আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শৈশবেই রাজতন্ত্র অবসানের স্বপ্ন দেখেছিলেন কর্নেল গাদ্দাফি

অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...!

পর্যবেক্ষক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি- লিবিয়ার এ নেতাকে উৎখাতে নেমেছে দেশটির বিরোধীরা। তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে একের পর এক শহর দখলের দাবি করছে। এখন লক্ষ্য- রাজধানী ত্রিপোলি। বিদ্রোহীরা একেকটি শহর দখল করছে, আর ওড়াচ্ছে রাজতন্ত্র আমলের পতাকা। তাহলে কি তারা আবার সেই অবস্থায় ফিরে যেতে চায়? সেটি সত্যি কিনা তা নিকট ভবিষ্যতই বলে দেবে।

গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে চাওয়া এ বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছে আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্সসহ ৩৫টি দেশ। বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কথিত নো-ফ্লাই জোন আরোপের নামে লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলাকে রাশিয়াসহ অনেক দেশের নেতা বর্বর আখ্যা দিচ্ছেন। এমন কি গাদ্দাফিও ‘বর্বরোচিত হামলা’ বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে মঙ্গলবার লন্ডনে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যেই গাদ্দাফি চিঠি লিখে এ আহ্বান জানান। তারা বলছেন, মূলত তেল সম্পদ কুক্ষীগত করার জন্যই লিবিয়ায় লাগাতার বিমান হামলা চালাচ্ছে। যদিও পশ্চিমা নেতারা বলছেন, গাদ্দাফি বাহিনীর নিষ্ঠুর হামলা থেকে জনগণকে রক্ষা করছে। এখন প্রশ্ন হলো- কে এই মুয়াম্মার গাদ্দাফি? ১৯৪২ সালের ৭ জ্নু লিবিয়ার সিরত শহরের এক যাযাবর বেদুইন পরিবারে তার জন্ম। অন্যসব লিবিয়ান শিশুর মতো তিনিও শৈশবে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েছেন।

এরপর ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ফেজানের সাবহা প্রিপারেটরি স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেখানে পড়াশোনা করার সময় তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা করেন। কারণ শৈশব থেকেই তিনি দেখেছিলেন রাজতন্ত্রের শোষণ। আর এজন্যই তিনি মননে লালন করতেন একটি সাম্যবাদী সমাজের। আর ক্ষমতায় আসার পর সেটাই করেছেন তিনি।

তার দেশের নাম দিয়েছেন ‘মহাসাম্যবাদী গণলিবিয়া’ বা ‘আরব জামাহিরিয়া’। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই ১৯৬১ সালে রাজনৈতিক কর্মকা-ে সক্রিয়তার অভিযোগে তাকে সাবহা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি বেনগাজির তৎকালীন ইউনিভার্সিটি অফ লিবিয়ায় ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে যেটি বেনগাজির আল-কারিউনেস এবং ত্রিপোলির আল-ফাতাহ এ দুই ইউনিভার্সিটিতে ভাগ হয়ে যায়। সেখান থেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৩ সালে তিনি বেনগাজির সামরিক পরিষদে যোগ দেন।

সেখানে তিনি এবং তার অনুগত কিছু সামরিক কর্মকর্তা লিবিয়ার পশ্চিমমুখী রাজতন্ত্রকে (সেনুসি রাজতন্ত্র) উৎখাত করার জন্য একটি গোপন দল গঠন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য বৃটেনে যান এবং ১৯৬৬ সালে কমিশন প্রাপ্ত অফিসার পদে উন্নীত হয়ে লিবিয়ায় ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যখন তৎকালীন রাজা মোহাম্মদ ইদ্রিস আল-সেনুসি শারীরিক অসুস্থার জন্য তুরস্কে সফরে গিয়েছিলেন, তখন মাত্র ২৭ বছরের কর্নেল মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি অল্প কয়েকজন সামরিক অফিসারের সহায়তায় রাজধানী ত্রিপোলিতে এক প্রতিরোধহীন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। গাদ্দাফির এসব কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের। তাই নাসেরের মৃত্যুদিবস এখনো লিবিয়ায় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।

এর কিছুদিন পরই গাদ্দাফি এবং তার অল্প বয়সী সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় অপেক্ষাকৃত সিনিয়র অফিসার এবং কিছু প্রভাবশালী বেসামরিক নাগরিকের। এসব দ্বন্দ্ব মিটিয়েই ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে গাদ্দাফি একজন সফল শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর সাবেক রাজা আমির ইদ্রিস আল-সেনুসিকে তুরস্ক থেকে মিসরে নির্বাসন দেয়া হয়। ১৯৮৩ সালে নির্বাসিত অবস্থায় সেনুসি মিসরে মারা যান। বর্তমানে গাদ্দাফির সন্তান আট জন।

এদের মধ্যে সাত ছেলে এবং এক মেয়ে। তবে আরেকটি মেয়ে ছিল, যিনি ১৯৮৬ সালে তার বাড়িতে আমেরিকান বিমান হামলায় নিহত হন। গাদ্দাফির বড় ছেলে মোহাম্মাদ গাদ্দাফি লিবিয়ান অলিম্পিক কমিটি এবং তার দ্বিতীয় ছেলে সা’দ গাদ্দাফি লিবিয়ান ফুটবল ফেডারেশন পরিচালনা করছেন। সা’দ নিজেও একজন বেশ ভালো ফুটবলার এবং তিনি একসময় জাতীয় দলে খেলতেন। তার তৃতীয় ছেলে সাইফ আল-ইসলাম একজন চিত্রশিল্পী এবং একটি হাসপতালের পরিচালক।

