আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একাত্তরের অ্যান্টিথিসিসের মা জননী শর্মিলা বোসের লাশগণনার ভুতুড়ে ইতিহাস ২

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দু:খের খনি ভেদ করে শোনা যায়, শত জল ঝর্ণার ধ্বনি/ জীবননান্দ দাশ একাত্তরের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার প্রাণভোমরা হলো বর্বর দখলদারদের প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা। এই কারণেই একাত্তরের প্রাণ বিসর্জন ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা মানবতার ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানবতার উত্থানেরমহত্ব অর্জন করে।

শর্মিলা বোসেরা এই প্রাণভোমরাকেই হত্যা করতে চান। তাই গণহত্যা ও গণধর্ষণের কার্যকারণ ও মাত্রাকে ঢেকে দিতে তিনি যে ঐতিহাসিক প্রতরণার দাগ আঁকেন সেটা একে একে স্বাধীনতা আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সব কিছুকেই বিদ্ধ করে, নাকচ করে দেয়, সবকিছুর অ্যান্টিথিসিস হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন একাত্তরের অ্যান্টিথিসিসের প্রণেতা। এখানেই তাঁর থিসিস বা চিন্তা আর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তার দেশীয় দোসরদের চিন্তা একাকার হয়ে যায়। এ কারণেই শর্মিলা বোসের ইতিহাস এক বিষাক্ত ইতিহাস।

তিনি বাংলাদেশের জন্মেতিহাসকেই বদলে দিতে চান। তিনি দিচ্ছেন নতুন সৃষ্টিতত্ত্ব বা জেনেসিস। এটাই তাঁর আগ্রহের মূল প্রণোদনা, তাঁর লক্ষ্য এবং এ জন্য তিনি সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও অরক্ষিত জায়গায় আঘাত করেছেন। জয়া চ্যাটার্জি বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে ১৯৪৭ এর বঙ্গভাগের জন্য ভারতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে দায়ি করেন, দায়ি করেন তাদের সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান কৃষকের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি না করার মানসিকতাকে। আর শর্মিলা বোস করেন তার বিপরীত, পাকিস্তান-ভাগের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দোষী করেন, কারণ তা সংখ্যালঘু পাঞ্জাবী শাসকদের অধীনস্ততা মানতে চায়নি।

তাই বাংলা ভাগ আর পাকিস্তান ভাগ এক ঘটনা নয়। কারণ বাঙালিরা এক জাতি কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা ধর্মে এক হলেও জাতিতে এক নয়। শর্মিলা বোস তাঁর ঘোরগ্রস্থ চোখে তাদের এক জাতি ঠাউরেছেন বলেই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী উপনিবেশ কায়েম তাঁর চোখে পড়ে না, বাদ পড়ে যায় একাত্তরের আগের ২৪ বছরের বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। এজন্যই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে যায় ‘গৃহযুদ্ধ’ আর হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি এক পাল্লায় তুলে পরিমাপ করেন। কারণ তাঁর পাল্লা একটাই, দৃষ্টিও একরোখারকম সংকীর্ণ।

একাত্তরের আগের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেন বলেই বাঙালিদের ওপর চালানো গণহত্যা ও গণধর্ষণের অভিযোগ হয়ে ওঠে ‘অতিরঞ্জন’ এবং বাঙালিদের বাড়াবাড়ির 'মানবিক' প্রতিক্রিয়া। ইতিহাস লিখন অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কাজ। সত্যিই, এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের আগুন ইতিহাসের বিতর্ক থেকেই পর্যাপ্ত বারুদের সরবরাহ পেয়ে আসছে। তাই ইতিহাস-নির্মাণও একটা রাজনৈতিক কাজ। শর্মিলা বোস এখানে একা নন, খোদ পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং একাত্তরের ঘাতকরাও এখনো ভূতগ্রস্থের মতো বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছে।

কিন্তু একাত্তর সাল বহু শতক আগের দিন নয়, একাত্তরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার বিরাট এক জনগোষ্ঠী এখনো জীবিত, এখানো জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, গণহত্যায় নিহতদের স্বজন এবং ধর্ষণের শিকার নারীরা। শর্মিলার নতুন ইতিহাস পুস্তক মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা রক্ষাকারীদের জন্য একটা সতর্কতা। একাত্তরের প্রজন্ম এবং তাঁদের সন্তান-সন্তুতিরা জীবিত থাকাবস্থাতেই যদি মাত্র চল্লিশ বছর আগের ইতিহাস এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তাহলে আরো চল্লিশ বছর পরে কী হবে, তা ভাবা দরকার। দুর্বল ঐতিহাসিক নজর, পাতলা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশী এবং জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তন সম্পর্কে অপরিপক্কতা থেকে অনেকের মধ্যে এ ধরনের বিতর্ক অবিচলিতভাবে করার তাকদ দেখা যায় না। কিন্তু ইতিহাস উদঘাটন এবং তাকে জনমানুষের সংস্কৃতিতে জীবন্ত রাখার প্রচেষ্টা আতংক বা উত্তেজনা দিয়ে হবার নয়।

