আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকাঃ > সিটি অব ডেঞ্জার, সিটি অব হেল ! (১)

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
প্রথম কিস্তিঃ বেশ কিছুদিন আগে বিশ্বের অন্যতম দুষণযুক্ত নগরী হিসেবে ঢাকার নাম আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছিল। সেই জরিপে বিশ্বের সব চেয়ে দুষিত নগরী বলা হয়েছিল বাকু’কে। আর ঢাকার অবস্থান ছিল- বিশ্বের দ্বিতীয় দুষিত নগরী হিসেবে। এর পরের বছর এবং এবারো ঢাকা তার সেই 'মহান' ঐতিহ্য ধরে রেখেছে! বলা বাহুল্য এই জরিপকাজ করা হয় বা হয়েছিল আমাদের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং বিভিন্ন ভাষ্য কেন্দ্র করে। সংবাদপত্রে ঢাকার দুষণের বা যানজটের কিংবা শব্দদুষণের সব খবর প্রকাশ হয় না।

যদি তাই হতো তাহলে বাকু কিংবা হারারে কোনোভাবেই আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকাকে হারাতে পারত না! নিশ্চিতভাবেই আমরা প্রথম হতাম! ঢাকা যে বিশ্বের সব চেয়ে দুষিত, সব চেয়ে শব্দদুষণে দুষ্ট, সব চেয়ে স্থবির, যানজটে নাকাল, নিয়মহীনতায় শ্রেষ্ঠ এতে আর কারো কোনো সন্দেহ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু খোদ ঢাকাবাসীর কোনোই সন্দেহ নেই। একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা কোনোভাবেই বিশ্বের আর কোনো দেশের রাজধানীর সাথে তুল্য হতে পারে না। উন্নত দেশের রাজধানীর কথা তোলা অনাবশ্যক। আমাদের মত পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর কোনোটির রাজধানীর এমন করুণদশায় নেই। শুধু কি তাই? যাতায়াত, দুষণ, শব্দদুষণ, নোংরা-আবর্জনা এবং যানজটের ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য শহরগুলো থেকেও ঢাকা পিছিয়ে! একটা অদ্ভুত নিয়মহীনতা, অনাচার, অনিয়ম, নীতিহীনতা, বিশৃঙ্খলতা, নির্লিপ্ততা, তুঘলকী কারবার আর মগের মুল্লুকের মত প্রায় দেড় কোটি মানুষের চাপ বুকে নিয়ে এটাই বাংলাদেশের রাজধানী! কোন বাংলাদেশে ? যে বাংলাদেশ নিজেকে এখন ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের স্বপ্নে বিভোর! একটি আধুনিক নগরীতে সড়ক থাকতে হবে নগরীর মোট আয়তনের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ।

অর্থাৎ ঢাকার আয়তন যদি এক’শ বা এক’শ কুড়ি বর্গ কিলোমিটার হয় তাহলে সড়ক থাকতে হবে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বর্গ কিলোমিটার। এখন আছে খুব বেশি হলে পনের থেকে কুড়ি বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের তো বটেই, বাংলাদেশের আর পাঁচটি বড়ো শহরের তুলনায় ঢাকার সড়ক ব্যবস্থা নিকৃষ্টতম। সারা ঢাকার কোথাও টানা এক কিলোমিটার মসৃণ সড়ক নেই। জাহাঙ্গীর গেট থেকে ভেতর দিকের ব্যাপার আলাদা।

সেখানকার তুলনা আর কোনো কিছুর সাথে চলে না। ঢাকার এই সড়কগুলো কোনো এক সময় হয়ত সড়ক ছিল। পরে এর সর্ব শরীরে ম্যানহোল বসিয়ে একে করা হয়েছে ‘আন্ডারপাসের উপরিভাগ’। অর্থাৎ পুরোটাই আন্ডাগ্রাউন্ড ড্রেন। সেই ড্রেনের উপরিভাগকে বলা হচ্ছে রাজপথ! সেই তথাকথিত রাজপথে চলছে আদ্দিকালের ঘোড়াগাড়ি থেকে একেবারে লেটেস্ট মডেলের বিএমডাব্লিউ বা মার্সিডিস বেঞ্জ! আছে রিকসা, রিকসাভ্যান, ঠেলাগাড়ি, অটো, অটো রিকসা, পিকআপভ্যান, বাস-ট্রাক, প্রাইভেট কার, পঞ্চাশ ফুট লম্বা কনটেইনারবাহী ট্রেইলার, মোটর সাইকেল, বাই সাইকেল,ভিখারীদের ঘরে বানানো কাঠের ছোট চাকার ঠেলাগাড়ি, আরো হরেক কিসিমের যান্ত্রিক এবং অযান্ত্রিক যানবাহন।

