আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীনতার চল্লিশ বৎসর ও আমাদের আত্মোপলব্ধি



আমার কেবলই দেরী হয়ে যায়, বাংলাদেশের জন্মদিনে কিছু লিখব লিখব করে স্বাধীনতার মাস মার্চ চলে গেল। এই মাসকে ঘিরে পত্র পত্রিকায় কত লেখালিখি, কত অনুষ্ঠান, কত আয়োজন অথচ আমার কিছুই লেখা হলো না। আমার আজকের এই বিলম্বিত লেখা প্রিয় পত্রিকা আজাদী ছাপবে কিনা জানি না। ২১ ফেব্রুয়ারী, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর এসব দিনগুলোকে আমরা বড় বেশি আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে ফেলেছি। এসব দিনগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে চলে এক ধরণের উন্মাদনা।

বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও চলে বাকযুদ্ধ, যে যার সুবিধামত ইতিহাস বানায়, ইতিহাস রচে। আমরা বড় বেশি কথা বলি, মহান আল্লাহ পাক আমাদের কান দিয়েছে দুইটা মুখ দিয়েছে একটা। সোজা হিসাব। শুনতে হবে বেশী বলতে হবে কম। কিন্তু আমাদের স্বভাব হচ্ছে আমরা বলি বেশী শুনি কম, রাজনীতিবিদদের প্রতি আঙ্গুল তুলতেই বলা হয়, রাজনীতিবিদরাই তো এদেশের স্বাধীনতা এনেছে, আন্দোলন সংগ্রাম করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে।

বঙ্গোপসাগরে অনেক জল গড়িয়েছে। সেদিনের রাজনীতি আর আজকের রাজনীতির মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। আগে রাজনীতিতে ছিল নিরেট দেশপ্রেম আর মানুষের কল্যাণ। এখন সময় পাল্টে গেছে এখন ভোগবাদের জয় জয়কার। এখন রাজনীতি মানে লাভজনক ব্যবসা, মানুষের জন্য নয়, নিজের জন্য কিছু করা।

মানুষের চিন্তায় চেতনায় রাজনীতিবিদরা আমূল পরিবর্তন এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনীতি যে একটা ব্যবসা এটা মানুষ নিজের অজান্তেই মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ এবার চল্লিশে পা রাখলো। এসব রক্তের অক্ষরে লেখা দিনগুলো আমাদের কাছে বার বার ফিরে আসে। আমাদের পূর্ব পুরুষের আত্মত্যাগের স্মৃতি নিয়ে, আসে আমাদের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস নিয়ে।

আসে শহীদ পরিবারগুলোর দুঃখ বেদনার ভার নিয়ে, চল্লিশ বৎসর, পরিণত বয়স, টগবগে তারুণ্যের অস্থিরতা থেকে পরিণতের ধাপে পা রেখে ক্রমশ সুবিবেচনা ধৈর্য ও আত্ম প্রতিষ্ঠার আত্মোপলব্ধির পথে হাঁটার বয়স। কেমন আছে চল্লিশ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ, কেমন রেখেছেন রাজনীতিবিদরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা আমার দেশকে? ঐতিহাসিক বিচারে এটি খুব বেশী দীর্ঘ না হলেও কোন জাতির অগ্রগতির জন্য একেবারে কম সময়ও নয়। মুক্তি সংগ্রামের মর্মকথা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সব ধরণের অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। সেই পথে আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি। আমাদের রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।

সম্ভবত ৯০ এর দশক থেকে ইতিহাস নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের চর্চা শুরু হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছে বার বার। আমরা যখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তখন বঙ্গবন্ধু ছিল এক অনুচ্চারিত নাম। স্বাধীনতার ইতিহাস অস্পষ্ট। তবু আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপ বুকে ধারণ করতে পেরেছি।

ছাই সরিয়ে সোনা খুঁজে নিতে পেরেছি। কারণ আমরা একাত্তর দেখেছি। বয়স কম হলেও আমাদের প্রজন্ম দেখেছে বড়দের উৎকক্তিত চেহারা অনিশ্চিত জীবন যাপন। সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি পোড়ানোর লেলিহান শিখা। দেখেছে নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা।