চেনা কাহিনীর বাইরে কিছু ঘটলেই হা রে রে করে তেড়ে যাওয়া দিয়ে কিছুই অর্জিত হবে না। বিশ্বের সরকার ও নাগরিকদের জনমত তো বটেই, পরিবর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যেও স্বাধীনতার মোটাদাগের ইতিহাসে অভক্তি আসতে পারে। বর্তমানে ‘মুক্তিযুদ্ধওয়ালাদের’ ব্যর্থতাকে পুঁজি করে ভুতুড়ে শক্তিগুলো দাপট অর্জন করতে পারে, বিশেষত বর্তমান সরকারের সমূহ ব্যর্থতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ভারতীয় আধিপত্যের বাড়বৃদ্ধি তাদের জন্য মওকা মেলাতে পারে। সেরকম পরিস্থিতিতেই শর্মিলা বোসের ইতিহাসের অ্যান্টিথিসিস, একাত্তরের রাজনৈতিক অ্যান্টিথিসিসের জমিন যোগাতে পারে। একাত্তরের নথিবদ্ধ, দালিলিক প্রমাণের মহাফেজখানা সৃষ্টি, জনমানসে স্মৃতির পুনর্জাগরণ, শর্মিলা বোস কথিত ‘অশিক্ষিত’ বাঙালির শ্রুতিসাক্ষ্য ধারণ করে রাখা, সাত কোটির মধ্যে জীবন্ত দুই কোটি বা তারো কম মানুষের প্রত্যেকেরই বলবার মতো অভিজ্ঞতার যতটা সম্ভব সংরণ করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে দলীয় প্রভাবের বাইরে নিষ্ঠাবান গবেষণা উৎসাহিত করা খুবই প্রয়োজন।

মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোথাও তার সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ অবধি হতে দেয়নি। তার ওপরে শীতল যুদ্ধের পটভূমিতে বাম ঘরানার আবহে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে পুঁজিবাদী বিশ্বও ভালভাবে নেয়নি। সাবেক উপনিবেশিক দেশগুলোর জাতীয়তাবাদকে তাদের একাডেমিয়ায় সর্বদাই ত্র“টিপূর্ণ মনে করা হয়। বেনেডিক্ট এন্ডারসন কিংবা ওরিয়েন্টালিস্ট থিওরিস্টরা সেই তত্ত্ব ফেঁদে আসছেন: জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদ তাঁদের চোখে ইউরোপের একচেটিয়া সম্পত্তি। বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারেও তারা সুচিন্তিতভাবে উদাসীন।

অন্যদিকে বিজয়ী বাংলাদেশ একটা বিজয়ের ইতিহাস তৈরি করলেও তা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা ও জটিলতাকে নিরসন করেনি। বিজয়ও এ কারণে তাই সম্পূর্ণ হয়নি। একাডেমিক ইতিহাস চর্চা থেকে এ সমস্যা মিটবে বলে মনে হয় না। এটাকে আগে মেটাতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর। এসব বিষয় বিবেচনা করে আওয়ামী-বিএনপির ছাতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে একাত্তরের বহুমাত্রিক জটিল ও গভীর খনিতে নামা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিকাশকেও ভারতের বগলের চাপ কিংবা পাকিস্তানের ভুতুড়ে কোটর থেকে বের করা দরকার। ভারতপ্রেমী-পাকিস্তানকেন্দ্রিক চাপে বাংলাদেশ হারিয়ে যাচ্ছে। একদল তরুণ গবেষকই এ কাজে আগুয়ান থাকতে পারে। এক পাকিস্তানী সেনা বলেছিল যে, আমরা যাকে খুশি তাকে হত্যা করতে পারি, এর জন্য আমাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। পাকিস্তান সরকার নিযুক্ত হামিদুর রহমান কমিশনও বলেছিল যে, বাংলাদেশ যদি গণহত্যা ও ধর্ষণের উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারে তাহলে বিবেচনা করা হবে।