এই বিশাল যানমচ্ছবের চলাচলিতে সব কিছুই আছে, কেবল নেই কোনো শৃঙ্খলা। নেই আইন কানুন মানার বালাই। মাত্র চল্লিশ বছর আগে এই শহরটি যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, তখন এবং তার পর প্রায় আশির দশক পর্যন্ত এই নগরীতে সকল সড়কেই রিকসার অবাধ যাতায়াত ছিল। তখন গরু বা মোষে টানা ময়লা বহনের গাড়িও ছিল। সে সময় গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটে যেতে রিকসায় আধা ঘন্টা লাগত, এখন বিএমডাব্লিউ বা মার্সিডিস গাড়িতে লাগে এক ঘণ্টার উপর।

শুধুই কি যানজটের কারণে? না। ঢাকার অদ্ভুত ট্রাফিক সিস্টেমের কারণে এই সময় লাগছে। ঢাকার যানজট নিয়ে প্রতিটি সরকারই বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নেয়। সেই সরকারের আমলে তো বটেই, পরবর্তি সরকারও সেই সব প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এক একটা প্রকল্প মানেই কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ।

এক একটা প্রকল্পের গালভরা নামের বাহার দেখা যায় মিডিয়ায়। পত্রিকার পাতায় পেল্লাই সব আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এডিবি, বা এই ধরণের দাতা সংস্থার অর্থায়নে সেই সব প্রকল্প বাস্তবায়নের খবর শোনা যায়। কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তাবায়ন হয়ও। তারপর দেখা যায় সেই প্রকল্প বাস্তাবায়নের আগের চেয়ে যানজট আরো একমাত্রা বেড়ে গেছে।

এ যাবত যতগুলো ‘উপায়’ ঠিক করে সেগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতে যানজট তো কমেইনি বরং আরো এক প্রস্থ বেড়ে গেছে। এখন আর এ নিয়ে কেউ আশাবাদও ব্যক্ত করে না! সবাই যেন ধরেই নিয়েছে- এ শহরে সবই সম্ভব! এ শহর মরল বলে! একটি আধুনিক নগর ব্যবস্থা আর সেই নগরের পরিকল্পনা কেন্দ্র করে যা যা থাকা দরকার বা থাকা উচিৎ তার সবই এই নগরকে কেন্দ্র করে ছিলো এবং আছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার বাজেট, সেই বাজেট বাস্তবায়ন, নতুন নতুন প্ল্যান, সেই সব প্ল্যান বাস্তবায়ন, সবই হচ্ছে। তারপরও এই নগরী কোনো ভাবেই স্বাভাবিক মনুষ্য চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠছে না। যানজট নিরসন, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, শব্দদুষণ কমানো, দুর্ঘটনা কমানো, এবং সাধারণ মানুষের যাতায়াত সহজ আর নির্বিঘ্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ আর দপ্তরে একের পর এক প্ল্যান চকআউট করা হচ্ছে আর প্রতি দিনই আগের দিনের চেয়ে যানজটের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে! এই প্রায় মৃত নগরীকে মোটামুটি মনুষ্য চলাচলের উপযোগী করবার জন্য ডজন ডজন প্রতিষ্ঠান আর হাজার হাজার লোকলষ্কর দিন রাত ঘামঝরা পরিশ্রম করে যাচ্ছে! তাদের ‘অক্লান্ত’ পরিশ্রমের ফসল- আরো এক প্রস্থ যানজটের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা।

