আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিপীড়নের শিকার ৮০ শতাংশ মেয়েই স্কুলছাত্রী



নাজনীন আখতার ॥ বগুড়ার সান্তহার সরকারী কলেজের একাদশ শ্রেণীতে সবেমাত্র অঙ্ক ক্লাস শেষ হয়েছে। শিৰক বেরিয়ে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব নিয়ে গল্প করছিল। অপেৰা করছিল পরবর্তী ক্লাসের জন্য। হঠাৎ করেই সদলবলে কয়েক বখাটে ক্লাসে এসে ত্রাস সৃষ্টি করে। তাদের লক্ষ ক্লাসের একটি মেয়ে।

আতঙ্কিত শিক্ষার্থীদের রুম থেকে বের করে দিয়ে মিজান নামে এক সন্ত্রাসী দরজা-জানালা বন্ধ করে মেয়েটিকে হুমকি দেয়া শুরু করে। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই যদি আমাকে বিয়ে না করিস তাহলে তোর জীবনের 'শেষ খবর' করে দেব। পরে শিৰকদের কাছে মেয়েটি জানায়, ওই বখাটে দীর্ঘদিন ধরে তাকে কলেজে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করছে। সংশিস্নষ্টরা বলছেন, যৌন হয়রানির ঘটনাগুলোর বিস্তার ঘটছে শিৰা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে। বখাটে-সন্ত্রাসীরা স্কুল ও কলেজকেই টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে।

স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ছাত্রীর পিছু নেয়া, প্রেমের প্রসত্মাব দেয়া এবং অশস্নীল কথাবাতর্া বলা ও অঙ্গভঙ্গি করার সবচেয়ে সহজ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে বখাটেরা। যৌন হয়রানির শিকার ৮০/৮৫ শতাংশ মেয়েই স্কুলছাত্রী। তারা স্কুলে যাতায়াতের পথে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়। শিৰা প্রতিষ্ঠানের গ-ির ভেতরেও উত্ত্যক্ত হচ্ছে নারী। তা তিনি শিৰাথর্ী হোন বা শিৰিকাই হোন।

স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটের যৌন হয়রানির শিকার রম্নপালি নামে এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে গত বছর। শেরপুর উপজেলার সীমাবাড়ি এসআর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী রম্নপালিকে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে প্রায়ই বখাটে সুশীলের উৎপাতের মুখে পড়তে হতো। পরিবার থেকে বিষয়টি জানতে পেরে দরিদ্র পিতা মেয়েকে পড়তে যেতে বারণ করেন। কিন্তু লেখাপড়া চালিয়ে যেতে রম্নপালির ছিল অদম্য ইচ্ছা। ঘটনার দিন সকালে রম্নপালি কিছু না খেয়েই প্রাইভেট পড়তে বাড়ি থেকে বের হয়।

মা তাকে বার বার খেয়ে যেতে বললে তাড়াহুড়ো করে সে জানায়, এখন হাতে সময় নেই। স্কুলে যাওয়ার আগে খেয়ে যাবে। কিন্তু রম্নপালির আর খাওয়া হয়নি। নিঝুড়ি গ্রামে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে বখাটে সুশীল তার পথরোধ করে জোরপূর্বক মাথায় সিঁদুর দিয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখে। এ ঘটনার পরপরই রম্নপালি ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।

রাজধানীর শঙ্করে অবস্থিত আলী হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ঝুমুর আরা সুস্মিতা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আয়োজিত এক কর্মশালায় বিষণ্নতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল 'প্রায়ই শুনতে হয়_ এখনকার মেয়েরা পশ্চিমা পোশাক পরে, অশস্নীল পোশাক পরে, সে কারণেই ছেলেরা বিরক্ত করে। কিন্তু আমরা তো স্কুলে ইউনিফর্ম পরে যাই। তাহলে আমরাই কেন এ ঘটনার বেশি শিকার হচ্ছি?' বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী স্কুল ও কলেজছাত্রীদের ৮৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। গত বছর যৌন হয়রানির কারণে আত্মহননকারী ৩৯ জনের মধ্যে ১৯ জনই স্কুল ও কলেজছাত্রী। ২০০৯ সালের ৭ আত্মহননকারীর মধ্যে ৫ জনই ছিল স্কুল ও কলেজছাত্রী।