দেখেছে যত্রতত্র মানুষের লাশ আর এদেশের পোড়া মাটি। আরও দেখেছে শেষ ভরসার একটি ছোট্ট যন্ত্র রেডিও, যেটা চুপি চুপি বড়রা শুনে শুনে উদ্দিপ্ত হতো। হাজারো কষ্টের মধ্যে হাজারো হতাশার মধ্যে ঐ রেডিওর বাণী শুনে চোখে মুখে আলো ছড়াত। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঘুম পাড়ানিয়া গান শুনিয়ে রাখা হয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে আড়াল করে। শেকড় বিহীন করে তোলার প্রয়াসও চালানো হয়েছিল।

আমাদেরকেও তন্দ্রাচ্ছন্ন করেই রাজাকাররা তাদের শেকড় বিস্তৃত করার সুযোগ পেয়েছিল। নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করে রাজনীতিতে তারা ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছিল। আমরা অনেকটাই যেন ভুলতে বসেছিলাম যে গোটা জাতি যে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে সেই হানাদারদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিছু নষ্ট মানুষ। তারা শুধু পাকিস্তানী বাহিনীকে গণহত্যায় সহযোগিতা করেনি নিজেরাও অস্ত্র ধরেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। রাজাকার, আলশামস্‌ বাহিনী সেদিন এইদেশের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে চালিয়েছিল মানবতার বিরুদ্ধে নানা অপরাধ।

আজ শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে বড় মনে পড়ছে এই মহিয়সী নারী আমাদের আবার জাগিয়ে তুলেছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য। ঘাতকদের বিচারের দাবীতে একাত্ম হওয়ার জন্য। ভাবতে অবাক লাগে আমরা স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা জাতি হয়েও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করতে করতেই ৪০টা বৎসর কেটে গেল। আমরা এখনও এক পা আগাই তো দুই পা পিছিয়ে আসি।

এখনও আমরা দ্বিধাগ্রস্ত এখনও আমরা বিতর্ক করি। কোন ব্যাপারে আমাদের কোন মতৈক্য নেই। এত হীনমন্যতায় আমরা কেন ভুগি? কেনইবা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এত বিতর্ক। আমার প্রিয় কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকছুদ বলেন, সবদেশেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে একজনই শীর্ষনেতা থাকেন। তিনি সূর্যের মত উজ্জ্বল ও অনির্বাণ।

কিন্তু গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগৎ তেমনি নানা রকম নেতার সমন্বয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সৌরজগত তৈরি হয়। আমরা একটা বৃহত্তম ঐক্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়াটাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। আজকের এই ৪০ বৎসর বয়সী বাংলাদেশকে আমরা কতটুকু এগিয়ে নিতে পারছি? পরিসংখ্যান দিলে হয়তো দেখা যাবে কিছুটা তো এগিয়েছে। অর্জন হয়তোবা কিছু আছে।

কিন্তু ত্রিশ লক্ষ শহীদের এদেশের মানুষের প্রত্যাশানুযায়ী দেশ এগুতে পারেনি। শুধু মাত্র আমাদের রাজনৈতিক কারণে। সবটুকু দায় রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। কারণ রাজনীতিকে তারা নীতি বিবর্জিত করে তুলেছে। তাদের কাদা ছোড়াছুড়ি ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক, হরতাল, কেউ এগুতে চাইলে জোর করে পিছনে টেনে রাখার চেষ্টা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ব্যর্থতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করা, নির্লজ্জ দলীয়করণ, সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনীতিবিদদের লোভ লালসা ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি।

আমার মনে হয় আমাদের রাজনীতিবিদদের আত্ম জিজ্ঞাসার সময় এসেছে। অনেক তো হলো এবার আত্মোপলব্ধি এবং আত্মবিশ্লেষণ করে নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ন্যূনতম একটা ঐক্যমত্য গড়ে তোলা উচিত। ইতিহাসের দায়িত্ব ইতিহাসের উপরেই থাক। সুশাসনের জন্য, শান্তির জন্য, জাতির ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এক সাথে কাজ করলে আমরা খুব দ্রুত অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। এদেশের গরীব মানুষগুলো বার বার আস্থার জায়গা খুঁজে বেরিয়েছে।

প্রতিবারই তারা প্রতারিত হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০তম জন্ম বার্ষিকীতে আমরা আবারও রাজনীতিবিদদের উপর নতুন করে আস্থা রাখতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই, কথা ও কাজের মাঝে সমন্বয় চাই। চাই তাদের সততা ও আন্তরিকতা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.