এই নগরীকে দেখভাল করার জন্য আছে ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা আরবান কম্যুনিকেশন ডিপার্টমেন্ট, রোডস এন্ড হাইওয়ে, বিআরটিএ, বিআরটিসি, ট্রাফিক পুলিশের ডজন ডজন দপ্তর আর উপ দপ্তর, এশিয়ান হাইওয়ের পার্ট প্রজেক্ট, এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলে একটি আলাদা মন্ত্রক। এদের সাথে আছে, ওয়াসা, ডেসকো, পিডিবি, টেলি কমিউনিকেশন, ঢাকা আরবান ক্লিনিং প্রজেক্টসহ আরো হরেক কিসিমের প্রতিষ্ঠান। এর উপর প্রায় প্রতি মাসেই যানজট নিরসন বা এই ধরণের কিছু গালভরাবুলি সর্বস্ব বিশেষ কমিটি, যাদের কাজ হলো গবেষণা করে ঢাকাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা। তারা একটি কাজই পারেন, তা হলো যে সব প্রকল্পে শত শতকোটি টাকার ব্যাপারস্যাপার আছে, সেই সব প্রজেক্ট সরকারকে গেলানোর চেষ্টা করে যাওয়া। একটা প্রাগৈতিহাসিক যান চলাচল ব্যবস্থা বহাল রেখে এরা এখন নতুন করে সুর তুলেছেন- ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আরো ফ্লাইওভার, আরো বাইপাস, আরো আন্ডারপাস, আরো ওভারপাস, ইলেকট্রিক ট্রেন, কমিউটার ট্রেন, চার লেন, ছয় লেনসহ আরো কত কি! এটা জলের মত পরিষ্কার যে এই সব এক একটা প্রকল্প মানেই সেই সব কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে মোটা অংকের উৎকোচ ঢুকে যাওয়া।

অথচ এই ঢাকা নগরীকে মোটামুটি বসবাসযোগ্য আর সাবলীল চলাচলযোগ করার জন্য খুব বেশি কোশেশ করার দরকার করেনা। সৎ চিন্তা, সঠিক পরিকল্পনা আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত হলেই খুব বেশি হলে ছয় মাসের মধ্যেই এই প্রায় স্থবির হয়ে যাওয়া ঢাকাকে মোটামুটি চলনসই একটি নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সব কিছুর আগে মাথাভারি দপ্তরের মোটামাথা কর্তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। এই আলোচনায় একে একে যে বিষয়গুলি আসতে পারে, তা হলো- নগরীর সড়ক, সড়ক ব্যবস্থা, যানবাহনের প্রকৃতি, যানবাহন নিয়ন্ত্রণের উপায়, শব্দদুষণের কারণ, শব্দদুষণ দূর করার উপায়, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক বাতির ব্যবহার, ট্রাফিক পুলিশের যোগ্যতা, সেবাদানকারী বিভাগগুলোর সমন্বয়, আইন তৈরি, আইনের প্রয়োগ, আইনের প্রতি আইন প্রণেতাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইন মানতে বাধ্য করণ, মাথাভারি পরিকল্পনার পরিবর্তে দেশি টেকসই পরিকল্পনা এবং আগামী কুড়ি বছরের আগাম পরিকল্পনা। মোটামুটি এই বিষয়গুলি এই আলোচনায় ক্রমান্বয়ে উঠে আসবে।

এই রচনার সার সংকলন হিসেবে একটি প্রতিচিত্র দেয়া যেতে পারে- বিশ্বের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক যানজটের শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে ঘিঞ্জি আর ঘিনঘিনে চলাচলের শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা আর আবর্জনাময় শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক আর সবচেয়ে প্রাগৈতিহাসিক যানবাহনের সহাবস্থানের শহর ঢাকা! বিশ্বের তো বটেই, বাংলাদেশের সবচেয়ে ধুলিময় শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদুষণের শহর ঢাকা! বিশ্বের এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে এবড়োথেবড়ো আর ভাঙ্গাচোরা সড়কের শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের ট্রাফিক সিস্টেমের শহর ঢাকা! বিশ্বের একমাত্র নাগরিক পরিবহনহীন শহর ঢাকা! বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক যাতায়াতের শহর ঢাকা! পুলিশের সবচেয়ে অথর্ব আর উর্বর মস্তিষ্কের বিভাগ-ঢাকা ট্রাফিক পুলিশ! দেশের সবচেয়ে অথর্ব আর অপদার্থদের দিয়ে কাজ চালানো বিভাগের হাতেই ন্যাস্ত গ্রেটার ঢাকার সড়ক যোগাযোগ আর যাতায়াত ব্যবস্থা! এই ঢাকা সম্পর্কে ফুট নোটঃ ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল’........এই রাজধানী দেখে আর যাই হোক বিশ্বের কোনো জাতি আমাদের সভ্য ভাবতে পারে না! চলবে...........
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.