শর্মিলা বোসও লিখেছেন, ‘বাংলদেশিরা তাদের দেশের জন্ম নিয়ে উচ্ছ্বসিত, কিন্তু নিয়মসংগতভাবে ঐতিহাসিক রেকর্ড-রাখার কাজ তারা সামান্যই করেছে। এবং ১৯৭১ বিষয়ে ব্যাপক লেখালেখি হলেও তার বেশিরভাগই ভিত্তিহীন আবেগাক্রান্ত হওয়ার জন্য অগুরুত্বপূর্ণ। ’ এইসব ঔদ্ধত্য ও অভিযোগ অংশত জায়েজ হয় আমাদের রাজনৈতিক দুটি বলয়ের আচরণের জন্যই। এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি। সেই কাজ এখন আইনের বলে উচ্চ আদালত দিয়ে করা হচ্ছে, কিন্তু ইতিহাসের শল্যচিকিতসা আদালত দিয়ে হবার নয়।

এ দেশের উভয় অংশের শাসকরা আগে ইতিাসটাকে হত্যা করেছেন, তারপর এখন বলের ভিত্তিতে আদালতকে দিয়ে তা পুনর্লিখন করছে। এখনও ব্যাপক ভিত্তিক ইতিহাস প্রণয়ন এবং গণহত্যা ও গণধর্ষণ বিষয়ে অকাট্য প্রমাণাদি-ভিত্তিক গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণ গড়ে তোলা হয়নি। সেই পাকিস্তানী সেনার ঔদ্ধত্য, হামিদুর রহমান কমিশনের মিথ্যাচার কিংবা শর্মিলা বোসের নিপুণ প্রতারণার জবাব দিতে হলে উত্তেজনা বা আবেগের বশে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় ইতিহাসের প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। জাতীয়ভাবে সকল হত্যাকাণ্ডের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, সকল বধ্যভূমির সনাক্তকরণ, সকল নিহতের সংখ্যাগণনা, ধর্ষণের শিকারদের সম্মান ও নির্জনতা বাঁচিয়ে সংখ্যা নিরূপণ করতে হবে। তাতে যদি শহীদের সংখ্যা, নির্যাতিতার সংখ্যার ঊনিশ-বিশ হয়, তাতে কি মুক্তিসংগ্রামের ত্যাগ ও গৌরব কমে যাবে? শর্মিলা বোস একটা কথা ঠিক বলেছেন, আমরা কেবল ভিক্টিম হওয়ার বোধ নিয়ে সহানুভূতি কাড়ি।

আমরা ভিক্টিম এবং আমরা প্রতিহতকারী বিজয়্ওি বটে। সেই বিজয় সংহত ও গণতান্ত্রিক চেতনায় রূপান্তরের জন্যই প্রয়োজন একাত্তর সম্পর্কে একটা গ্রহণমুখী উদার ও দৃঢ় ইতিহাস নির্মাণ করা। এবং তাকে সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বল বা প্রেমিজের অংশ করা। এ বিষয়ে সংসদেও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পাশ করা উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপক অংশের বিচারও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা জরুরি সময় থাকতেই।

আলামত ও আবহা্ওয়া ভাল নয়। (যদিও আমার সন্দেহ যে শেষপর্যন্ত এটা জামাত শুদ্ধিকরণে মার্কিন প্রজেক্টের অংশ হবে, কয়েকজনের বিচার শেষে পুরো যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটাকেই চিরতরে চাপা দেওয়া হবে) পাকিস্তানী ভাষ্য আমাদের শোনা উচিত, কিন্তু সেই ভাষ্যই ইতিহাস এটা এক অসম্ভব দাবি। আখতারুজ্জামান মণ্ডল নামের এক মুক্তিযোদ্ধা দেখিয়েছেন কীভাবে শর্মিলা বোস পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের আÍপ সমর্থনকেই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন, কিন্তু উপক্ষা করেছেন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যকে। নিয়াজিকে তিনি সমীহ করেন, এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর চোখে হয়ে যায় ‘দুষ্কৃতিকারী’। এর সঙ্গে গবেষণা বা অনুসন্ধানের সম্পর্ক নাই, এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক অবস্থান, পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুর্বৃত্ত চেহারা ঢাকার চেষ্টা।

একইসঙ্গে তা মোহাচ্ছন্ন ও নিপীড়িত পাকিস্তানী জনগণের নিপীড়কদের পাবলম্বন। যে পক্ষাবলম্বন তিনি এবং বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার জন্য এফ সিক্সটিন বিমান বিক্রির ওকালতি দিয়েও যৌথভাবে করেছেন। (মাইলাম সাহেবকে একবার মুখোমুখি পেয়েছিলাম, তিনি বলছিলেন বাংলাদেশের হয় পাকিস্তান নয়তো তুরস্ক মডেলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা। তাঁরা সম্ভাবনা বললে আমরা সেটাকে অভিসন্ধি বুঝবো। কেন? বাংলাদেশ কি তার নিজের মডেল হতে পারে না, যে মডেল হওয়ার সম্ভাবনা এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে!) গবেষকের মন, চিন্তা, ঝোঁক ও পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষক হিসেবে তাঁর অন্তরের ঝোঁক ও অভিপ্রায়টাই ধরা পড়ে।