তার একমাত্র মেয়ে আয়েশা গাদ্দাফি একজন আইনজীবী এবং তিনি ইরাকের ক্ষমতাচ্যূত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পক্ষে আইনি লড়াই করে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। এছাড়া দেশে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো জনকল্যাণমূলক কাজে নিবেদিত। তাকে অবশ্য পশ্চিমারা লিবিয়ার ‘ক্লডিয়া শিফার’ নামে অভিহিত করে। গাদ্দাফির অন্য তিন ছেলে আল-মুতাসসিম, হানওয়িল এবং খামিস। এই খামিসই সম্প্রতি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বলে আমেরিকার পরারাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জানিয়েছিলেন।

কিন্তু সোমবার রাতেও তাকে জীবিত দেখা গেছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক রীতিমতো সাপে-নেউলে। তবে তিনি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও তাকে বিশ্বাস করেনি পশ্চিমারা। কারণ দেশটির তেল সম্পদ নিয়ে পশ্চিমাদের তিনি কোনো ছাড় দিতে চাননি। ১৯৫০-এর দশকে খনিজ তেল আবিষ্কারের আগে লিবিয়া ছিল একটি দরিদ্র রাষ্ট্র।

পেট্রোলিয়ামের বিশাল মজুদ আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়। তবে এখনো এখানকার অনেক লোক খামার ও পশুচারণের কাজে নিয়োজিত, যদিও ভালো খামারভূমির পরিমাণ খুব কম। তাই ক্ষমতা দখলের পর তিনি পশ্চিমাদের বাধ্য করেছেন তেলসম্পদ নিয়ে নতুন চুক্তি করতে। সেই থেকে ক্ষুব্ধ পশ্চিমারা। তারপরও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর গাদ্দাফিই প্রথম এর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান।

২০০২ সালে তিনি ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবির আকাশে আমেরিকান বিমান বিস্ফোরণের জন্য জনগণের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান এবং এর জন্য বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণও দেন। কারণ তার দেশের নাগরিকই এ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। আর ২০০৩ সালে আমেরিকানদের হাতে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর তিনি স্বেচ্ছায় তার সব গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি বাতিল করার ঘোষণা দেন। তার লেখা গ্রন্থ ‘কিতাবিল আখদার’ বা দ্য গ্রিন বুক যেটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। তিন খ-ে প্রকাশিত এ গ্রন্থে সমাজ এবং রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

এটিই মূলত লিবিয়ার সংবিধান। ইংরেজিতে মুয়াম্মার আল-গাদ্দফির নামের বানান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ‘লন্ডন ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় তার নামের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে সম্ভাব্য ৩৭টি বানানের কথা উল্লেখ করা হয়। এই গাদ্দাফির পতনের লক্ষ্যে দেশটিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন শুরু হয়।

গাদ্দাফি একজন একশভাগ বেদুইন। তিনি এখনো নারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন। এখনো তাঁবু খাটিয়ে ঘুমান। যদি প্রাণ দিতে হয় তবু শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবেন বলে মনে করে অনেকে। এমন কি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পরিণতিও যদি হয় তাও মেনে নেবেন।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলোÑ যৌথবাহিনীর হামলায় ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়া গাদ্দাফি যদি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন, তারপর দেশটির নেতৃত্ব কে দেবেন? দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব গাদ্দাফির হাতে। তিনি কঠোর হাতে দেশ পরিচালনা করছেন। আর শাসক শ্রেণীর বেশিরভাগ সদস্যই গাদ্দাফির আত্মীয়স্বজন অথবা তার নিজ গোত্রের লোক। এ কারণে সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন বা সুশীল সমাজ গড়ে ওঠেনি। তাই গাদ্দাফির অনুপস্থিতিতে সেখানে ‘পাওয়ার ভ্যাকুয়াম’ বা নেতৃত্ব শূন্যতারই সৃষ্টি হবে।

লিবিয়া মূলত একটি গোত্র-প্রধান দেশ। বিভিন্ন গোত্রের বসবাস রয়েছে দেশটিতে। দীর্ঘদিন ধরে এসব গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে। গাদ্দাফি-পরবর্তী যুগে এসব গোত্রের মধ্যে হানাহানি আরো বাড়ার আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল। কারণ দেশটির পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের মধ্যে বিরোধিতাও দীর্ঘদিনের।

ক্ষমতার কেন্দ্রে মূলত পশ্চিমারা রয়েছে। এ কারণে গাদ্দাফি-পরবর্তী সময়ে দেশটির নেতৃত্ব নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। স্বাভাবিকভাবেই গাদ্দাফি শাসনের অবসান হলে পশ্চিমাঞ্চলের নেতৃত্ব মানতে চাইবে না পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এতে দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ারও আশঙ্কা করছেন অনেকেই। আর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার না থাকলে আফগানিস্তানের মতো লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকা গোত্রগুলোর নিয়ন্ত্রেণে থাকবে বলে তাদের ধারণা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।