এ্যাকশন এইডের পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাত্রী শিৰা প্রতিষ্ঠানে শিৰকের দ্বারা উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হন। 'কিশোরী শিৰায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা : প্রেৰিত বাংলাদেশ' শীষর্ক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪১ শতাংশ ছাত্রী স্কুল প্রাঙ্গণকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করে না। ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্রী বলেছে, শিৰকরা তাদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাত্রী জানিয়েছে তারা শিৰকদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ ছাত্রী জানিয়েছে, তাদের চেনা অন্য কেউ এমন নিযর্াতনের শিকার হয়েছে, যা তারা জানে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অগুণতি মেয়েশিশু এবং কিশোরী পড়াশোনার প্রতি তাদের সহজাত স্পৃহাটি হারিয়ে ফেলে এক সময় ঝরে পড়ছে শুধুমাত্র নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে। শিৰা প্রতিষ্ঠানে উক্ত্যত্তা প্রসঙ্গে এ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সবের্াচ্চ শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে তখন অন্য সত্মরের শিৰা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা সহজেই বোঝা যায়। এ ধরনের ঘটনা জীবনকে গতিহীন ও ঝুঁকিবহুল করে তোলে। শৈশব বা কৈশোরে তাও আবার শিৰা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের পরবতর্ী প্রজন্ম যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। খিলগাঁও গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিৰক গুলশান আরা বেগম দুঃখ করে বলেন, মেয়েদের শিৰা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ ঘটনাগুলো বেশি প্রত্যৰ করতে হয়।

মেয়েদের শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বখাটেদের ভিড় থাকে বেশি। মাঝে মাঝে কিছু কম বয়সী ছেলে অস্ত্র নিয়ে টুকে পড়ে দাবি করতে থাকে 'অমুকের সঙ্গে প্রেম। তমুককে বিয়ে করতে চাই। ' এমনও ঘটে যে, বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিনত্মা করে অভিভাবকরা দীর্ঘদিন তাকে স্কুলে পাঠান না। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে শিৰা প্রতিষ্ঠানেরও পদৰেপ নেয়া জরম্নরী বলে মনত্মব্য করলেন সাভার অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের শিৰক মোহাম্মদ ইউসুফ হারম্নন।

তিনি বলেন, প্রশাসনের সহায়তা, বখাটেদের পরিবারের আগ্রহ এবং শিৰা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ থাকলে কোমলমতি শিৰাথর্ীদের যৌন হয়রানির হাত থেকে রৰা করা সম্ভব। তিনি এ ব্যাপারে স্কুলের একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে লৰ্য করছিলাম ১৭/১৮ বছর বয়সের একটি ছেলে আমাদের স্কুলের একটি মেয়েকে বিরক্ত করছে। একদিন কয়েক শিৰক মিলে ছেলেটিকে স্কুলের কাছে চায়ের দোকানে ধরলাম। টেনে নিয়ে গেলাম প্রধান শিৰকের কাছে। ছেলেটির ঔদ্ধত্য ভঙ্গি আমাদের চমকে দিচ্ছিল।

ছেলেটি বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে আমাদের গালাগালি শুরম্ন করে। সে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের সনত্মান। পরে তার পরিবারকে ধরলাম ছেলেকে সামলানোর জন্য। ছেলেটিকে প্রতিহত করার জন্য পুরো দুই সপ্তাহ আমরা শিৰকরা পালা করে গেটে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতাম। ফলও পেয়েছিলাম।

ছেলেটিকে আর কখনও স্কুলের সামনে দেখিনি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.