, যা পরিণামে কমিউনিস্ট শাসনকে স্থিতি দেয়। এবং পঞ্চমটা হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে গভীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। এই আন্তঃসম্পর্ক এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এর কোন প্রকার ক্ষতি উভয়েরই কাছে একবারেই অসহনীয়। অতএব, বলা যায় এই সব তাত্পর্যপূর্ণ স্থিতিপ্রদ শক্তিসমুহ ক্রিয়াশীল রয়েছে, যারা নতুন এক বিশ্বেরই জন্ম দিচ্ছে।

সব কারণ মিলিয়েই বলতে হয়, সম্ভাবনাই এক নতুন প্যরাডাইম বা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের হোতা। কিন্তু আমেরিকা নিয়ে আমার ধারণা হলো, এমনকি ওবামা শাসনের অধীনেও, পুনরায় বিশ্ব-ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার দাবী পূরণের বদলে আমেরিকা আগেকার নিয়ন্ত্রণশক্তি ধরে রাখার ভান করে চলেছে। এই আচরণ উদ্বেগকেই উসকে দিচ্ছে আরো। সারাবিশ্বের প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও, চাচ্ছে এমন একটা পুনর্গঠনকে নিশ্চিত করতে যা পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে। কোন পেশাদারী কাঠামোর অর্থপূর্ণ সমর্থন না পেলেও জি-২০ একটা পদক্ষে, কিন্তু তা কোনভাবেই যথেষ্ট নয়।

অর্থের অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে তো বাড়ছেই। তদুপরি, কিভাবে এর সমাধান হতে পারে এ বিষয়েও কোনধরনের চুক্তি কোন সম্মতি পাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত ভাবনা বজায় রয়েছে। যে ভাবনা এখনো তুর্কিকে পশ্চিমের সাথে সুসম্পর্কিত মনে করে না। অথবা তারা কল্পনা করে যে তাদের দ্বিমুখী অবস্থান, যেমন ইজরাইয়েলের নিউকিয়ার অস্ত্র নিয়ে তাদের ইঙ্গতপূর্ণ সমর্থন, কারো চোখে পড়ছে না।

তারা মনে করে, বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের কোন অংশকে, যেমন হিজবুল্লাহ এবং হামাসের, কোনভাবেই কাজে লাগানো যাবে না। কিংবা তারা এও কল্পনা করে, ইরানে বোমা ফেলার বিষয়টি বিপুল ধ্বংসলীলার নকশা নয়। এ সব নিয়ে এখনো নতুন করে ভাবা দরকার, বিশেষ করে ক্যাপিটল হিল নিয়ে। এর ফল, বারাক ওবামার শুরুর দিককার বক্তৃতায় যে ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাবনা ছিলো, বাস্তবে তিনি অনেক কমই তেমন পরিবর্তনের পক্ষে আছেন। পবিত্র ভূমির ওপরের দেয়াল আশাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার পরিবর্তনের মূলমন্ত্র থেকে ক্রমেই সরে আসছেন, তার ওপর বিচ্যুত আদর্শবাদিতা এমন একটা সময়ে চাপানো হয়েছে, যখন কিনা যুক্তরাষ্ট নতুনভাবে এগুতে ব্যাকুল হয়ে আছে। অন্যকোথাও ঠিকই এই নবায়ন ঘটছে। যেমন তুর্কিতে এ বছর ৭% প্রবৃদ্ধি হবে, নিঃসন্দেহে এ এক বড়ো অর্জন। আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের স্থপতি কামাল আতাতুর্কের প্রবল ধর্মনিরপেতা, এবং ক্ষমতাসীন একেপি পার্টির উদার ইসলামিক মতাদর্শের মাঝে তীব্র দ্বন্ধ এখনো চলছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সার্বিকভাবে বিষয়টি সন্তোষজনক: তুর্কির চলমান এই দুই মতাদর্শের সংমিশ্রণ দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে এবং আধুনিকতার সাথে ইসলাম টিকতে অক্ষম বলে চালু কথাবার্তা একবারেই যে ফাঁকাবুলি তাও প্রমাণিত হচ্ছে।

‘সভ্যতার-সংঘাতে’র অনুসারীদের বিশ্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ইস্তাম্বুল এক নগ্ন কটাক্ষ। তুর্কির চেতনাগত লড়াই শেষ হয়েছে, দেশটির নতুন দৃষ্টিভঙ্গী এখন মনে হচ্ছে পরিস্কার: ‘তুর্কির ভৌগলিক অবস্থার কারণেই এদেশ পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন মেনে চলে না। ’ পররষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দেবোতাগলু এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন: “ আমরা পশ্চিমে হলেও এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোর একটি। আমরা ইতিহাসের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। স্নায়ুযুদ্ধ একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

লৌহ দেয়াল কেবল বার্লিনকে ঘিরেই ছিল না, ছিল আমাদেরকে ঘিরেও। আর তাই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্কও ছিলো না আমাদের। ” সে বলতে লাগলো: ‍“আমরা বুঝতে পেরেছি, আমাদের অঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার জন্য আপনাদেরকে অবশ্যই নতুন কোন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে, এবং এর অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন থেকেই কথাগুলো উঠে আসতে হবে, বাইরে থেকে কিছু আরোপ করলে চলবে না। ” দেবোতাগলু পাশ্চাত্যের দ্বি-মুখী নীতি নিয়ে হতাশ:“ আফগানিস্তানে যখন আমরা সক্রিয়, তখন তারা কিন্তু বলেনি, আমরা প্রাচ্যে নতুন ধরনের পরিবর্তন আনছি। আফগানিস্তানের অবস্থান ইরানের চেয়ে আরো দূর প্রাচ্যে।

কিন্তু আমরা সবাই প্রাচ্যে আছি বলে আফগানিস্তানের প্রতিটি লোকই খুশি। ” এই ২০১০ বছরটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আল-কায়দার ধ্বংসাত্মক আক্রমণের এক দশক পূর্তি হয়েছে, যে কারণে নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের প্রায় তিন হাজার লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। অপরদিকে এখনকার চলতি ভাবনা হলো, আমেরিকা আফগানিস্তান দখল করেনি_ ‘শান্তির জন্য বর্বর যুদ্ধ’ চালানোও বিনা কারণে নয়। ১০২ বছর পরেও কিপলিঙের পংক্তিগুলো আজও কত প্রাসঙ্গিক ঠেকে_ ‘যেসব বন্দরে তোমরা করবে না প্রবেশ, আর তোমরা হাঁটবে না যেসব পথে জীবিতদের নিয়ে যাও, নির্মাণ করো সেসব আর চিহ্নিত করো তাদের নিহতদের দিয়ে। ’ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, এবং এমনকি কোন পথে তারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে, এবং কোন মাত্রায়, স্পষ্ট সেটাও।

এই নতুন শতাব্দি তো এখনো অনির্ধারিত একটা বিষয়; আসলে যারা এ নিয়ে অনেক সতর্ক রয়েছে এবং এ বিষয়ে নিয়োজিত রয়েছে, তারাই প্রশ্নটাকে ভয়ংকরভাবে উস্কে তোলে যা উদ্বেগজনক। একইসাথে, এ উদ্বেগ তো ক্রমশ বাড়ছেই। উত্স: ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন। অনুবাদ: জানুয়ারি ২০১১

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।