আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি ৪০ বছরেও : গুরুত্বপূর্ণ দলিল জাদুঘরে বস্তাবন্দি

একদিন-প্রতিদিন

আজিজুল পারভেজ স্বাধীনতার ৪০ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি। লিপিবদ্ধ হয়নি মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা। বিভিন্ন সময়ে সরকারিভাবে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা হোঁচট খেয়েছে, বাতিল হয়ে গেছে ক্ষমতার পালাবদলে। আবার প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকেও বিকৃত করা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। মুক্তিযুদ্ধের মহামূল্যবান দলিল জাদুঘরে পড়ে আছে বস্তাবন্দি অবস্থায়।

সেগুলো প্রকাশ করার উদ্যোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে তথ্য মন্ত্রণালয় হাতে নেয় 'স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ' প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র'।

এর ভূমিকায় হাসান হাফিজুর রহমান উল্লেখ করেছেন 'প্রায় সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার দলিল ও তথ্যাদি জমা হয়েছে। এর ভেতর থেকে ১৫ হাজার পৃষ্ঠা ছাপা হচ্ছে। ' এই অব্যবহৃত মূল্যবান দলিলগুলো আর ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে সেগুলো জাতীয় জাদুঘরে বস্তাবন্দি অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকাশিত দলিলপত্রের বিকৃতি : 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র' সহজলভ্য নয়।

জিয়াউর রহমানের আমলে প্রকাশিত এই দলিলপত্র বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এসে বিকৃত করা হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কপিরাইটভুক্ত দলিলপত্র ২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে ইতিহাস বিকৃত করে প্রকাশ করা হয়। তৃতীয় খণ্ড থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। সম্পাদক হিসেবে হাসান হাফিজুর রহমানের নামটিও বাদ দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে রিট আবেদন করা হলে আদালত তৃতীয় খণ্ডটি বাতিল করে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তৃতীয় খণ্ডটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৫ খণ্ডের 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র' তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করেছে হাক্কানী পাবলিশার্স। এটি ১৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাক্কানী পাবলিশার্স ২১ হাজার কপি মুদ্রণের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে মাত্র পাঁচ হাজার কপি মুদ্রণের অনুমতি দেয়।

এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগেও এই দলিলপত্র মুদ্রণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে রিট করা হলে আদালত সে উদ্যোগ স্থগিত করে দেন। হাক্কানী পাবলিশার্সের নির্বাহী পরিচালক বি বি রায় চৌধুরী জানিয়েছেন, বাজারে বর্তমানে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রায় ৬০-৭০ হাজার সেটের চাহিদা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ৮-১০ হাজার টাকা মূল্যের একটি সুলভ সংস্করণও প্রকাশের চেষ্টা করছেন। বাংলা একাডেমীর গবেষণা, জোট সরকারের রোষানলে : স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেই সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলা একাডেমী।

গঠন করা হয় 'জাতীয় স্বাধীনতা ইতিহাস রচনা পরিষদ'। এর আওতায় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ, গণপরিষদ সদস্য, মন্ত্রী, কর্মকর্তা, বেতারকর্মী, সৈনিকসহ প্রায় পাঁচ হাজার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, পত্র-পত্রিকা ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আরেকটি উদ্যোগ ছিল 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের ইতিহাস রচনা' প্রকল্প। এর লক্ষ্য ছিল ৩০ খণ্ডে ইতিহাস প্রণয়ন। কিন্তু তা সফল হয়নি।

এগুলোর কিছু কিছু তথ্য 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র'-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলা একাডেমী ১৯৯৯ সালে আবার হাতে নেয় 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : দলিল ও ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ' প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় ৯১টি গ্রন্থ প্রকাশ করার কথা ছিল। গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র'-এর বর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ এবং নতুন চারটি খণ্ড প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধের জেলাভিত্তিক ৬৪ খণ্ড প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধে নৌবাহিনী ও নৌ-কমান্ডো, বিমানবাহিনী, মুক্তিযুদ্ধে নারী, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোর, বাংলাদেশের প্রথম সরকার : মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও বহির্বিশ্ব প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলো যখন মুদ্রণ পর্যায়ে তখনই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে।

বিএনপি ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালে এই প্রকল্পটি স্থানান্তর করে নবগঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। এরপর তারা নিজেদের মতো করে কেবল 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র' প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা শাহিদা খাতুন জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের জেলাভিত্তিক ইতিহাসের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০টিই জমা পড়েছিল। এগুলো প্রকাশিত হলে মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের গণমানুষের অংশগ্রহণের চিত্র, সারা দেশের রাজাকারদের তালিকা এবং শহীদদের তালিকা অনেকটাই পাওয়া যেত। এই প্রকল্প সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম জানান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বন্ধ করে দেওয়া ইতিহাস প্রকল্পটি আবার চালু করা হচ্ছে।

পর্যায়ক্রমে সব গ্রন্থই প্রকাশ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধে জনমানুষের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি: ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অংশগ্রহণের ইতিহাস এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। একসঙ্গে কোথাও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাওয়া যায় না। বরং মুক্তিযুদ্ধকে সামরিকায়ন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।

যদিও সেটা গবেষণাভিত্তিক হয়নি। বিভিন্ন জনের প্রকাশিত প্রাসঙ্গিক লেখা তাতে সংকলিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস পাওয়া যায় এমন কোনো প্রকাশনা নেই। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, মুনতাসীর মামুনের 'মুক্তিযুদ্ধ কোষ' এবং মাইদুল হাসানের 'মূলধারা ৭১'-এ মুক্তিযুদ্ধের উপাদান পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমী নতুন করে জেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে তিনি জানান।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, 'স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেল এখনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাইনি। সরকার বদলে ইতিহাস বদলে যায়। এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। ইতিহাস রচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই শঙ্কিত। সরকারের একটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে এ ব্যাপারে তাদেরও কোনো উদ্যোগ দেখছি না।

' তিনি আরো বলেন, 'স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র' নিয়ে অনেকে ভুল করেন। এটা ইতিহাস গ্রন্থ নয়, দলিল সংকলন। যেভাবে ইতিহাস সংকলিত হতে হয় সেভাবেও তা হয়নি। এটার পরিমার্জন দরকার। লেখার মূল লিংক মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি ৪০ বছরেও : গুরুত্বপূর্ণ দলিল জাদুঘরে বস্তাবন্দি



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.