একই সঙ্গে উড্রো উইলসন সেন্টারের মতো ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ও সন্দেজনক। গবেষকও বিরাজ করেন না সমাজ-ইতিহাসের বাইরের কোনো স্পেসে, যেখানে বাঙালি গণহত্যা আর বিহারি হত্যা এক হয়ে যেতে পারে, আবার আমাদেরও উচিত নয় একেবারে উপেক্ষাও করা। পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ধুয়া তুলে ভুল প্রেক্ষিতে এলিট ডিসকোর্স ফাঁদা যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতা, তেমনি পাকিস্তানীদের ধর্ষণের ঘৃণা করা আবার ধর্ষণের শিকারদের উপেক্ষার মধ্যে একটা প্রবঞ্চনা থাকে। অন্যদিকে, ইতিহাস সৃষ্টি করতে গিয়ে লোকমনের জীবন্ত মিথ, বিশ্বাস, কিংবদন্তী ও লোকশ্রুতিকে কেবল দরবারি ইতিহাসের উপাদান বানিয়ে রাখা চলবে না। ইতিহাসের সঙ্গে চেতনার একটা সম্পর্ক আছে।

চেতন মানুষ ইতিহাসকে সজীব রাখে, পূজা করে না। অতীতের মধ্যে বন্দী হয়ে যায় না। যে অতীতবন্দী সে ভূতগ্রস্থের মতো নিজের বর্তমান কাজ-কর্ম-চিন্তার নিয়ন্ত্রণ হারায়। ইতিহাসচর্চা তাই অতীতের উদ্ধার নয়, বর্তমানের বিনির্মাণও। পাকিস্তানী শাসকরা যে মিথ্যা ও ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের পতন ডেকে এনেছিল এবং এখনো তারা যে আত্মপ্রবঞ্চনার ঘোরের দশাপ্রাপ্ত, সেই দশার মধ্যে নিজেও বন্দী শর্মিলা বোস।

এখনো একাত্তরের পরাজয়ের ভূত তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্ম একাত্তরের চেতনায় নতুন করে উদ্দীপিত হচ্ছে- হোক তা উচ্ছ্বসিত ও শৈশবিক। একদিকে এই জাগর হওয়ার প্রক্রিয়া অন্যদিকে ভুতগ্রস্থতার বিকার; এই দুইয়ের লড়াই ইতিহাস চর্চার জমিনে চললেও আগামীর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটা-নাঘটার সঙ্গেও তা সম্পর্কিত। পাকিস্তান এখন ভূত, তাকে আমরা ফেলে এসেছি একাত্তরের রণাঙ্গনে। তার ক্ষমতা ভূতের মতো আছর কাটার ক্ষমতা, পেছনে টেনে রাখার ক্ষমতা।

তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কবচ হলো একাত্তরের দর্পণে উপমহাদেশের রাজনীতিকে দেখার পরিষ্কার দৃষ্টি। কিন্তু ভুললে চলবে না, স্বাধীন হওয়ার পরদিন থেকেই বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন করে মুখোমুখি হয়েছে তার সত্যিকার ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। সেই পথে পাকিস্তান পেছনে, সামনে অতিকায় ভারত। শর্মিলা বোসও ভিন্নভাবে এই সমীকরণকেই ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে দেখাতে চান, দেখাতে চান গৃহযুদ্ধ হিসেবেও। আহমদ ছফা যেমন বলেন, বাংলাদেশের আবির্ভাব কেবল দ্বিজাতিতত্ত্বেরই খণ্ডন নয়, ভারতবর্ষীয় একজাতিতত্ত্বেরও নেতিকরণ।

আমাদের তাই, বাংলাদেশি-বাঙালি মেকি গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে, ইনক্লুসিভ ও উদার বাঙাল-পরিচয়ের রজ্জু আঁকড়ে ধরে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একাত্তরের অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। জয় সম্পূর্ণ হয় ‌'যথাযথ' ইতিহাসে, হতে পারে সেই ইতিহাসও ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ হলেও ব্যাপকভিত্তিক স্বীকৃত ইতিহাসও আমাদের নাই। এর জন্য নিজেদের ছাড়া আর কাকে দোষ দেব? মুক্তির শুরু একাত্তর, শেষ নয়। আর আমাদের ব্যথার পূজা আর সত্যের দায়ও হয়নি সমাপন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।