আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লোকমান সাহেব, ইয়াসমিন আপা এবং আমার অদেখা তৃতীয় কোন একজন

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । তবে স্বপ্ন দেখা নিয়ে কিছুদিন যাবত একটা সমস্যা হয়ে গেছে । নতুন দেখা স্বপ্নগুলো কেন যেন পূরণ হচ্ছে না খুব শীঘ্রই এই সমস্যা কেটে যাবে এই আশাতেই আছি ।

ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার প্রথমেই মনে হলো মানুষ কি তবে আসলেই সব সময় খুঁজে - পেতে তার নিজের মতো কাউকেই বের করে নাকি! এমনটা মনে হওয়ার কারণ তার স্বামীর সাথে তার চেহারা, আদল, চাউনি সবকিছুর অসম্ভব মিল । মাত্র দেখেছি তখন, কাজেই আচার আচরণ কথা বার্তাতেও মিল আছে কিনা তা সাথেসাথে ঠিক বোঝা না গেলেও পাঁচ-দশ মিনিট পরে দেখা গেল এখানেও তারা এক ।

স্বামী - স্ত্রী দুজনই ফর্সা, মাঝারি উচ্চতা, সব সময় চারপাশে চোখ বুলাতে থাকা চঞ্চল ধরনের মানুষ । আগের বার যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখনই দেখেছি লোকমান নামের স্বামী লোকটা একদমই স্থির হয়ে থাকতে পারেন না, ক্রমাগত নড়াচড়া করেন । সবকিছুতে এতোই যখন মিল তাদের, ধরে নিলাম স্ত্রী যদিও এখন ছটফট করছেন তা তবুও তিনি নিশ্চয়ই অমনই হবেন । তার পক্ষে তখন মুহূর্তে মুহূর্তে ছটফট করে বেড়ানো সম্ভব ছিলো না । কারণ তার শরীরের ভেতর আরেকজন ছোট্র বাবু যার বয়স জন্মপূর্ব সাত মাস, তারজন্যে ব্যাপারটা সহ্য করা একটু মুশকিলই হয়ে যায় বোধহয় ।

তাই সে নিজেই পরোক্ষভাবে তার মা'কে শাসন করে চলা ফেরা কমিয়ে দিয়েছে । ভদ্রমহিলা রক্তশূন্যতা, একটু বেশী বয়সে মা হওয়া সহ আর কিছু জটিলতায় ভুগছেন । পেটের বাচ্চাটাকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর জন্যে প্রতি দুই মাসে একবার করে রক্ত নেয়া লাগে । এবারের আগে একটা বাচ্চা ছয় মাসের মাথায় পেটে থাকতেই মারা গেছে এইসব সমস্যার কারনেই । এবারের বাচ্চাটা কে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের তাই দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে ।

এই বাচ্চাটার জন্যেই তৃতীয় মাসে আমি একবার তাকে রক্ত দিলেও তখন তার সাথে দেখা হয় নি, দ্বিতীয়বারে দেখা হলো । জানলাম আমার সামনে দাড়ানো কালো বোরকা গায়ে, মাথায় ওড়নাটেনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার নাম ইয়াসমীন । কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলেই মনে পবিত্র একটা ভাব জাগে, মনে হয় সামনে দাড়ানো মানুষটা খুব ভালো মনের কেউ; ইনি খুব তীব্রভাবে তাদের দলে পড়েন । তিনি বাচ্চা বড় হতে শুরু করার প্রথম থেকেই বেশীক্ষণ একটানা দাড়িয়ে থাকতে পারতেন না, পা অবশ হয়ে আসতো । এখন শরীরের অবস্থা আরো খারাপ ।

আমি জীবনে গর্ভবতী অবস্থায় তেমন কাউকে কাছ থেকে দেখিনি । আল্লাহ নতুন একটা মানুষকে নিজের শরীরের ভেতর বয়ে বেড়ানোর, বড় করার সীমাহীন কষ্টটা পুরোপুরি বোঝার ক্ষমতা আমেদের পুরুষদের দেন নি । তবুও মা'কে সেদিন দেখে কষ্টটার যে ভগ্নাংশ বুঝেতে পেরেছিলাম তাতে সাথে সাথে আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো । মনে পড়ছে, রাখা হবে না জেনেও আর কখনো মায়ের সাথে খারাপ আচরন করবো না এমন একটা প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম নিজের কাছে । ব্লাড ট্রান্সফার শেষে ফিরে আসার সময় " আমাদের জন্যে অনেক কষ্ট করলেন ভাই " কথাটা ইয়াসমিন আপা এতোবার বললেন আমি লজ্জায়ই পড়ে গেলাম ।

আর লোকমান সাহেব তো সেই কখন থেকেই আমার হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছেন । বারবার নিষেধ করা সত্বেও দু'জন হসপিটালের নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন । লোকমান সাহেব গাড়িতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, বয়সে অর্ধেক হয়েও একটা ধমক দিয়ে তাকে বিদায় করলাম । বলে দিলাম ছোট্র বাবুটা পৃথিবীতে আসার পর যেন আমাকে অবশ্যই জানানো হয় । বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় মনে মনে ঠিক করা হয়ে গেলো বাচ্চাটাকে অবশ্যই দেখতে আসবো এবং সে ছোট মানুষ থেকে বড় হয়ে যখন আঙ্কেল আঙ্কেল বলে ডাকতে শিখে যাবে তখনও পরিবারটার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে .... এবং তারপরেও ।

স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ থাকে নি । আমি এমন এক জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত মানুষ যে আশেপাশে অনেকের সাথে থাকলেও আছে কেবল নিজের সাথেই । এমন মানুষদের পিছুটান খুব কম বা থাকেই না, দিনের শেষে বাড়ি ফেরা না ফেরা এদের কাছে সমান কথা । লোকমান সাহেব আর তার স্ত্রী ইয়াসমিন আপার কথা পরের কিছুদিনের মধ্যে মনে ঝাপসা হয়ে আসলো । ইউনিভার্সিটিতে শুরু হলো পরীক্ষা, রিপোর্ট সাবমিশন, প্রেজেন্টেশন, জ্যামিতিক হয়ে বাড়তে থাকলো আস্তে আস্তে সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার প্রবনতা ।

সবমিলিয়ে তাদের তিনজনের সবার কথা আমি পুরোপুরি ভুলে গেলাম মাস দেড়েকের মধ্যেই । ........ প্রকৃতি কারো স্মৃতি চিরদিনের মতো ভুলে থাকার ব্যবস্থা বোধহয় রাখে নি । মনে করিয়ে দেওয়ার কায়দাকানুনও অদ্ভুত । আমার তাদের কথা মনে পড়লো ফেসবুকে ও নেগেটিভ রক্ত চেয়ে লেখা একটা পোস্ট পড়ে । মনের ভেতরটা খচখচ করছে ।

মাঝে সেটের সব নম্বার ডিলিট হয়ে যাওয়ায় লোকমান সাহেবের মোবাইল নম্বারটা আমার কাছে এখন আর নেই । কিন্তু তার কাছে তো আমার নম্বার থাকার কথা , আমি খোঁজ নেই নি ঠিক; কিন্তু তিনিও তো আমাকে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার পর জানাবেন বলে জানান নি । কারণটা কি হতে পারে? তবে কি এবারো...........?? নাহ্, ওমন কিছু হতে পারে মন ভাবতে চায় না । নিশ্চয়ই লোকমান ভাই নতুন অতিথির আগমনের খুশিতে দুনিয়ার অন্যসব কিছু ভুলে গেছেন বলে আমাকে আর খবর দেয়ার কথা তার মনে হয় নি । অথবা হয়তো আমার মোবাইল নম্বারটা তার কাছে এখন আর নেই ।

যেকোন কারনেই হোক হারিয়ে গেছে । সেট নষ্ট হয়ে যাওয়া, ছিনতাই হওয়া, কন্ট্রাক্ট লিস্ট ফরম্যাট হয়ে যাওয়া.......কতভাবেই তো হারাতে পারে তাই না? হিসেব করে দেখলাম বাচ্চাটার বয়স এখন আট মাসের মতো হওয়ার কথা । ছেলে বা মেয়ে যাই হোক তার দেখতে পুতুলের চেয়েও সুন্দর হওয়ার কথা । হয়তো বাবা মায়ের মতোই তার চঞ্চল ছটফটে ভাব আর চলছে চোখেমুখে সারাদিন কথা বলা । আট - নয় মাস বয়সে বাচ্চারা বসতে শেখে , অল্প অল্প করে হাপুড় দিয়ে সামনে এগোতে চায় ।

ঐ পিচ্চিও নিশ্চয়ই এখন তাই করে । গাট হয়ে বসে অবাক দৃষ্টিতে দেখে চারপাশটা, হাতে ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে । ইয়াসমিন আপু নিশ্চয়ই খুব দুঃশ্চিন্তায় থাকেন কখন খাট থেকে না গড়িয়ে পড়ে যায় । তাই সবসময় চোখে চোখে রাখেন, দুপাশে দুটো বড় কোলবালিশ দিয়েও ঠেস দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছেন । প্রতিদিন নতুন নতুন খেলনা কিনতে কিনতে লোকমান ভাইও বোধহয় আরো একটু বাচ্চা বাচ্চা টাইপ হয়ে গেছেন ।

তার মন বাসার অন্য সবকিছু আনার কথা ভুলে গেলেও খেলনা কেনার কথা ভুলে না । আর কত রকম খেলনাই যে আছে বাজারে! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা ...... যেন জীবনের সব রঙ্গের আয়োজন যেখানে দুঃখ বিষাদের কোন ছাপ নেই ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.